ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আতিকুর রহমান রাজু

ফুরোচ্ছে কি প্রয়োজন?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ফুরোচ্ছে কি প্রয়োজন?

আধুনিক সভ্যতা আমাদের দিয়েছে অনেক কিছুই। সভ্যতার যুগে কার্যকর কিছু আবিষ্কার আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে সহজ। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা যেমন অনেক কিছুই পেয়েছি, তেমনিভাবে কিছু বিষয় হারিয়েছি যা ছিল আমাদের ঐতিহ্য। হারানো কিছু ঐতিহ্যের মধ্যে একটা ঐতিহ্য হচ্ছে- বিয়েতে ঘটকের কার্যকারিতা। আগেকার দিনগুলোতে ছেলে বা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলেই ডাক পড়ত ঘটকের। মজার একটা পোশাক পরে হাজির হতেন ঘটক সাহেব। ঘটকের পোশাকের মধ্যে সবচেয়ে কমন ছিল কালো রঙের বড়সড় আকারের একটা ছেঁড়া ছাতা। মুখভর্তি পান নিয়ে যে রাস্তা দিয়ে ঘটক সাহেব হাঁটতেন সুগন্ধি জর্দার কল্যাণে তার উপস্থিতি টের পেতেন বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়ের মা-বাবা। ঘটকের উপস্থিতির দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত বিবাহ উৎসবের আমেজ। অনেক নিখাঁত ছিল সেই আনন্দ। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে কালো ছাতাওয়ালা ঘটকের কার্যকারিতা অনেকটাই শেষ হয়ে গেছে। পত্রিকায় ‘পাত্র-পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে পরস্পরের প্রণয়ের মাধ্যমে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাঝের সম্পর্ক জোড়া লাগানো ব্যক্তিটির উপস্থিতির সুযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই আবার মাঝে মাঝে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতারক চক্র তাদের প্রতারণার জালে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে বিবাহইচ্ছু অনেককেই। এখন ঘটকের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত ‘আধুনিক ঘটকের’ মধ্যে সেই বিশ্বাসযোগ্যতা আর নেই। আগেকার দিনে ঘটকের উপরই পুরোপুরি ভরসা করতেন সম্ভাব্য পাত্র-পাত্রীর মা-বাবা। তাদের বিশ্বাসের মর্যাদা ঠিকই রাখতেন ‘চাচামিয়া’। গ্রামাঞ্চলে ঘটক আসতেন নতুন একটা সম্পর্ক তৈরির পয়গাম নিয়ে। ঘরের আড়াল থেকে উঁকি মেরে ঘটক সাহেবের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করত লাজুক মেয়েরা। হবু পাত্রীর চোখে থাকত ঘটকের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। নিজের জীবনের জন্য উপযুক্ত একজন মানুষ যিনি নির্বাচন করে দিতে যাচ্ছেন সে অন্য কাতারের একজন মানুষ অবশ্যই এই বিশ্বাসটি মেয়েদের মনের মধ্যে থাকতো। হবু পাত্রের সঙ্গে ঘটকের সম্পর্কটাও ছিল দেখার মতো। পাত্রী সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব বিষয় জানার জন্য ঘটকের বাড়িতে সময়-অসময়ে হাজির হয়ে যেত পাত্র সাহেব। ঘটক সাহেবের আরেকটা গুণ ছিল। কোন খাবার যদি তার সামনে আসত তাহলে খুব কম সময়ই অন্য কেউ সেই খাবার খাওয়ার সুযোগ পেত! সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টির মধ্যেই ছিল একটা অকৃত্রিম সম্পর্ক তৈরি করার নির্ভেজাল আনুষ্ঠানিকতা। ডিজিটাল ঘটক তাড়িয়ে দিচ্ছে সেকেলে ঘটকদের। একালের আধুনিকতা আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে সেকালের অকৃত্রিমতা। গ্রামাঞ্চলে কিছু জায়গায় এখনও কিছু ঘটক চোখে পড়ে। কিন্তু তাদের মধ্যেও পরিবর্তন চলে এসেছে। তাদের মধ্যে আর স্বাতন্ত্র্য নেই। সর্বোপরি, হারিয়ে যাচ্ছে চাচামিয়ারা, হারিয়ে যাচ্ছে তাদের স্পেশাল পোশাক, হারিয়ে যাচ্ছে নতুন সম্পর্ক তৈরির বার্তা আনার রেওয়াজ, হারিয়ে যাচ্ছে দরজার ওপাশে অপেক্ষমাণ আশাভরা দুটি চোখের সলজ্জ দৃষ্টি। সরকারী তিতুমীর কলেজ, ঢাকা থেকে
×