ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এপিজি বার্ষিক সম্মেলনে মূল্যায়ন প্রতিবেদন ;###;চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে অনেক উন্নত দেশ থেকেও ভাল অবস্থানে

ঝুঁকিমুক্ত দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঝুঁকিমুক্ত দেশ

এম শাহজাহান/রহিম শেখ ॥ জঙ্গী অর্থায়নে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে এসেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে তিনটিতে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। এজন্য রিজার্ভ চুরি ও গুলশান হামলার ঘটনার পর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপ (আইসিআরজে) প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জঙ্গীবাদ, মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপ এ্যাসেসমেন্ট টিম কর্তৃক প্রস্তাবিত রেটিংগুলোর মধ্যে দুটি ইমিডিয়েট আউটকামের (আইও) রেটিংয়ে উন্নত হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ নরওয়ে ও শ্রীলঙ্কা থেকে ভাল অবস্থানে। কোন কোন ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক উন্নত দেশ থেকেও ভাল অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এতে সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জঙ্গীবাদ, মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য অপরাধ নির্মূলে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, এপিজির বার্ষিক সভায় বাংলাদেশকে নিয়ে তৃতীয় পর্বের চূড়ান্ত যে প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে, তাতে মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের নেয়া ভূমিকাকে সন্তোষজনক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সানদিয়াগো শহরে এপিজি বার্ষিক সভায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪১টি দেশের মানি লন্ডারিং রেটিং দেয়া হয়েছে। এতে বাংলাদেশের ঝুঁকিতে পড়ার যে আশঙ্কা ছিল, তা কেটে গেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে তিনটিতে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। এজন্য রিজার্ভ চুরি ও গুলশান হামলার ঘটনার পর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপ (আইসিআরজে) প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকায় এপিজির বার্ষিক সভাটি বাতিল হওয়ায় কিছুটা অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও এপিজি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ এসেছে। সর্বশেষ চলতি বছর মে মাসের শুরুতে এপিজির ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিল। তখন অর্থ পাচার ও জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এপিজি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে টানা ১৬টি বৈঠক করে বিএফআইইউ। জানা গেছে, জঙ্গী অর্থায়ন নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং যে কোন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন বন্ধে প্রতিবছর এপিজির বার্ষিক সভা করা হয়ে থাকে। এবারের সভায় ৪১টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, ৮টি দেশ এবং ২৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রায় ৪০০ প্রতিনিধি অংশ নেয়ার কথা ছিল। এই সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু গুলশান হামলার পর এপিজির বার্ষিক সভাটি ২ মাস পেছানো হয়। ঢাকার পরিবর্তে ভেন্যু করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। অবশ্য ২০১৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সফরে এসে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বাস্তবায়ন খতিয়ে দেখে এপিজি যে খসড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, তাতে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচার-জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) ১৯তম বার্ষিক সম্মেলন শুরু হয়। চার দিনব্যাপী এই সম্মেলনের পর্দা নামে বৃহস্পতিবার। এতে বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এছাড়া সংস্থাটির এবারের সভায় ৪১টি সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধি, আটটি দেশ এবং ২৮টি আন্তর্জাতিক সংস্থার চার শ’ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থপাচার, জঙ্গী ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম এপিজির বৈঠকে এর সঠিক মূল্যায়ন হবে। আমরা সফল হয়েছি। জানা গেছে, এপিজি হচ্ছে ‘অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন’ বিষয়ে মানদ- নির্ধারণকারী এশিয়া অঞ্চলের সংস্থা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৪১টি দেশ এর সদস্য। এপিজি প্রতিনিধিদল সদস্যভুক্ত দেশের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ক কর্মকা-ের মূল্যায়ন করে থাকে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশকে সংস্থাটি প্রথম মূল্যায়ন করে। এরপর বাংলাদেশ নিয়ে ২০০৮ সালে এ ধরনের মূল্যায়ন করা হয়েছিল। ওই সময়ে বাংলাদেশ সন্ত্রাসী অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রমে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশকে কালো তালিকার আগের ধাপ ‘ধূসর’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তী নানা উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর সেখান থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের অক্টোবরে মূল্যায়ন করে গেছে এপিজি। ২০১৪ সালে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশকে ‘মুক্তি’ দেয়া হয়। এর আগে বাংলাদেশ ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আইসিআরজি প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে এফএটিএফ পূর্ণভাবে বাস্তবায়নকারী দেশের তালিকাভুক্ত হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতও এফএটিএফভুক্ত দেশ। প্রচলিত সাধারণ নিয়মে বিশ্বের কোন দেশ আইসিআরজি প্রক্রিয়াভুক্ত থাকলে আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সেই দেশটির এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খরচ বেড়ে যায়। এ ছাড়া বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে নেয়া ব্যবস্থা পরিবীক্ষণের জন্য এপিজির ১৯তম বার্ষিক সভায় অনুমোদিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের মানি লন্ডারিং সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ কার্যক্রম এপিজি ও এর সদস্য ৪১টি রাষ্ট্র কর্তৃক আন্তর্জাতিক মানের হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রদত্ত রেটিং অনুযায়ী আইসিআরজি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা আর নেই। সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জঙ্গীবাদ, মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপ এ্যাসেসমেন্ট টিম কর্তৃক প্রস্তাবিত রেটিংগুলোর মধ্যে দুটি ইমিডিয়েট আউটকামের (আইও) রেটিংয়ে উন্নত হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কয়েকটি সদস্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের চারটি রেটিং কমানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা সভায় বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এর ফলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ নরওয়ে ও শ্রীলঙ্কা থেকে ভাল অবস্থানে। কোন কোন ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক উন্নত দেশ থেকেও ভাল অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এতে সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জঙ্গীবাদ, মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য অপরাধ নির্মূলে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ সংক্রান্ত প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদ- নির্ধারণকারী সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্স এফএটিএফ বাংলাদেশকে এই স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত সভায় এফএটিএফের ধূসর তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের লেনদেন আর এফএটিএফের পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে না। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধ হবে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের খরচও কমবে। এই স্বীকৃতি অর্জন করাকে বড় সাফল্য হিসেবে দেখছে বর্তমান সরকার।
×