ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

খুনী নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের ব্যাপার

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

খুনী নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের ব্যাপার

সত্যের জয় হবেই। কানাডার আদালত তাই বলে দিয়েছে আরেকবার। শেখ হাসিনাকে একহাত নিতে চাওয়া বাঙালীর অভাব নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পেছনে লেগে থাকা মানুষগুলোর অতীতের কোথাও আছে পাকপ্রেম কোথাও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা। যারা আওয়ামী লীগবিরোধী তাদের বুঝলেও এদের বুঝি না। কারণ এদের টার্গেট ব্যক্তি। সে ব্যক্তিটি যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী- আতঙ্কিত হতে হয় বৈকি। প্রধানমন্ত্রী আর যাই হোক না কেন প্রিয়ংবদা নন। তিনি সবসময় মিষ্টি করে কথা বলেন না। বরং প্রায়ই কড়া করে বলেন- এটাও মানি। আবার মাঝে মাঝে যা দরকারী নয় বা না বললে চলে, তাও বলে ফেলেন। রাজনীতিতে এটার দরকার থাকলেও এর কারণে প্রিয়তা কমে। কিন্তু আমরা কোনভাবেই তাঁকে মূল্যায়ন করব না এটা কি ধরনের কথা? তিনি বিধ্বস্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। একদা এ দেশে জাতীয় পতাকা জাতীয় আসন চলে গিয়েছিল দেশবিরোধীদের হাতে। একটা সময় মনে হয়েছিল এটাই নিয়তি। এ দেশ চলবে যৌথভাবে। একদিকে বা উপরে উপরে থাকবে মুক্তিযুদ্ধ আদর্শ নীতির কথা আর ভেতরে চলবে পাকিকরণ। জিয়াউর রহমান তার সরল সমীকরণ দেখিয়ে গিয়েছিলেন। নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে রাষ্ট্রপতি আর রাজাকার দালাল শিরোমণি শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী। ব্যস, সে লিগেসি চলতেই লাগল। শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার এসে এর অবসান ঘটালেন। মাঝামাঝি জায়গাটা চিরকাল ভয়ঙ্কর। যেমন হয় সত্য নয় মিথ্যা ঠিক তেমন। অর্ধসত্য এগুলোর চেয়ে ভয়ানক। তাঁর এই একদর্শী আদর্শিক লড়াই আজ যাদের অপছন্দ তারা তলে তলে এ দেশের সুযোগ-সুবিধা উন্নয়ন ও আধুনিকতা ভোগ করেন ওপরে লেবাসধারী। না আমি শেখ হাসিনার প্রশস্তি গাইতে বসিনি। বলতে চাইছি এই যে, নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নিউজÑ এটা কি তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা ও বলিষ্ঠতার পরিচয় বহন করে না? আজ বাংলাদেশ আর মিনমিন করে কথা বলার দেশ না। তার গায়ে তার আদলে ব্যবস্থায় যেসব পরিবর্তন এসে লেগেছে সেগুলোই তাকে দৃঢ় ভূমিকা নিতে সাহায্য করছে। এককালে আমাদের দেশে কেউ বেড়াতে এলে বা আমাদের সরকারপ্রধান কোথাও বেড়াতে গেলে একমাত্র সরকারী টিভি চ্যানেল একসপ্তাহ ধরে তা নিয়ে আহাজারি করত। সম্পর্কের নতুন দিগন্ত নামের সে প্রোগ্রামগুলো ছিল বস্তাপচা। আসল কাজের ঠিক-ঠিকানা নেই, খালি বায়বীয় বুদবুদ। সেদিন আজ বিগত। এখন আমরা দেনদরবার করতে পারি। আমাদের ন্যায্য চাওয়া-পাওয়া নিয়ে খোলামেলা কথা বলার এ সময়কালে শেখ হাসিনাকে পাবার কারণে দেশের শরীরে লেগে থাকা কলঙ্কের দাগ মুচছে। তিনি শক্ত ছিলেন বলেই রাজাকার মানবতাবিরোধীদের শাস্তি হয়েছে। তিনি যখন কানাডায় সেখানে শুধু আর্থিক উন্নয়ন বা সমঝোতার কথা হয়নি, হয়েছে খুনী ফেরত দেবার কথাও। এই খুনী আমাদের জাতির পিতাকে সরাসরি গুলি করা খুনী। একজন মানুষ যখন জাতির পিতাকে খুন করে নিরপরাধ রাষ্ট্রপতির পরিবারকে খুন করে বুক ফুলিয়ে তার সাফাই গায় তাদের বিচার হবে না? এককালে দুনিয়া ছিল হাতের বাইরে। তখন এরা হাতের কাছে ব্যাংককে পালিয়ে ভেবেছিল দুনিয়ার বাইরে চলে গেছে। কালক্রমে তারা ধরা পড়ে। শেখ হাসিনা তাদের বিচার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেউ আইন বা বিচারের বাইরে নয়। তাঁর এবারের সফরে তিনি আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ কানাডার বর্তমান সরকারপ্রধানের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন। এই তরুণের পিতা মি. ট্রুডো ছিলেন আমাদের পরম বান্ধব। একাত্তরে তিনি এ দেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তানীদের অনাচার, বাঙালী নিধনের বিরুদ্ধে জাস্টিন ট্রুডোর পরিবারকে সম্মান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। সে উপহার, সে পদক পৌঁছে গেছে নবীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে। যাদের এমন ভূমিকা তাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি খুনী পালিয়ে আছে এটা কি আসলে মানায়? না ইতিহাসের সঙ্গে যায়? একদা দুনিয়ায় সামরিক জান্তারা টপাটপ সিভিল সরকারপ্রধানদের খতম করে কথিত শান্তির পয়গাম নিয়ে হাজির হতো। তাদের পোশাক কথা আর ব্যবহারে মনে হতো ডাইরেক্ট দেবদূত এসে হাজির। যে কোন দেশের যে কোন সমস্যা সমাধানে তাদের নেতৃত্বই যথেষ্ট। একেক জনের কত ধরনের কাহিনী আর বর্বরতা। এসেই তারা জনগণের চাওয়া-পাওয়ার মুখে লাথি মেরে মানুষের কণ্ঠ কলম স্তব্ধ করে আজগুবী মনগড়া উন্নয়নের কেচ্ছায় ডুবিয়ে রাখতো দেশ-জাতিকে। আমাদের দেশে এত কাহিনী এত ঘটনার পরও তারা টিকতে পারেনি। যারা বঙ্গবন্ধুকে মেরে এদেশের ইতিহাসকে পেছনে টানতে চেয়েছিল তাদের আয়ুষ্কাল ছিল কয়েক মাস। এরপর জন আক্রোশ আর নিজেদের বিবেকের ভয়ে এরা দুনিয়ার নানা দেশে পালিয়ে যায়। নূর চৌধুরী নামের এই ঘাতক গেছিল কানাডায়। সেখানে সভ্যতা ও মানবতার দোহাই দিয়ে এখনও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে এই লোকটি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবার তাকে ফিরিয়ে আনার কথা তুলেছিলেন। সেখানকার বাঙালীদের সভায় তাঁর বক্তব্য দেখে মনে হলো কানাডার প্রচলিত আইন ও সভ্যতার আবরণে লুকিয়ে থাকা এই খুনীকে এখনই আনা যাচ্ছে না। কারণ, সেদেশের আইন অনুযায়ী কোন দেশে কারও বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- বা ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের রায় থাকলে তারা সে মানুষটিকে ফেরত পাঠায় না। বিস্মিত প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছেন এটা কোন ধরনের আইন বা কোন ধরনের কথা? আসলেই তাই। কোন মানুষ একটি দেশের জাতির পিতাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে সেদেশের ইতিহাসকে খুনের রঙে রাঙিয়ে কি করে সভ্য সমাজে সভ্য দেশে লুকিয়ে থাকে? যেসব দেশ আয় উন্নতি, মানবাধিকার ও মেধায় এতটা অগ্রসর সে দেশের বুকে একজন ঘাতক কিভাবে পালিয়ে বাঁচে? কানাডার নবীন প্রজন্মের কাছে এ কথা তুলে ধরার দায় আমাদের। এরা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে, এদের জোট ও সম্মিলিত শক্তি দেশে দেশে জঙ্গীবাদ নির্মূলে হামলা চালায় অথচ ঘরের ভেতর লুকিয়ে আছে ঘাতক। পাপ বা এই ধরনের অনাচার কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। আজ কানাডার বুকেও অশান্তির ছায়া। তাদের দেশে সরকারবিরোধী হামলার ঘটনা নতুন নয়। মানুষের মনে আছে আতঙ্ক। সে আতঙ্কে ঘি ঢালছে এই খুনীর দল। কানাডা কি জানে না এর অতীত কি? এই মানুষটি মানুষরূপী পশু, যে ঠা-া মাথায় খুন করতে জানে। সামরিক বাহিনীর চেন অব কমান্ড ভাঙ্গার মতো অপরাধেও অপরাধী এই আর্মি অফিসার। জীবনের কোথাও যার নিয়ম মানা জীবনকে শ্রদ্ধার কোন কাহিনী নেই তাকে আগলে রাখাও এক ধরনের অপরাধ। প্রধানমন্ত্রী সত্যভাষী। তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই বলেন। সে কারণে তিনি নূর চৌধুরীকে দেশে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে জনমত গঠনের কথা বলেছেন। দেরিতে হলেও এর বিকল্প নেই। আজ সারাবিশ্বে যে উগ্রবাদ জঙ্গীবাদ আর খুনের নহর নূর চৌধুরীরা তার পূর্বসূরি। এরা আমাদের জাতিকে এতিম করে দিতে চেয়েছিল। পাক-মার্কিন সহায়তা আর ভ্রান্ত রাজনীতির পোষ্য, এদের শাস্তি না হলে সভ্যতা কোনদিনও শান্তিতে থাকতে পারবে না। আজকের বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও উগ্রতার যেটুকু আমরা দেখছি এরাই তার সূচনাকারী। পাশ্চাত্যকে এটা বলার সময় এসেছে, আপনারা যদি কথাও কাজে একমত হন বা হতে চান নূর চৌধুরীর মতো ঘাতককে ফেরত দিন। দুনিয়া দেখুক পাপের শাস্তি ও ঘাতকের নির্মম পরিণতি। এ না হলে কেউ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। বাংলাদেশ এখন আর দুধভাত দেশ নয়। তার কথা তার বক্তব্য তার স্বচ্ছতা দুনিয়ায় এখন ফ্যাক্টর হতে চলেছে। এমন নয় যে তাকে এড়িয়ে চলা বা অবজ্ঞা করা সম্ভব। কাজেই কানাডার মতো বন্ধুপ্রতিম দেশের কাছে আমাদের এই চাহিদা অবশ্যই নৈতিক। আজ গ্লোবাল ভিলেজের এই জমানায় নূর চৌধুরী মূলত চাঁদে গিয়েও ছাড় পাবার কথা না। মানুষ তাকে খুঁজে আনবে। কানাডার কাছে আমাদের আরও বলার আছে। যার যার দেশের ইতিহাস বাস্তবতা আর আইনের নিরিখে বিচার হয়। আমরা যেমন আপনাদের বেলায় মাথা ঘামাই না আপনারাও নিশ্চয় তাই করবেন। এই বদ লোকটিকে রেখে নিজেদের গায়ে কলঙ্ক মাখার কি কোন প্রয়োজন আছে? কি কাজে আসে এই লোক? আপনাদের খায় দায় ঘুমায় আর মস্তিস্কজুড়ে লালন করে হত্যা ও অপরাধ। একে রেখে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনার কোন কারণ নেই। বাইরে আওয়ামী লীগের শাখা-প্রশাখার অভাব নেই। তবে এরা কখন যে কি করে বোঝা মুশকিল। সিডনিতে এদের কাজকর্ম দেখে মনে হয় নিজেদের মানুষ ঠেকানো ও ঘরে দুশমন পালন করাই তাদের আসল কাজ। আমেরিকা ইউরোপ বা কানাডায় হয়ত তাই হবে। যদি তা হয় ও সেখানে আওয়ামী লীগের বয়স ও কাজের পরিধি বিবেচনা করলে এটা বলতে পারি, তারা চাইলে এ ব্যাপারে জনমত গঠন করতে পারেন। বহুধাবিভক্ত বাংলাদেশীদের একসঙ্গে একত্রিত করার মন্ত্র একটাই। বঙ্গবন্ধু বললেই সব ভেদাভেদ ব্যবধান ঘুচে যায়। তাঁর করুণ মৃত্যু মানুষ এখনও ভোলেনি। এই ঘাতকরাই এখনও সর্বজন ধিক্কৃত। এমন ধিক্কৃত খুনীকে দয়া করে যেন কেউ আশ্রয় দিতে না পারে সে কাজে তাদের এখনই সরব হওয়া উচিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পর এটা দায়িত্ব বিবেচনা করলেই খুশি হব আমরা। কানাডার ইতিহাসে বাংলাদেশীদের অগ্রযাত্রা ও অবস্থান বিবেচনা করলেও নূর চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার বিকল্প নেই। আমাদের জীবদ্দশায় আমরা যেন দুশমনমুক্ত খুনীমুক্ত বাংলাদেশ দেখে যেতে পারি। কানাডা এসে পাশে দাঁড়াক, তাদের সভ্য সুন্দর ইমেজ বাঁচিবে রাখুকÑ এটাই আমাদের প্রার্থনা। ২১ সেপ্টেম্বর খবর বেরিয়েছে নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বের করে দেয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে সে দেশের হাইকোর্ট। এখানে একটাই মন্তব্যÑ ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
×