ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অস্থির সময়, ঘৃণার রণডঙ্কা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অস্থির সময়, ঘৃণার রণডঙ্কা -স্বদেশ রায়

কয়েকদিন হলো একটি পানকৌড়িকে খুব বেশি মিস করছি। প্রতিদিন সকালে সে আমার জানালার পাশে এসে জলে ডুব দিত। তারপরে রোদ উঠলে রোদে ডানা মেলে নিজেকে শুকাত। মাথার ভেতর থেকে এ পানকৌড়িটাকে কোন মতেই বের করতে পারছি না। বরং মাঝে মাঝে এসে উপস্থিত হচ্ছে জলে ডুব খেলার ওই পানকৌড়িটি। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, বাঙালীর বুক পকেটে একটা বাংলাদেশ থাকে। তাই এত ইট, কংক্রিটের পরেও একটি পানকৌড়ি মনে হয় এভাবেই মাথার ভেতর জায়গা করে নিয়েছে। অথচ কী মূল্য আছে এই পানকৌড়িটির একজন মানুষের জীবনে! কোন অর্থমাপে মাপা যাবে কি তার কালো শরীর নিয়ে কিশোরী বালিকার মতো ডুব সাঁতার খেলা? মানুষের মনের অস্থিরতার মতো ওই ডুব সাঁতার না কবিতার ছন্দের মতো ওই ডুব সাঁতার? আসলে এই মুহূর্তে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার কবিতার ছন্দ হয়ে মাথার ভেতর বসে থাকার সুযোগ পাচ্ছে না। পানকৌড়ির ডুব সাঁতার দেখতে দেখতে হঠাৎ সেলফোনে ব্রেকিং নিউজ আসছে, আজিমপুরের নারী জঙ্গীর পুলিশকে ছুরিকাহত করার ঘটনা। মাথার ভেতর ও চোখের সামনে যখন এই কনট্রাস্ট উপস্থিত হয় তখন কিন্তু শেষ অবধি অস্থিরতাই জয় লাভ করে। এই অস্থিরতা নিয়ে যায় নানান বেদনায়। যেমন একটি বেদনা কেমন যেন কুরে কুরে খাচ্ছে মস্তিষ্কের কোষগুলো। মনটা কুঁকড়ে উঠছে মুসলিম সম্প্রদায়ের ১.৬ বিলিয়ন মানুষের কথা ভেবে। পৃথিবীর মানব সমাজ নানান সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান পতনের ভেতর দিয়ে অনেকগুলো ভাগের ভেতর ধর্মীয় ভাগেও ভাগ হয়েছে। ১.৬ বিলিয়ন মানুষ সেই ধর্মীয় ভাগের ভেতর পড়েছে বাই নেচার। যেখানে তাদের কোন হাত ছিল না। এই ১.৬ বিলিয়নের ১ মিলিয়নের এক শ’ ভাগের এক ভাগও সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কর্মকা-ে জড়িত নয়। অথচ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ওই গুটি কয়েক জঙ্গী ও ১.৬ বিলিয়ন মুসলিমকে এক করে ফেলছে। অনেকেই মুসলিম আর জঙ্গী এখন সমার্থক শব্দ তৈরি করে ফেলেছে। সৃষ্টি হয়েছে তাদের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা। ওই গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া ১.৬ বিলিয়ন মানুষের বাকি মানুষদের মানসিক কষ্ট কি যে কোন মানব সন্তানকে বেদনায় কুঁকড়ে দেয় না? অথচ কি আশ্চর্য যে শক্তি ওই গুটি কয়েক জঙ্গী তৈরি করেছে সেই শক্তি আলাদা করার কাজটি না করে গোটা ১.৬ বিলিয়নের ওপর ঘৃণার তীর ছোড়াই করেছে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী দেশটির নির্বাচনের মূল উপজীব্য। শুরু থেকে মনে হচ্ছিল শেষ অবধি ঘৃণা জিতে যেতে পারে। কারণ ঘৃণার বিপরীতে কোন ভালবাসা নেই, কোন সুন্দর নেই। নেই কোন শুভ শক্তি। আছে ছদ্মাবরণে ঢাকা একটি কৌশলী মূর্তি। যে মূর্তি থেকে মাঝে মাঝে হাত বের হয় এবং সে হাত হয়ে ওঠে সিরিয়া, মিসর, ফিলিস্তিনে শত শত লাশের মিছিলের, নারী ধর্ষণের অন্যতম কারণ। পৃথিবী এখন এই অদ্ভুত এক অন্ধকারে। পৃথিবীতে যখন অন্ধকার নামে তখন ওই অন্ধকারের ভেতর নানান সাপে হিস হিস শব্দ তুলে তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়। ঘৃণার বিপরীতে দাঁড়ানোর শক্তি তখন কারও থাকে না। ঘৃণার বিপরীতে দাঁড়াতে পারে এক মাত্র সুন্দর ও উজ্জ্বল আলো। এই দুয়ের এখন প্রচ- অভাব পৃথিবীতে। দিকে দিকে কেবল ঘৃণাই বিজয়ী হচ্ছে। তাই আমেরিকার নির্বাচনে যদি ঘৃণার পক্ষ বিজয়ী হয়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নয় বরং সেটাই অনেক বেশি স্বাভাবিক। সেখানে এক শ্রেণীর মানুষ ঘৃণার মাদক গ্রহণ করে উত্তেজিত হচ্ছে, তার বিপরীতে সুন্দর ও আলো হাতের কেউ নেই। অন্যদিকে ইতোমধ্যে সেখানে ‘উই ক্যান’ সেøাগান পানসে হয়ে গেছে। রূপ নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়, সন তারিখ খোদাইয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকা- একটি সেøাগানে। তাই ছদ্মাবরণের বিপরীতে ঘৃণার জেতাটি খুব সহজ। যদি পৃথিবীর ইতিহাস দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে শান্তির থেকে পৃথিবী যুদ্ধের ভেতর কাটিয়েছে বেশি সময়। প্রতিটি যুদ্ধের একটি পক্ষ থাকে আক্রান্ত অপর পক্ষের মূল অস্ত্র ঘৃণা। তবে এরপরেও এই পৃথিবীতে শান্তির জন্য, সুন্দরের জন্য প্রতি মুহূর্তে ক্ষীণস্বরে হলেও একটি স্বর বেজে চলে। সেখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীতে সব থেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়- সমর শক্তিতে বলিয়ান রাষ্ট্র এবং সমর শক্তির খেলাগুলো। এই খেলা থেকে পৃথিবী কোনদিন মুক্তি পাবে কিনা, কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে কিনা, বুদ্ধ, কনফুসিয়াস হয়ে আরও কত লক্ষ কোটি বছর পৃথিবীকে চলতে হবে কিনা- কে জানে? তবে মাঝে মাঝে তরুণরা স্বপ্ন দেখে, তরুণের পাখায় ভর করে পৃথিবী এগোয়, না বাসুকি নাগের মোচড়ের মতো একটু নড়েচড়ে ওঠে তাওবা কে জানে? তরুণ বেলায় একটি কলেজ ম্যাগাজিনে আরেক সমবয়সী তরুণের একটি গল্প পড়েছিলাম, সেখানে ওই তরুণের স্বপ্ন ছিল একটি টাইম মেশিন এসে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন ও হোয়াইট হাউসকে। তারপর কয়েক দশক না যেতেই গর্ভাচেভ নামক এক টাইম মেশিনের ভেতর দিয়ে পৃথিবী থেকে সরে গেছে ক্রেমলিন। না তাতে যুদ্ধ থামেনি, রক্ত ঝরা থামেনি বরং এখনও মিসরীয় মানসীর বুক চিরে ঝরছে রক্ত আর সিরীয় মানবী যৌনদাসী হয়ে তিলে তিলে হারিয়ে যাচ্ছে দানবের হিংস্র থাবায়। রক্তাক্ত যেমন মিডল ইস্ট, আফ্রিকা তেমনি রক্তাক্ত হচ্ছে এখন ইউরোপ। রক্তাক্ত ইউরোপ- ভিজে রক্তে পা দিয়ে শান্তির মশাল জ্বালানোর বদলে ঘৃণার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। অন্যদিকে এশিয়াতে আমেরিকার ‘ভিখুর ঘা’ পাকিস্তানকে বাদ দিলে মোটামুটি শান্তিতে ছিল এশিয়া। ইতোমধ্যে প্রায় হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীর প্রোডাকশন হাউস, নিজের বাজারকেও প্রত্যেকে করে তুলেছে শক্তিশালী। ঠিক এ সময়ে সাউথ চায়না সাগরের তেলের ওপর পড়েছে শ্যামের শ্যেন দৃষ্টি, অন্যদিকে নতুন সমর ক্ষমতা উন্মাদ করেছে চীনকে। এশিয়ার ঐক্যের বদলে এশিয়ায় বিভেদ আসছে চীনের সাউথ চায়না সি নীতি নিয়ে। তার সুযোগ নিয়ে এশিয়ার নানান মাটিতে পা রাখার সুযোগ পাচ্ছে আমেরিকা। চীন বলেছে, যাই ঘটুক না কেন, কামানের গোলা দিয়ে সে জবাব দেবে। প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মানুষের শক্তিশালী সমর রাষ্ট্র চীন তদুপরি জাতি হিসেবে তারা রেজিমেন্টাল মোটেই আর্গুমেনটেটিভ নয়। তাই যুদ্ধে যাওয়া তার পক্ষে অনেক সহজ কিন্তু তারপরে ওই রুশ কবির কবিতা থেকে ধার নিয়ে বলতে হয়, যে যেখানেই যুদ্ধ করুক, যার পক্ষেই ছুড়ুক না গুলি ঠিকই খালি হয় একটি মায়ের কোল। আর মানুষ হিসেবে কামনা একটাই, পানকৌড়ির বুকটি যেন রক্তাক্ত না হয়। [email protected]
×