ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গতবারের চেয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা কমানো হয়েছে প্রতি বর্গফুটে

পানির দরে কোরবানির চামড়ার মূল্য নির্ধারণ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পানির দরে কোরবানির চামড়ার মূল্য নির্ধারণ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অবশেষে ঘোষণা দিয়ে এবারও পানির দরে কোরবানির চামড়া কেনার সুযোগ নিচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা। গতবারের চেয়ে প্রতি বর্গফুটে ৫-১০ টাকা কমিয়ে আসন্ন কোরবানির কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে লবণযুক্ত গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট রাজধানী ঢাকায় ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে থেকে ৪০ টাকা দরে সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া খাসি বর্গফুটে ২০ এবং বকরি ১৫ টাকা নির্ধারিত হয়েছে। মহিষের লবণযুক্ত দাম নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ২৫ টাকা। বিভিন্ন অজুহাতে চামড়ার দাম কমানোর যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, নতুন দর নির্ধারণের মধ্যদিয়ে তাই সত্যি হলো। এতে কাঁচা চামড়া পাচারের ঝুঁকি আরও বেড়ে গেল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার সকালে রাজধানীর ধানম-ির রয়েল বুফে রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ), বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন (বিএফএল-এলএফইএ) ও বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশন (বিএইচএসএমএ) যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে কাঁচা চামড়ার নতুন দাম ঘোষণা করে। তাদের এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে মাঠ পর্যায়ে লবণহীন চামড়া পানির দরে বেচাকেনা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে চামড়ার মৌসুমি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দানকৃত চামড়ার সুবিধাভোগী এতিম, অসহায়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ, মাদ্রাসাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনুসরণ করে কোরবানির চামড়া সাধারণত দানখয়রাত হিসেবে গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়। আর গরিবদের এই ‘হক’ পানির দরে কিনে নেবেন ট্যানারি মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব জিনিসের দাম যখন একটু একটু করে বাড়ে তখন শুধু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে চামড়ার মূল্য কমে। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের এই অসাধু তৎপরতা বন্ধে এবার প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে তা ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দাম এত কম নির্ধারণ করা হয়েছে যে, এতে শুধু ট্যানারি মালিকরা লাভবান হবেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও লবণহীন প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়ার বর্তমান মূল্য ৬০-৬৫ টাকা। আর বাংলাদেশে কোরবানির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের লবণযুক্ত চামড়া বিক্রি হবে মাত্র ৪০-৫০ টাকায়। এদিকে, গত বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এবার কমেছে মহিষ ও ছাগলের চামড়ার দামও। গত বছর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত মহিষের চামড়ার দাম ছিল ৩৫ থেকে ৪০, খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২০ থেকে ২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকায় সংগ্রহ করা হয়েছিল। তারও আগে ২০১৪ সালে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া কেনেন ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। ঢাকার বাইরে এ দর ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত মহিষের চামড়ার দর ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, খাসির চামড়া ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ও বকরির চামড়ার দর ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকা। সংবাদ সম্মেলনে বিএফএলএলএফইএ চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহেমদ মাহিন বলেন, বর্তমানে আমরা সঙ্কটময় সময় পার করছি। সারাবিশ্বে চামড়ার দাম কম। এছাড়া হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি সরানোসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা অনেক চাপে আছেন। বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, আমরা অনেক সমস্যায় আছি। কিছু পরিবেশবাদী না বুঝে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেন। হাজারীবাগে ছোট-মাঝারি ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের বড় বড় ক্রেতাকে নিয়ে আসতে পারছি না। এবারের চামড়া কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সাভার ও হাজারীবাগে কাঁচা চামড়া কিনব। সাভারে ২০ থেকে ২৫টা শিল্প গড়ে উঠেছে সেখানেও চামড়া কেনা হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম অনেক কমে গেছে। এটি বিবেচনায় নিয়েই এবার দাম নির্ধারণ করা হলো। তিনি আরও জানান, এ শিল্পে ব্যাংক ঋণ পর্যাপ্ত নয় এছাড়া কোরবানির আগে হাজারীবাগ থেকে সাভারে সব ট্যানারি সরানোর কারণে আমরা সমস্যায় আছি। কঠিন বাস্তবতায় এবার চামড়া কিনতে হবে। চামড়ার গুণগত মান নির্ভর করে সংরক্ষণে। কিন্তু এবার লবণের দামও বাড়তি। এ বছর ঈদের সময় তাপমাত্রাও বেশি থাকবে। ফলে চামড়া সংগ্রহের ছয় ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিতে হবে। শাহীন আহমেদ বলেন, আমরা আশা করছি, চামড়া কেনার সময় ট্যানারি মালিকরা ‘আনহেলদি’ কোন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। এতে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। বাংলাদেশ হাইডস এ্যান্ড স্কিনস মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত বছর গরম ও সঠিক সময় সঠিক পরিমাণ লবণ না দেয়ার কারণে প্রায় ২০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এবার পশু জবাই হওয়ার ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে চামড়ায় লবণ দিতে অনুরোধ করেন তিনি। বিভিন্ন মাদ্রাসার সংগ্রহ করা চামড়া বেশি নষ্ট হয় জানিয়ে দেলোয়ার বলেন, আশা করছি, মাদ্রাসার জন্য চামড়া সংগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে লবণ দেবেন অথবা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা নেবেন। এদিকে, ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়। বিএইচএসএমএ সভাপতি আরও বলেন, একটি গরুর চামড়ায় কমপক্ষে ৮-১২ কেজি ও ছাগলের চামড়ায় ১ থেকে ১.১৫ কেজি লবণ লাগানো দরকার। ৬ ঘণ্টার মধ্যে এই লবণ না লাগানো হলে চামড়ার মান হ্রাস পায়। আধা বা ১ কেজি মাংস বাঁচাতে গিয়ে কসাইরা অনেক সময় চামড়া নষ্ট করে ফেলে, এদিকে সাবধান থাকতে হবে।
×