ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

উন্নয়নে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

উন্নয়নে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা

বাংলাদেশের টাকা অবাধে রূপান্তরক্ষম নয়। বিদেশ থেকে মূলধন, মাধ্যমিক দ্রব্য ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানির মূল্য অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা দিয়ে পরিশোধ করা হয়। সমকালে অবাধে রূপান্তরক্ষম মুদ্রার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানী ইয়েন, ইউরো, সৌদি রিয়াল, চীনা ইউয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ডলার ইত্যাদি। মার্কিন ডলার অধিকন্তু সম্পদের নিলয় হিসেবে বিশ্বব্যাপী সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা হয়। অবাধে রূপান্তরক্ষম এসব মুদ্রার পারস্পরিক বিনিময় হার, সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে বাণিজ্যের মাত্রা, বিভিন্ন মুদ্রার পারস্পরিক বিনিময় হার ও মুদ্রার মজুদের হারের ওপর নির্ভরশীল থাকে। অবাধে রূপান্তরক্ষম এসব মুদ্রা দিয়ে বিদেশ থেকে দ্রব্য ও পণ্যসামগ্রী আমদানিকরণ এবং এ দেশে বিনিয়োগকৃত বিদেশী মূলধনের সুদাসল পরিশোধ করা হয়। অন্যান্য মুদ্রা, যথাÑ বাংলাদেশী টাকা, ভারতীয় রুপি ইত্যাদি অবাধে রূপান্তরক্ষম হয় না। দ্বিপক্ষীয় লেনদেনে উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে এসব অরূপান্তরীয় মুদ্রা ব্যবহার বা আদান-প্রদান করা যায়। এসবের বাইরে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত বিদেশী বিনিময় বা পরিশোধন প্রক্রিয়ায় এসব মুদ্রা, এক্ষেত্রে টাকা, সংশ্লিষ্ট বিনিময় হার অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখে তার বিপরীতে সমমূল্যের অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা অবমুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দেশের রফতানি ও আমদানি প্রসূত অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী বিনিময় মুদ্রা পরিশোধন বা দেশের বিদেশী মুদ্রার আয় অর্জন ও ব্যয় নির্বাহকরণের চূড়ান্ত নিকাশ ঘর হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। এই ভূমিকা পালনক্রমে বিদেশী মুদ্রার সাময়িক অপ্রতুলতা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক অনুমোদিত সীমার মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রদত্ত চাঁদা কিংবা তার অনুকূলে প্রদত্ত ‘কোটার’ বা বিশেষ আহরণীয় অধিকার ব্যবহার করে বা স্বল্পমেয়াদী ঋণের অবয়বে মেটানো হয়। বিদেশী দেনা-পাওনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করে থাকে। যে কোন দরিদ্র দেশের উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তরিত করার জন্য মূলত প্রয়োজন হয় কলকব্জা বা অববায়িত প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা। বিনিয়োগ উৎসারিত আয় জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করে সমতা বিধান এমনকি পরিবেশ দূষণ এবং দূষণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অন্য কথায়, সঞ্চয় এবং তার ভিত্তিতে প্রযুক্তিক বিনিয়োগ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সংশ্লিষ্ট সামাজিক ক্ষেত্রে জনগণের জন্য কল্যাণকর উপকরণ সরবরাহের সক্ষমতা দেয়। এরূপ নিশ্চয়তা প্রদান সঞ্চয় ও প্রযুক্তিক বিনিয়োগকে সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও কল্যাণকর পরিবর্তনের ভিত্তি হিসেবে কার্যক্ষম মৌল শক্তির প্রাধান্য দেয়। উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কলকব্জা তৈরি করা ও চালু রাখার পর্যাপ্ত বা পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তিক ভিত্তি থাকে না। ফলত কেবল অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বাড়িয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রাকৃতিক বিনিয়োগ প্রযুক্ত করা সম্ভব হয় না। উদাহরণ হিসাবে এখনও এদেশে একটি বড় সেতু ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি উন্নয়ন বা শ্রম ব্যয় দেশের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় দিয়ে মেটানো গেলেও সেতুর মূল কাঠামো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এরূপ প্রেক্ষাপটে দেশের উন্নয়নের এই পর্যায়ে প্রায় সকল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হয় বিদেশ থেকে কলকব্জা বা অববায়িত প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিক জ্ঞান ও দক্ষতা আনয়নের। একমাত্র অবাধে রূপান্তরণীয় বিদেশী মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে অববায়িত প্রযুক্তি কিংবা কলকব্জা বা এতদসংক্রান্ত জ্ঞান দক্ষতা আনা সম্ভব। এই প্রেক্ষিতে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা অর্জনের জন্য রফতানি ও সময় বিশেষে বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। এই প্রেক্ষিতে এও মনে রাখা সঙ্গত যে, ক্রমান্বয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রযুক্তির ভিত্তি রচনা ও প্রসারণ টেকসই উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচনীয়। অন্য কথায়, কেবল সঞ্চয় বাড়ানোই নয়, সঞ্চয়ের একটি প্রধান অংশ হিসেবে রফতানি বাড়ানো ও বিদেশে লাভজনকভাবে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা এবং যুগপৎভাবে দেশের অভ্যন্তরে লাগসই অববায়িত প্রযুক্তি উন্নয়নের সুপরিকল্পিত কার্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য ও মূল্যবান উপকরণ। লাগসই উন্নয়নের পরিকল্পনার আওতায় দেশের অভ্যন্তরে প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের স্বনির্ভর ও ক্রমবর্ধনশীল ভিত্তি স্থাপন ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণ করে বিদেশী মুদ্রার অবয়বে সঞ্চয়ের অপরিহার্যতা পরিহার কিংবা কমানো সম্ভব। একটি স্বনির্ভর বা লাগসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় উত্তরণের পরিকল্পনায় এই বিষয়টির দিকে মনোযোগ দেয়া অত্যাবশ্যক। অবশ্য এও মনে রাখা সঙ্গত যে, দেশে প্রযুক্তিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশ থেকে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রার বিনিময়ে অববায়িত প্রযুক্তি বা প্রযুক্তিক জ্ঞান দক্ষতা আমদানির গুরুত্ব বা নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। বাংলাদেশের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে রফতানি বাড়ানোর ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে ষষ্ঠ পরিকল্পনাকালের শেষ বছরে দেশের বিদেশী মুদ্রার মজুদ প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উপনীত হয়। এই পরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ ২০১৫ সালে প্রক্ষেপিত মজুদের চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি ছিল। খালেদা জিয়ার শাসন আমলে ২০০৫-০৬ অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। সেই তুলনায় এই বছরে শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্বের ফলে দেশে বিদেশী মুদ্রার মজুদ ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছর ২০২০ সালে বিদেশী মুদ্রার মজুদ প্রায় ৪৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এই প্রক্ষেপণের ভিত্তি হিসেবে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালের ৫ বছরে রফতানির প্রবৃদ্ধি বার্ষিক শতকরা ১২ ভাগ এবং আমদানির প্রবৃদ্ধি বার্ষিক শতকরা ১২.৩ ভাগ হবে বলে হিসাব করা হয়েছে। বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়প্রাপ্তির প্রবৃদ্ধি গড়ে বার্ষিক শতকরা ১০.৯ ভাগ এবং বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ গড়ে শতকরা ৪৩.২ ভাগ হারে বাড়বে বলে অনুকল্পিত হয়েছে। রফতানি ও বিদেশে বাঙালী শ্রমিক প্রেরিত আয় ছাড়াও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এবং বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ঋণ ও অনুদান অবয়বে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রা কিংবা বিকল্পে সেসব বিদেশী মুদ্রায় সরবরাহকৃত বা কেনা মূলধন দেশে আসে। এসবের অবয়ব ও মাধ্যমে কলকব্জা বা মূলধন দ্রব্যাদি, মাধ্যমিক পণ্যাদি এবং সময় বিশেষে ত্রাণমূলক ভোগ্যপণ্য দেশে আসে। ত্রাণমূলক পণ্য বাদ দিয়ে বিদেশী ঋণ ও অনুদান এবং প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ দেশে মূলধন দ্রব্য আনে এবং দেশের প্রযুক্তিক ভিত্তিকে প্রসারিত করে। এক্ষেত্রেও আমদানীয় মূলধন দ্রব্যাদির পরিমাণ ও গুণগত উৎকর্ষ যথাযথভাবে আহরণ ও সংরক্ষণ করে প্রযুক্তিক ভিত্তি ও কাঠামো প্রসারণ করা লক্ষ্যানুগ হবে বলে লাগসই সময় ব্যাপ্ত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা সঙ্গত। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রক্ষেপণ অনুযায়ী রফতানি-আমদানি ও বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে ন্যূনপক্ষে ৭টি ক্ষেত্রে অধিকতর সচেতন হওয়ার অবকাশ বেশ বিস্তৃত বলে মনে হয়। ১. দেশের রফতানির ভিত্তি এখনও অতি মাত্রায় সরু। রফতানির সিংহভাগ তৈরি পোশাকের-প্রায় শতকরা ৮২ ভাগ। শতকরা ১৮ ভাগ তৈরি পোশাক বহির্ভূত পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের পরিমাণ শতকরা প্রায় ১৯ ভাগ, মাছ ও হিমায়িত খাদ্যের পরিমাণ শতকরা প্রায় ১০ ভাগ এবং পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদির পরিমাণ শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ। সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের রফতানি স্থিতিশীল মাত্রায় বাড়ানোর লক্ষ্যে অন্যান্য রফতানীয় পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন সৃষ্টি ও বাড়াতে হবে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে এখনও আমদানীয় মাধ্যমিক পণ্যাদির পরিমাণ শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ। অন্য কথায়, তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বিদ্যমান মূল্য সংযোজনের পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট পিছদুয়ারী শিল্প গড়ে তুলে ন্যূনপক্ষে শতকরা ৪০ ভাগে উন্নীত করা বিধেয়। এই লক্ষ্যে যথাযথ বস্তুনিষ্ঠ প্রকল্প ও কার্যক্রম গ্রহণ বাংলাদেশের রফতানিতে যথা ঈপ্সিত বৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। ২. আমদানীয় পণ্যসামগ্রীর মধ্যে যথা প্রয়োজন কলকব্জা বা অববায়িত প্রযুক্তিভিত্তিক মূলধন দ্রব্যের পরিমাণ বা মাত্রা বাড়াতে হবে। মুক্ত বাণিজ্যের মোড়কে মূলধন আমদানির প্রয়োজন এ পর্যায়ে অধিক মাত্রায় থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় যে, মালয়েশিয়া থেকে তরল দুধ বাংলাদেশে আমদানি করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানি যথাসম্ভব কমিয়ে অববায়িত প্রযুক্তিভিত্তিক মূলধন পণ্যাদি অধিকতর পরিমাণে আমদানি করতে পারলে দেশের উৎপাদন তথা রফতানি ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। এই লক্ষ্যে বিদেশ থেকে শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থ বিদেশের বা দেশের মূলধন বাজারের মাধ্যমে বা প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্টভাবে আকর্ষিত ও কার্যকর করতে হবে। একই বিবেচনায় বিদেশ থেকে আকর্ষণীয় প্রত্যক্ষ ব্যক্তি-বিনিয়োগ নির্বাচন ও প্রশাসিত করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩. সমকালে রফতানির ওপর ভর্তুকি দেয়া অব্যাহত আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১ ডলার পরিমাণ রফতানি আয় অর্জনের জন্যে পাদুকা শিল্পের অনুকূলে প্রায় ২২ টাকা ভর্তুিক দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে তেমনি উচ্চহারে ভর্তুকি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রশাসিত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও অসঙ্গতির উপস্থিতি রয়েছে। অপ্রচলিত পণ্যের রফতানির ওপর প্রদত্ত ভর্তুকি কিয়দংশে সংস্কারের দাবি রাখে। এ সকল দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ থেকে রফতানির ওপর প্রশাসিত ভর্তুকির ক্ষেত্র ও হার পুনর্বিন্যাশ করার প্রয়োজন মনে হচ্ছে। ৪. বিদ্যমান রফতানির ওপর প্রদানীয় ভর্তুকির ক্ষেত্র ও হার বিশেষের বিবেচনায় নির্বাচিতভাবে বিদেশী মুদ্রার সঙ্গে টাকার প্রকৃত বিনিময় হার বিভিন্ন মাত্রায় বা অঙ্কে নির্ধারিত করছে। বস্তুত এ সব ক্ষেত্রে বিভিন্ন হারে ভর্তুকি বিবেচনা করলে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, টাকার বিনিময় হার আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃত একক বিনিময় হারের চাইতে অনেক কম বা বেশি কিংবা ভিন্নতর। এ সকল বিবেচনা করে টাকার মূল্য বিদেশী মুদ্রার নিরিখে প্রান্তিক মাত্রায় অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন এবং কেবল ডলারের আপেক্ষিকতায় টাকার মূল্য নির্ধারণ না করে ডলার ছাড়াও ন্যূনপক্ষে আরও চারটি মুদ্রা, যথাÑ ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, জাপানী ইয়েন ও চীনা ইউয়ানের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সূত্র অনুযায়ী নির্ধারণ করা কর্মানুগ হবে বলে মনে হয়। কেবল একটি বিদেশী মুদ্রার সঙ্গে সংযোগ না রেখে এক ঝাঁক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত থাকলে আমাদের রফতানি আয় বাড়বে, বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা থাকবে এবং প্রকারভেদে আমদানি ব্যয়ে আকস্মিক তারতম্য ঘটবে না। সঙ্গে সঙ্গে টাকাকে ক্রমান্বয়ে অবাধে রূপান্তরক্ষম মুদ্রায় রূপান্তরের পথে এগিয়ে নেয়া সম্ভবপর হবে। ৫. বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির ওপর অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে। বর্তমানে বিদেশে কর্মরত প্রায় ১ কোটি (৮৪ লাখ বৈধ ও ১৬ লাখ অবৈধ) বাঙালী শ্রমিক কর্মরত থাকা প্রতি ১৬ জনের বিপরীতে ১ জন শ্রমিকের বিদেশে অবস্থানের নির্দেশক। বিদিত জনসংখ্যা থেকে বিদেশে অপ্রেরণীয় মহিলা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বৃদ্ধদের বাদ দিলে প্রতি চারজন কর্মক্ষম ব্যক্তির বিপরীতে একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি বিদেশে কর্মরত আছেন বলে প্রতীয়মান হয়। এই প্রেক্ষিতে দেশের উন্নয়নে শ্রমের প্রয়োজন মিটিয়ে এর চাইতে অধিক সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে পাঠানো আমাদের জন্য এখনই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষিতে অদক্ষ শ্রমিকের পরিবর্তে দক্ষ ও পেশাজীবী শ্রমিক পাঠিয়ে আমাদের বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয় বাড়ানোর কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এই লক্ষ্যে দেশের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৬. রফতানি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সম্প্রতি রফতানিকারকদের তাদের রফতানি আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত বিদেশে সংরক্ষণ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক দেয়া এই সিদ্ধান্ত বিদেশী বিনিময় মুদ্রা বিধি অনুযায়ী সরকারের অনুশাসনসহ দেয়া হয়েছে কিনা তা এখনও অজানা। বলা হয়েছে যে, এরূপ মাত্রায় সংরক্ষণের সুবিধা রফতানিকারকদের বাজার প্রসারণে সহায়তা করবে। দাবি করা হচ্ছে প্রয়োজনের নিরিখে এ সংরক্ষণ মাত্রা বেশি। এটা কমিয়ে এনে বিদেশে আমাদের ধনী রফতানিকারকদের দ্বিতীয় বাড়ি ক্রয় বা নির্মাণ করা নিরুৎসাহিত করে অববায়িত প্রযুক্তি আমদানি ও সৃষ্টির জন্য অধিকতর সম্পদ প্রযুক্ত করা প্রয়োজন। অবশ্য এও উল্লেখ্য যে, ক্রমান্বয়ে টাকাকে অবাধে রূপান্তরক্ষম করার কার্যক্রম এগিয়ে গেলে বিদেশে বাজার প্রসারের মোড়কে রফতানি প্রসূত বিদেশী মুদ্রা রাখার সুযোগ না দিলেও চলবে। ৭. সমকালে দেশে বিদেশী মুদ্রার মজুদ ৩১ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়ে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানা গেছে। এই মাত্রার মজুদ বর্তমান হারে দেশের ৭ মাসের আমদানি মূল্য বিদেশী মুদ্রায় পরিশোধন করার জন্য পর্যাপ্ত। এই পরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রক্রিয়ায় দেশের অর্থ ব্যবস্থার উপরে আস্থা বাড়ায়। তথাপিও বলা দরকার ৩ বা ৪ মাসের আমদানির মূল্য পরিশোধন করার জন্যে প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা রেখে যত দ্রুত বেশি পরিমাণ মূলধনীয় দ্রব্য বা অববায়িত প্রযুক্তি দেশে আমদানি এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি উন্নয়নের কাঠামো সৃষ্টি করা যায় তত দ্রুত আমরা দেশকে অনুন্নয়নের স্তর থেকে স্থিতিশীল উন্নয়নের পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হব। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন সমন্বিতভাবে কাজ করলে আমরা দেশের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার অধিকতর সুব্যবহার করতে সক্ষম হব। বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার প্রশাসন বিদেশী বিনিময় মুদ্রা বিধি আইন (ঋড়ৎবরমহ ঊীপযধহমব জবমঁষধঃরড়হ অপঃ) অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সরকারের অনুশাসন অনুযায়ী হয়ে থাকে। বিদেশী বিনিময় মুদ্রা (ভড়ৎবরমহ বীপযধহমব)-এর মধ্যে অবাধে রূপান্তরক্ষম বিদেশী মুদ্রার অতিরিক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আহরিত সোনা, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলে রক্ষিত মজুদ ও সেখান থেকে বিশেষ আহরণ অধিকার (ংঢ়বপরধষ ফৎধরিহম ৎরমযঃং) অন্তর্ভুক্ত। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মুদ্রার প্রাকৃতিক পরিশোধন বা স্থানান্তরণের বিকল্পে প্রতিশ্রুতি পত্রের ক্রমাধিক্য, আঞ্চলিক মুদ্রা বাজারের ক্রিয়াশীলতা, ডলারের আন্তর্জাতিক মূল্যের নিলয় হিসেবে ক্রমাবনতি, উপকূল বহির্ভূত ব্যাংকিং সুবিধাদির প্রসারণ, প্রাকৃতিক বিনিময় বা বাটার বাণিজ্য, প্রলম্বিত পরিশোধন প্রক্রিয়া এবং প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের প্রকৃতি বিন্যাস বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রশাসিত বিদেশী মুদ্রার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্রমাগত সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন বলে প্রতিভাত করেছে। বিশেষতঃ ২০০৩ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত বিনিময় হারের পরিবর্তে অনুসৃত আংশিক ভাসমান বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালনার দাবিদার হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গোলকায়িত পৃথিবীতে তথ্যের প্রবাহ সীমান্তবিহীন হয়ে গেছে, তেমনি অংশত সীমান্তবিহীন হয়েছে আর্থিক লেনদেন, প্রযুক্তি এবং পণ্যভিত্তিক বাণিজ্য। প্রায় একই সঙ্গে বেড়েছে শ্রমের সীমান্তবিহীন চলাচল, তেমনি আন্তর্জাতিক লেনদেন ও পরিশোধন প্রক্রিয়ায় অবাধ রূপান্তরক্ষম মুদ্রার প্রাকৃতিক স্থানান্তরের পরিবর্তে দ্রুত স্থান পাচ্ছে বিভিন্ন আর্থিক হাতিয়ার। অর্থনৈতিক ইউনিয়ন, আঞ্চলিক মুক্ত বাণিজ্য এলাকা ও বিশেষ শুল্ক সম্পর্ক, দ্বিপাক্ষিক ও বহুজাতিক বাণিজ্যের প্রত্যয়, প্রণালী ও অভিঘাতকে করেছে বিভিন্ন প্রকৃতির তাৎপর্যম-িত। এই প্রয়োজনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে সময়ানুক্রমে যথা প্রয়োজন পদক্ষেপগুলো শনাক্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করে সুপারিশবলী শনাক্তকরণ এই সময়ে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×