ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য উঠছে নিরাপদ অভিবাসন আইন

মানব পাচার করলে মৃত্যুদণ্ড, প্রতারণার শাস্তি জেল

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মানব পাচার করলে মৃত্যুদণ্ড, প্রতারণার শাস্তি জেল

ফিরোজ মান্না ॥ নিরাপদ অভিবাসন আইন অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে অচিরেই তোলা হচ্ছে। পরে আইনটি সংসদ থেকে পাস হবে। নতুন আইনের খসড়ার ওপর সুশীল সমাজের মতামতও নেয়া হয়েছে। এই আইনে কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করলে ৫ বছরের জেল-জরিমানার বিধানসহ মানব পাচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদ-ের প্রস্তাব করা হয়। আইনটি পাস হলে প্রতারণার মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে বলে মন্ত্রণালয় মনে করছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশ থেকে প্রতিবছর চার-পাঁচ লাখ কর্মী বিভিন্ন দেশে কাজে যাচ্ছেন। তাদের নিরাপদ অভিবাসন তৈরি করা জরুরী। বছরের পর বছর অভিবাসী কর্মীরা নানাভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে আসছেন। দালাল চক্রের হাত থেকে কর্মীদের রক্ষা করতে একটি সময় উপযোগী আইনের প্রয়োজন রয়েছে। মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ অভিবাসনের জন্য একটি আইনের খসড়া তৈরি করে। এই খসড়া ওয়েবসাইটে রেখে সুশীল সমাজের মতামত নেয়া হয়েছে। এক মাসের বেশি সময় আইনটির ওপর সুশীল সমাজের মতামত নেয়া হয়। এরপর আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ে আইনটির ওপর ‘ভেটিং’ হয়। এখন আইনটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে। প্রতিবছর কয়েক লাখ ব্যক্তি বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন দেশের বেকারত্ব কমছে, অন্যদিকে তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে। বর্তমানে পুরুষ কর্মীর পাশাপাশি নারীও বিদেশে যাচ্ছেন। মন্ত্রণালয় প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়েছে। অধিকহারে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হলে বিদেশে বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা বাড়বে। নতুন আইনে বলা হয়েছে-দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার পর দেশে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীরা সামাজিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। সরকার তাদের পুনঃএকত্রীকরণের কথা ভাবছে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে সংশ্লিষ্ট করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার। অনেক প্রবাসী বিদেশে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আর্থিক ঝুঁকির মধ্যেও পড়েন। অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য, রেমিটেন্সে প্রেরণ, তথ্যপ্রবাহ, সচেতনতা বৃদ্ধি, দক্ষতা উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণে ও সেবা প্রদানে বাংলাদেশ মিশনের শ্রম উইংগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রয়োজনে উইংগুলোকে আরও শক্তিশালী করা হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিবাসনের গুরুত্ব আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অভিবাসী কর্মীদের অবদান অপরিসীম। বর্তমানে প্রায় ৯৬ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসাবে ১৬০টি দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত করছে। এ বছর প্রবাসী ভাইবোনদের পাঠানো রেমিটেন্স ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বিদেশে কর্মসংস্থানের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখার জন্য বিদ্যমান শ্রমবাজার ধরে রাখাসহ আমরা নতুন নতুন সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার অনুসন্ধান করছি। কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য নতুন করে অভিবাসন আইন তৈরি করা হচ্ছে। আইনটি পাস হলে কর্মীদের সুরক্ষা বাড়বে। কর্মীদের নিরাপদ রাখা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। অভিবাসন আইনটি অচিরেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে। এদিকে, প্রবাসী কর্মীদের জন্য এককেন্দ্রিক সেবা চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যারা বিদেশে চাকরি নিয়ে যাবেন, তাদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ভবনে মন্ত্রণালয়ের দুটি অনুবিভাগ রয়েছে। একটি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক অন্যটি বায়োমেট্রিক ফিঙ্গার প্রিন্টসহ নিবন্ধন কার্যক্রম। বিএমইটির কার্যক্রম, ইমিগ্রেশন সার্ভিস, পাসপোর্ট অধিদফতরের শাখা, রিক্রুটিং এজেন্সি বায়রার শাখা, ট্রাভেল এজেন্সির অফিস, স্বাস্থ্য পরীক্ষার বুথ, প্রবাসী কর্মীদের জন্য ব্রিফিং সেন্টারসহ বিদেশে যেতে আগ্রহীদের সব সেবামূলক কাজ করা হবে। বর্তমানে ৯০ লাখ মানুষ প্রবাসে কাজ করছেন। এই হিসাব আসলে আরও বেশি। কারণ অনেকে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব নিয়েও বসবাস করছেন। সব মিলে প্রায় এক কোটি লোক প্রবাসে আছেন। প্রবাসীদের টাকায় সচল রয়েছে দেশের অর্থনীতির চাকা। ১৯৭৩-৭৪ সালে এই খাতে বছরে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা রেমিটেন্স আসত। আর এবার এসেছে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স। আর্থিক বিবেচনায় এই খাত থেকে বৈদেশিক সাহায্যের ১০ গুণ, বৈদেশিক বিনিয়োগের ১৩ গুণ বেশি অর্থ উপার্জন হচ্ছে। জিডিপি’তে এ খাতের অবদান শতকরা ১৩ ভাগ। বাস্তবে এটা ২০ ভাগেরও বেশি। কর্মসংস্থানের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় খাত। এই খাতের উন্নয়ন করতে সরকার নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। অভিবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন একটি সংগঠনের দাবি, অভিবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধে আবদ্ধ হয়ে বিদেশে কর্মী প্রেরণ করতে হবে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় অনৈতিকভাবে কোন কর্মীকে বিদেশে পাঠিয়ে বিপদে ফেলা যাবে না। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় একটি খাত হচ্ছে জনশক্তি। তাদের পাঠানো অর্থে দেশের অর্থনীতি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। ফলে দেশের প্রতিটি মানুষকে অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও সচেতন করতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে সার্বিক ও সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এটা বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
×