ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে নিত্য যানজট ;###;জয়দেবপুর যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টা ;###;গুরুত্বপূর্ণ দুই ফেরিঘাটে অচলাবস্থা ;###;পণ্য ও পশুবাহী গাড়ির চাপ বেড়েছে মহাসড়কে

ভোগান্তির ছয় পয়েন্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ভোগান্তির ছয় পয়েন্ট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ঈদ সামনে রেখে সড়ক-মহাসড়কের ছয় পয়েন্টে যানজটের আশঙ্কা করছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। এছাড়াও তীব্র স্রোতের কারণে ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফেরিঘাটে ভোগান্তির মাত্রা ছাড়াতে পারে এবার। যানজটপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়া, কোনাবাড়ি, চন্দ্রা, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক, ঢাকা-জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বরদারগারহাট। রোজার ঈদেও এসব পয়েন্টে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। তবুও কোন কোন পয়েন্টে যানজটের ভোগান্তি চরমে ওঠে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও মাওয়া-চরজানাজাত এই দুই ফেরিঘাটে ইতোমধ্যে পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনকে আটকে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোন না কোন পয়েন্টে প্রতিদিনই যানজট হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে এই সড়কে বেড়েছে পশু ও পণ্যবাহী পরিবহনের সংখ্যা। তাই দিন দিন যানজটের মাত্রা বাড়ছে। এছাড়া জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত আসতে বা যেতে সময় লাগছে তিন থেকে চার ঘণ্টা। অথচ জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতে সময় লাগছে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। চলতি সপ্তাহেই রাজধানী থেকে যাত্রা শুরু হবে ঘরমুখো মানুষের। তাই অল্প সময়ের মধ্যে যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈদের সময় রাজধানীর প্রবেশদ্বার ও বের হওয়ার ১৪টি পয়েন্টকে যানজটপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পয়েন্টে চলতি সপ্তাহেই নামানো হচ্ছে এক হাজার স্কাউট সদস্য। যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবেন। পাশাপাশি সড়ক-মহাসড়কে যানজট নিরসনে কাজ করবে মহানগর পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, শিল্প পুলিশসহ আনসার সদস্যরা। তবে নিরাপদ নৌসড়ক ও রেলপথ জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে যানজট নিরসন ও যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সড়ক-মহাসড়কে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়াও সংগঠনের পক্ষ থেকে ছয়দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের ঈদে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও ফেরিঘাটগুলো নিয়ে আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোতে অচলাবস্থা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোন কোন পয়েন্টে চার লেনের গাড়ি এক লেনে চলতে হয়। বাইপাসগুলো গাড়ির চাপ সামলাতে পারে না। সব মিলিয়ে কিছুটা যানজটের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য সড়কের অবস্থা ভাল। পশুবাহী গাড়ি চলাচল ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে নিষিদ্ধ হওয়ায় সড়কে খুব বেশি যানজট নাও হতে পারে। একমাস ধরে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার ফেরিঘাটে অচলাবস্থা ॥ তীব্র স্রোত ও ভাঙ্গনের কারণে দৌলতদিয়ার চারটি ফেরিঘাটের তিনটিই বন্ধ রয়েছে। তিন নম্বর ঘাটের একটি পকেট দিয়ে আংশিক ফেরি চলাচল করছে। বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, নদীতে স্রোত ও ভাঙ্গনের কারণে চারটি ঘাটের মধ্যে এক ও চার নম্বর ঘাটের মেরামতের কাজ চলছে। এক নম্বর ঘাটটি নদীতে বিলীন হওয়ায় একমাস বন্ধ রয়েছে। শুধু তিন নম্বর ঘাটের একটি পকেট সচল রয়েছে। তিনি আরও জানান, দৌলতদিয়া ঘাটে পারের অপেক্ষায় আড়াই শ’ পণ্যবাহী ট্রাক ও তিন শতাধিক গাড়ি। এ নৌরুটে সীমিত ট্রিপের ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। অপরদিকে বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানান, এ ঘাটে দুই শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ও চার শতাধিক গাড়ি পারের অপেক্ষায়। বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবদুল মোতালেব জনকণ্ঠকে বলেন, তীব্র স্রোতের কারণে এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফেরিঘাটে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে সড়কে বেড়েছে পরিবহনের চাপ। পশুবাহী শত শত পরিবহন এখন ঢাকামুখী। কিন্তু ফেরিঘাটগুলোতে এসে পরিবহনগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি ফেরিঘাট পরিদর্শন করে এসেছি। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও মাওয়া-চরজানাজাত ফেরিঘাটে এখন রীতিমতো অচলাবস্থা। কোন রকমে একটি ফেরি যানবাহন পারাপারে নিয়োজিত। তীব্র স্রোতে সব ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অবস্থার উন্নতি না হলে ঈদে ঘরমুখো মানুষ ও পণ্যবাহী পরিবহন পারাপারে ভোগান্তির মাত্রা ছাড়াবে। তিনি বলেন, সড়কপথে ঈদ সামনে রেখে চন্দ্রা, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রতিদিন যানজট হচ্ছে। ঈদ যত কাছে আসবে তত গাড়ির চাপ বাড়বে। বাড়বে ভোগান্তির মাত্রা। তাই এসব পয়েন্টে যানজট রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বরদারগারহাট পয়েন্টে ঈদ পর্যন্ত যানজট রোধে ওয়েস্কেলের কার্যক্রম বন্ধ রাখার দাবি জানান তিনি। ঈদের দুই দিন আগে থেকে আমদানি-রফতানিযোগ্য পণ্য ও কাঁচামাল ছাড়া অন্যান্য পণ্য পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্তের কথাও জানান এই পরিবহন নেতা। বড় সমস্যা আশুলিয়া ও কোনাবাড়ি ॥ পরিবহন মালিক, শ্রমিক থেকে শুরু করে চালকরা বলছেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের ২১টির বেশি জেলার দূরপাল্লার পরিবহন আশুলিয়া ও কোনাবাড়ি হয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচল করে। এরমধ্যে যানজটের বিষফোঁড়াখ্যাত এই দুই পয়েন্ট। ঈদের আগে থেকেই এসব পয়েন্টে এখন নিয়মিত যানজট হচ্ছে। রোজার ঈদে এসব পয়েন্টে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভোগান্তি হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বিশেষ পদক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসে। এই দুই পয়েন্টের সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, কোনাবাড়ির কাশিমপুর কারাগার এলাকায় রাস্তার ওপর উড়াল সড়কের কাজ চলছে। এতে সিঙ্গেল লেনে গাড়িগুলোকে চলতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রকল্পের নির্মাণ সামগ্রীসহ মাটি রাখা হয়েছে রাস্তার ওপর। এতে সমস্যা আরও বেড়েছে। ঈদ উপলক্ষে সড়কে চাপ বেড়েছে গাড়ির। ফলে প্রায় প্রতিদিনই এই পয়েন্টে কমবেশি যানজট হচ্ছে। তিনি ঈদ উপলক্ষে উড়াল সড়কের কাজ বন্ধ রাখার দাবি জানান। এছাড়াও আশুলিয়া এলাকায় রাস্তার দু’পাশে অবৈধ স্থাপনা এখন উচ্ছেদ না করার অভিযোগ করে তিনি বলেন, এসব স্থাপনার কারণে রাস্তার পরিধি বড় করা সম্ভব হচ্ছে না। সড়ক ঘেঁষে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাস কাউন্টার, ভাসমান দোকান বসছে নিয়মিত। ফলে একটি গাড়ি অন্য গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে কাদামাটিতে বসে যাচ্ছে। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় গোটা এলাকা। ঈদের আগে এই এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, রাস্তাটি দিয়ে পরিবহনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলতে না পারলে ঈদ সামনে রেখে সঙ্কট আরও বাড়বে। এক মাসের বেশি সময় ধরে ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডের কোন কোন স্থানে নিয়মিত যানজট হওয়ার কথাও জানান তিনি। ফেরিঘাট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় ঘাটগুলোতে সমস্যা হয়েছে। স্রোতের বিপরীতে ফেরি চলতে সমস্যা হচ্ছে। এজন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ সময় লাগছে যানবাহন পারাপারে। জয়দেবপুর থেকে ঢাকা তিন ঘণ্টা ॥ জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ফোর লেন মহাসড়ক উদ্বোধনের পর থেকে এটুকু রাস্তা যেতে সময় লাগে এক থেকে সোয়া এক ঘণ্টা। কিন্তু জয়দেবপুর থেকে মহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ২০কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লাগে কখনও কখনও তিন থেকে চার ঘণ্টা। এমন তথ্য জানালেন এই রুটের বাসচালকসহ পরিবহন নেতারা। কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর আসে হাজারো সঙ্কট আর সমস্যা নিয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে চলা এনা, সৌখিন, শামীম পরিবহনের একাধিক চালক জানিয়েছেন, টঙ্গি ব্রিজ পর্যন্ত বাড়তি গাড়ির চাপ। এরপর রাস্তার দু’পাশে টার্মিনাল, বাজার, অবৈধ পার্কিং, ভাসমান দোকানের শেষ নেই। কোন কারণ ছাড়াই পণ্যবাহী পরিবহন রাখা হয় সড়কের দু’প্রান্তে। সরু রাস্তায় বাড়তি গাড়ির চাপ সামলাতেই যানজট হচ্ছে। এছাড়া ভোগড়া বাইপাস যানজটের বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন এই পয়েন্টে সিগন্যালের কারণে দীর্ঘ যানজট হয়। জয়দেবপুর চৌরাস্তায় বড় সমস্যা হলো সড়কের দু’পাশে দখল, বাজার। তারপর সিটি সার্ভিসগুলোর বেশ কয়েকটি এই পয়েন্টে যাত্রী ওঠানামা করে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার দৃশ্য নিয়মিত। পাশাপাাশি টাঙ্গাইলসহ আশপাশের দূরত্বে চলা বাস, লেগুনা সড়কে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। ছোট ছোট বিভিন্ন পরিবহনের অবৈধ টার্মিনালও হয়েছে চৌরাস্তায়। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় সীমাহীন ভোগান্তি। এই সঙ্কট মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন রুটের যাত্রী ও পরিবহন চালকদের।
×