ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

জঙ্গী প্রতিরোধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জঙ্গী প্রতিরোধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

জঙ্গী দমন নয়, জঙ্গী নির্মূলেই কাজ করবে পুলিশ, র‌্যাব, নিরাপত্তা বাহিনীর সব দল। পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত দুটি জঙ্গী নির্মূল অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করেছেÑ কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জ অভিযান। শোলাকিয়াও উল্লেখযোগ্য। পুলিশের প্রাণের বিনিময়ে হাজার হাজার মুসল্লির প্রাণ বেঁচেছে। তবে আমরা চাই আমাদের পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা-সদস্য কেউই নিহত হবেন না, বিশেষত দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের জীবিত ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার বক্তব্য বিতর্ক ছড়িয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে জঙ্গীদের প্রতি তার দরদ। তার বক্তব্যই যে কোন আলোচনায় উঠে আসছে। জঙ্গীরা কেন এমন ঝুঁকি নিয়ে এমন কাজ করছে এর পেছনে তাদের যুক্তি এ রকমÑ প্রথমত, জঙ্গীরা নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে একদম অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে তাদের হাতে থাকা পিস্তল, উন্নতমানের রাইফেল, গ্রেনেড এবং চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে বেহেশ্তে যাবে বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং, দ্রুততম সময়ে পুলিশ তাদের কাক্সিক্ষত বেহেশ্তে পাঠিয়ে দেবে বলে তাদের বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত, এদের নেতা-প্রশিক্ষকরা আধুনিক আইন-আদালতে বিশ্বাস করে না, আইয়্যামে জাহিলিয়াত যুগেই তাদের বিশ্বাস; যেমনটি আধুনিক আইন আদালতে বিশ্বাস করে না জামায়াতে ইসলামীরা। সুতরাং, তাদের আমরা কেন আধুনিক আইনের অপরাধী আইনী সুযোগ-সুবিধা দেব? তারা বার বার এই আধুনিক যুগের আইনের সুযোগে জামিন গ্রহণ করে আবারও মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। এই ঘটনা কিছু বিবেকহীন আইনজীবী ও পুলিশের কারণে সংঘটিত হয়। জঙ্গীরা আর যাই হোক, জামিন পাওয়ার অধিকার লাভ করতে পারে না। তৃতীয়ত, আমাদের দেশে পহেলা জুলাই, গুলশানে হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে আমাদের দেশের উন্নয়নে কর্মরত বিদেশী, দেশী এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ যে বাইশজন রাতের খাবার খেতে যাওয়া নিরীহ, নিরস্ত্র নারী-পুরুষকে অভাবনীয় নৃশংস ও বর্বর পন্থায় হত্যা করেছে যে জঙ্গীরা, তাদের জন্য কোনরকম মানবাধিকার থাকতে পারে না। জনগণ শান্তিপূর্ণ জীবন চায়, যারা জনগণের শান্তি নষ্ট করে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে, মুক্তিযুদ্ধের সরকারের কর্মকা-কে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়। সর্বোপরি, আইনের শাসনকে দুর্বল করতে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে পরিকল্পিত হত্যাকা- পরিচালনা করার জন্য তারা প্রতিজ্ঞা নিয়েছে, তাদের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক শাসনের মূলÑ মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি প্রত্যাহার করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, জঙ্গীরা শুধু শান্তি, উন্নয়ন ও রাষ্ট্রবিরোধী নয়, তারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে এবং ভ্রান্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে জেনেবুঝে নিজেদের হত্যাকারীতে রূপান্তরিত করেছে। তাদের জন্য কোন নাগরিক অধিকার থাকবে নাÑ এটিই যুক্তিযুক্ত নয় কি? সুতরাং, জনগণ মনে করে, শীর্ষপর্যায়ের দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের দেখামাত্র গুলি করার বিধান রাখতে হবে এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় পর্যায়ের জঙ্গী সদস্যদের গ্রেফতার, আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়ে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। গুলশান, রূপগঞ্জের ঘটনার পর জনগণ জঙ্গী দমন নয়, জঙ্গী নির্মূলে আগ্রহী ও আন্তরিক হয়ে উঠেছে, একই সঙ্গে জনগণের জীবনে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় নিবেদিত পুলিশের প্রাণ রক্ষায় পুলিশ সতর্কতা অবলম্বন করে অভিযান পরিচালনা করুক, সেটিই তারা চায়। বর্তমানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে জঙ্গী নির্মূলে সোচ্চার হয়েছে, যে পন্থায় পুলিশ, জনগণ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, ইমাম-মৌলানাদের মধ্যে জঙ্গীবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে যেসব আলোচনাসভার আয়োজন করা হচ্ছে তাতে পুরো সমাজের জঙ্গী নির্মূলের পক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই সময়টি এসেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে এবং এটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করাই হবে সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও জনগণের জন্য অগ্রাধিকার। এখন সময় এসেছে, ধর্মকে হত্যার কাজে ব্যবহার করার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধ্বংসকারী আদর্শের রাজনীতি চর্চাকারী জামায়াতে ইসলামী ও এর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ও বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণের। এটি করা হলে, তারা ভিন্ন নামে, ধর্মের নেতিবাচক ব্যবহার থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কোন দল তৈরি করতে বাধ্য হতে পারে। এদিকে, সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, চার জাতীয় নেতার অবমাননা আইন যেটি করেছে, সেটিকে দৃঢ়ভাবে বলবৎ করবে যাতে রাষ্ট্রের জন্মবিরোধী যে কোন রাজনৈতিক দল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এটি সম্ভবপর ও সহজসাধ্য হবে যখন ১. ’৭১-এর দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সরকার অধিগ্রহণ করবে ও পরিচালনা করবে ২. জঙ্গীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে ৩. ’৭১- এর যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও জঙ্গী মতাদর্শে বিশ্বাসীদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে বিচার করা হবে এবং সরকারের তিনটি অঙ্গের সব কটিতেই তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হবে ৪. জঙ্গী ও ধর্মের নামে দেশের বাইরে থেকে অর্থ প্রবেশ বন্ধ করতে হবে ৫. দেশে যারা জঙ্গী অর্থায়নে যুক্ত, তাদের রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার করে কঠিন দ- প্রদান করতে হবে ৬. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে আনা হবে ৭. প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে ৮. দুটি মানবিকবিদ্যাÑ বাংলাভাষার সমৃদ্ধ সাহিত্য পাঠ ও ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে ৯. খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনুশীলন ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হবে। আমাদের কমপক্ষে প্রত্যেক জেলাশহরে একটি সরকারী, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থাসহ ভাল মানের মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেটিতে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থী বিনা খরচে থাকতে পারবে এবং বৃত্তি লাভ করবে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ বা উন্নত দেশ অথবা মধ্যম আয়ের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে যে শ্রমশক্তি দরকার তাতে থাকতে হবে ভাল মানের মাধ্যমিক শিক্ষা। এর ভিত প্রাথমিক স্তরে তৈরি হলেও, লক্ষ্য করা গেছে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম এবং নবম, দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রাথমিক স্তরের বাংলা, ইংরেজী দুটি ভাষা ও গণিত শিক্ষার ঘাটতির অনেকটাই শুধরিয়ে নেয়া সম্ভব যদি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী ভাল মানের শিক্ষা লাভ করে। যা হোক, আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে : অনেক প্রাণের বিনিময়ে একটা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ এসেছে জঙ্গীদের পরাজিত করে, বড় দুর্নীতিবাজ, বড় জঙ্গীমিত্র রাজনীতিক ও অন্য পেশাজীবীদের এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ও তাদের জঙ্গীবাহিনীর বিচার করার। এছাড়া ভূমি, নদী, খাল, বিল, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের প্রাণ, সম্পদ, জঙ্গী ও দখলবাজদের হাত থেকে উদ্ধার করা এবং শিক্ষাকে দেশপ্রেমিক তৈরির প্রধান উপাদানে পরিণত করার সময় এসেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×