ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুদিনে ২৪ জনের মৃত্যু

বিশ্বের উষ্ণায়ন বাড়ছে, বজ্রপাতও বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বিশ্বের উষ্ণায়ন বাড়ছে, বজ্রপাতও বিধ্বংসী রূপ নিচ্ছে

শাহীন রহমান ॥ বর্ষার বিদায় বেলায়ও বজ্রপাতে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই মিলছে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন গ্রীষ্মে দেশে বজ্রপাতের বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও সাধারণত বর্ষায় বজ্রপাতের বিধ্বংসী রূপ নেয়া অস্বাভাবিক একটি বিষয়। কারণ আমাদের দেশে বর্ষাকালে সাধারণত আড়াআড়ি মেঘ থাকে। আর এ ধরনের মেঘে যে বজ্রপাত হয় তার কারণে জানমালের কোন ক্ষতি হয় না বললেই চলে। এ ধরনের মেঘ সৃষ্ট বজ্রপাত সাধারণত ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে না। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি বজ্রপাতের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। তাদের মতে, বর্ষা বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে বাতাসে জলীয় কণার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান উষ্ণ হয়ে পড়ছে। এ কারণে সেসব অঞ্চলে স্তম্ভ মেঘ সৃষ্টি হয়ে বিধ্বংসী বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ষড়ঋতুর এই দেশে বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাস ঝড়বাদলের সময় হিসেবে পরিচিত। এ সময়ে আকাশে মেঘ জমলেই কালবৈশাখীর বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত বেশি হয়ে থাকে। মেঘ সৃষ্টি হলে বজ্রপাতের ঘটনা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। আবহাওয়াবিদদের মতে বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে গ্রীষ্মকাল সময়টাতে বজ্রপাতের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে এ বজ্রপাত বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। তবে ঠিক কি কারণে আকাশে ভয়াবহ বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে, ক্রমান্বয়ে কেনই বা বিধ্বংসী রূপ গ্রহণ করে এর সঠিক কারণ বিজ্ঞানীদের জানা না থাকলেও ধারণা করছেন বিশ্বে উষ্ণায়নের প্রভাবে বজ্রপাতের ভয়াবহতা বাড়ছে। এ কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। তাদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়াম-লে তাপমাত্রা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ লাখগুণ বেশি। ফলে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের শোষণ ক্ষমতা একেবারে কমে এসেছে। ক্রমেই পৃথিবীর উষ্ণায়ন বাড়ছে। এ কারণে বজ্রপাত ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে দেশ থেকে মৌসুমি বায়ু বিদায় নেয়ার সময় চলে এসেছে। আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে প্রকৃতি থেকে বর্ষায় বিদায় নেবে। তাই বিদায় বেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমি বায়ু অনেকটা দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এ কারণে বাতাসে জলীয় কণার পমিাণ বেড়ে যাচ্ছে। জলীয় কণা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাতাসেও উষ্ণতার পরিমাণ বাড়ছে। উষ্ণতার কারণে বর্ষায় শেষ বেলায় বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। গত দুদিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে প্রায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার ভোরে বজ্রপাতের মারা গেছে ১৫ জন। সোমবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে প্রায় ৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ এ্যাসেটট্রানমিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এফআর সরকার বলেন, বাতাসে মূলত দুটি তড়িত প্রবাহ যখন এক সঙ্গে মিশে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় তখনই বজ্রপাত ঘটে। আকাশে এ ধরনের বজ্রপাত সাধারণ খাড়াভাবেই বেশি হয় (ভার্টিকাল)। এটি সাধারণ গ্রীষ্মকালে এপ্রিল-মে মাসেই বেশি হয়ে থাকে। কারণ ওই সময় প্রকৃতিতে তাপমাত্রা বেশি থাকে। তিনি বলেন, মেঘ সৃষ্টির সময় সাধারণত বায়ুম-লে ঋণাত্মক তড়িৎ পদার্থ যদি বেশি শক্তিশালী হয় তাহলে আকাশের নিচের দিকে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি হয়। এখান থেকে সৃষ্টি হওয়া বজ্রপাত সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে আঘাত করে। আর এ বজ্রপাতের কারণেই মানুষের মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। ধনাত্মক তড়িৎ প্রবাহ বেশি শক্তিশালী হলে আকাশের ওপরের দিকে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে বেশি। এ বজ্রপাতের প্রভাব ভূপৃষ্ঠের দিকে আসে না। আর এ ধরনের বজ্রপাত হয় মূলত বর্ষাকালে। কারণ ওই সময়ে প্রকৃতিতে তাপমাত্রা অনেক কম থাকে। ফলে এ ধরনের বজ্রপাত সাধারণত ভূপৃষ্ঠে আসে না। এ সময়ে মেঘে আড়াআড়ি বজ্রপাতের কারণে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না। তবে সম্প্রতি সময়ে বর্ষা মৌসুমে বজ্রপাতের ধরন পাল্টাচ্ছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এটি হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বজ্রপাতের সময় প্রকৃতিতে যে তাপের সৃষ্টি হয় তার পরিমাণ প্রায় ২৭ হাজার ৭৬০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। এ কারণে বজ্রপাতের ভেতরে যে কেউ একবার পড়লে তার মৃত্যু অনিবার্য। আবার ভূপৃষ্ঠে যে স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে তার ১৫ থেকে ২০ ফিটের মধ্যে কেউ থাকলে তার মৃত্যু অনিবার্য। এছাড়া বজ্রপাত সরাসরি টিনের ঘর বা দালানকোঠার ওপর পড়লেও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। গাছপালার ওপর পড়লে পুড়ে যায়। তবে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুরোধ করা না গেলেও আর্থিংয়ের মাধ্যমে (তড়িৎ প্রবাহ মাটির নিচে প্রবাহিত করা) ঘরবাড়ি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। সম্প্রতি দেশে বজ্রপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এটি জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করেছে সরকার। জাতীয় দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ১০৩ জন। গত মে মাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বজ্রপাতের মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত যেহেতু সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য একটি দুর্যোগ, যার হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্যাপকভাবে জনগণকে সচেতন করে তোলার বিকল্প নেই। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রতিবছর গড়ে ২শ’ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বজ্রপাতে। এ হার বিশ্বের দ্বিতীয়। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের হিসাব মতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটিতে বজ্রপাতে মানুষ মারা যাবার সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, দেশে কিছু এলাকা এমনিতেই জায়গা বজ্রপাতপ্রবণ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই বজ্রপাতের সম্ভাবনা থাকে। তবে বজ্রপাতের সঠিক কারণ নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে কোন গবেষণা নেই। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা অনুযায়ী তাপমাত্রা এক ডিগ্রী বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। পৃথিবীর যে কয়েকটি অঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ তার মধ্যে দক্ষিণ-এশিয়া অন্যতম। তাদের মতে দেশে মে মাসের দিকে তাপমাত্রা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যায়। এ কারণে ওই সময়ে মেঘ সৃষ্টি হলে বজ্রপাতের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে বর্ষাকালের শেষ সময়ে বাতাসে জলীয় কণার পরিমাণ বেশি থাকায় গত কয়েকদিনে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে বলে তারা উল্লেখ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, খেজুরগাছ, তালগাছের ওপর মূলত বজ্রপাত বেশি হয়। এর ফলে মানুষ বাঁচত। বর্তমানে দেশে এর সংখ্যা কমে আসার কারণে বজ্রপাত এখন সরাসরি মানুষের ওপর পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টিকে দেশে এতদিন তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তাদের মতে দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে বিষয়টিকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
×