ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আসাদুজ্জামান চৌধুরী

টঙ্গী ট্র্যাজেডি ॥ আর নয় লাশের মিছিল

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

টঙ্গী ট্র্যাজেডি ॥ আর নয় লাশের মিছিল

রুপালি, পারভীন, নার্গিসদের কান্না কি কখনও আমরা থামাতে পারব? আমরা কি তাদের আগুনে পোড়া ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারব? পোড়ামাটির অভিশাপে তাদের স্বামীর মৃতদেহগুলো তারা কি কখনও ফিরে পাবে? নাকি আগুনে পোড়া কয়লাগুলো তাদের জীবনসঙ্গীর অস্তিত্বের কথা বলবে? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত কোনদিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ কোন একটি ঘটনা যখন ঘটে তখন সেই ঘটনা সারাদেশকে সাময়িকভাবে নাড়া দিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আমরা ভুলে যাই। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বিয়োগান্ত ঘটনাগুলো রোধ করার জন্য যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়া দরকার তা আমরা জোরালোভাবে বিবেচনা করি না। ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, দীর্ঘ হয় লাশের সারি, কপাল পোড়ে রুপালি, পারভীন, নার্গিসদের। যারা তাদের পরিবার নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখছিল, ছেলেমেয়েদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত যাদের আগামী দিনগুলোকে আশান্বিত করে তুলেছিল, আজ যেন সব মরীচিকা। অনেক পুরনো একটি ঘটনা। ১৮ জুলাই ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ। সেদিন আঁধার আবৃত রাত থেকে রোমের সওদাগরি নগরকে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলতে দেখা যায়। গ্রীষ্মের অভিশপ্ত বাতাসে সেই আগুন ক্রমান্বয়ে শুষ্ক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে কাঠের তৈরি নয়নাভিরাম শৈল্পিক ভবনগুলো পুড়ে যেতে থাকে। এই আগুনের আয়ুষ্কাল ছিল ছয় দিন সাত রাত। এতে রোমের সত্তরভাগ এলাকা দগ্ধ হয়। গুজব উঠে সম্রাট নিরো রোম নগরীর ওপর অত্যাচারের নির্দেশ দেন। সে কারণেই আগুন! এই গুজবটি সারাবিশ্বে এখনও প্রচলিত আছে। পৃথিবীর সব ভাষাতেই প্রবাদ রয়েছে ‘রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।’ তবে এই কিংবদন্তি প্রবাদের সত্যতা যাচাই করবেন ইতিহাস গবেষকরা। অভিশপ্ত আগুন যেন সম্প্রতি বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা-ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল রাজধানীর নিকটবর্তী টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড কারখানায়। এরপর ভবন ধসে পড়ে পুরো কারখানা এলাকাটি একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫-এ। অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে কঙ্কালও পাওয়া গেছে। এখনও খোঁজ মিলছে না ১১ শ্রমিকের। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা কেউ জানে না। তবে নিরোর মতো এ ধরনের কারখানার মালিকেরা লাভের অর্থ গুনলেও মানুষের নিরাপত্তার কথা তারা কখনও ভাবেন না। এক্ষেত্রেও কারখানার মালিকের কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। রানা প্লাজার মতো এই কারখানার মালিককেও আইনের আওতায় আনা জরুরী। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, গাজীপুর টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সেখানে ১৫২টি শিল্প-কারখানা রয়েছে, যাদের অধিকাংশের অবকাঠামোগত দিকটি যুগোপযোগী নয়। যে শিল্প-কারখানাগুলো বর্তমানে সচল রয়েছে তার মধ্যে অন্তত ৫০টি ভবনে শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করছে। অধিকমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে ৭টি শিল্প-কারখানা ইতোমধ্যে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়েছে। ৫৪ বছরের অধিক পুরাতন ও জরাজীর্ণ এই কারখানাগুলোতে জীবন এবং জীবিকার তাগিদে অনেক শ্রমিক জীবন বাজি রেখে কাজ করে চলছে। তাদের জীবনেও যে কোন সময় নেমে আসতে পারে এই জাতীয় মহাদুর্যোগ। ট্যাম্পাকো ফয়েলসে অগ্নিকা-ের ঘটনায় বিসিকের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি ট্যাম্পাকো ছাড়াও শিল্প এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলোর বর্তমান অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুর্ঘটনা সম্বন্ধে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছেন। কেউ বলেছেন মালিকের গাফিলতি ও জরাজীর্ণ ভবন, কারও মতে গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ, বয়লারের প্রযুক্তিগত ত্রুটি, মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লারের ব্যবহার, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, দাহ্য ফুয়েল, কেমিক্যালসহ নানা ধরনের কারণ এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। যে যাই বলুক, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া এই ধরনের ঘটনাগুলো রোধ করা সম্ভব না। সময় পরিবর্তিত হয়েছে, টেকনোলজিক্যাল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে গড়ে উঠেছে। শিল্প-কারখানাগুলোর প্রকৃতি অনুযায়ী যে ধরনের ভবন নির্মাণ করা দরকার সেই প্রযুক্তিগত ভিন্নতার বিষয়টি আমরা শিল্প-কারখানায় নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি না। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, শিল্প-কারখানার প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এনার্জি সাশ্রয়ী, সবুজায়নবান্ধব, পেট্রোলিয়াম ও কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে বিস্ফোরক নিরোধক মডুলার বিল্ডিং, অগ্নি প্রতিরোধক বিল্ডিং ও অত্যাধুনিক ইন্টিগ্রেটেড ফাংশনাল ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার করে শিল্প-কারখানাগুলো নির্মাণ করা হলে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফায়ার সাপ্রেসিং সিস্টেম, মাল্টিডিরেকশনাল অগ্নিনির্বাপক রোবট, শুষ্ক কেমিক্যাল, ফোম ও অগ্নিরোধক গ্যাস, আগুনের ধোঁয়া শনাক্তকরণ সেন্সর প্রভৃতি ব্যবস্থাপনা ব্যবহার করে অগ্নি রোধ করা সম্ভব। এছাড়াও আন্যান্য আধুনিক অগ্নিনিরোধক যন্ত্র ব্যবহার করে শিল্প-কারখানাগুলো সুফল পেতে পারে। সরকারের উদ্যোগে ফায়ার ফাইটিংসহ নিরাপত্তার বিষয়টি জোর দেয়া হলেও এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিল্প-কারখানা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে দেশে প্রচলিত শিল্প-কারখানা ও শ্রম আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। কারখানা ও শ্রম সংক্রান্ত এই আইনগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করা দরকার। এখানে একটি বিষয় ভাবা যেতে পারে, আমাদের দেশে ডুয়েট, বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, চুয়েটসহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা, সচেতনতা ও গবেষণার ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে। উন্নত বিশ্বের মতো প্রতিটি শিল্প-কারখানাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আইন করে সম্পৃক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভবন নির্মাণ, নিরাপত্তা, পণ্যের গুণগতমান উন্নয়নসহ বিশেষায়িত পরামর্শ প্রদান ও গবেষণা কার্যক্রম চালাবে। বিনিময়ে গবেষণার অর্থের যোগান দেবে এই শিল্প-কারখানাগুলো। এতে শিল্প-কারখানাগুলো যেমন উপকৃত হবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে। শিল্প-কারখানাগুলোতে যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাবার আগেই আমাদের তা প্রতিরোধের বিষয়টি ভাবতে হবে। যে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলে আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা প্রয়োগ করে তা নির্মাণ করতে হবে। দুর্ঘটনা কবলিত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ অথবা বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ক্ষুণœ না হয়। আমরা আর শ্রমজীবী মানুষের লাশের মিছিল দেখতে চাই না, আমরা গাইতে চাই জীবনের জয়গান। লেখক : রেজিস্ট্রার, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), গাজীপুর
×