ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কূটনৈতিকপত্র হস্তান্তর;###;‘মীর কাশেমের ফাঁসির প্রশ্নে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া জানানো সম্পূর্ণ কূটনৈতিক শিষ্টাচার-বহির্ভূত ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’

নাক গলাবেন না

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নাক গলাবেন না

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়ার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে কারণে বাংলাদেশের এই একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করা হয়েছে পাকিস্তানকে। দেশটির এই আচরণকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি বড় আঘাত বলেও অভিহিত করেছে বাংলাদেশ। রবিবার ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই বার্তা দেয়া হয়। যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে গভীর মর্মাহত হয়েছে বলে জানায় দেশটি। এছাড়া এই বিচারকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়ার প্রতিবাদে রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করে নিয়ে আসা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুল আহসান ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবের নিকট একটি কূটনৈতিক পত্র তুলে দেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনু বিভাগের মহাপরিচালক মনোয়ার হোসেন। পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলবের পরে কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেন, মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- নিয়ে পাকিস্তান যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, সেটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এ বিচার খুবই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। মীর কাশেম আলীর আপীল করার সুযোগ ছিল। আপীলের সুযোগও তিনি নিয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালত মনে করেছে, তিনি ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী যে অপরাধ করেছেন, এটাই তার উপযুক্ত শাস্তি। মানবতা?বিরোধী অপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই এ নিয়ে পাকিস্তানের মতামত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। শনিবার রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরপরই বিবৃতি দিয়ে এক প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাকিস্তানের বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে রবিবার তলব করে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলবের বিষয়ে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-ের ঘটনায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটা বাংলাদেশ সরকারের নিকট আকৃষ্ট হয়েছে। সে কারণে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাকে তলবের পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুল আহসান একটি কূটনৈতিক পত্র হস্তান্তর করেছেন। এতে আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার করতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪৫ বছর পরেও যে গণহত্যার বিচার হয়নি, সেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিও রুখে দিতে চায় বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী এই বিচার প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মানবতাধিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার নিয়ে পাকিস্তান ক্রমাগতভাবে যেভাবে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালাচ্ছে, তা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি একটি বড় ধরনের আঘাত। কূটনৈতিক পত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে দমনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে চলেছে। তবে বাংলাদেশ এই অভিযোগ কড়াকড়িভাবে নাকচ করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এই বিচার প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গতভাবে হয়, সে বিষয়ে সচেষ্ট বাংলাদেশ সরকার। আইন অনুযায়ী অনুযায়ী মীর কাশেম আলীরও বিচার হয়েছে, তার বিচারে রাজনৈতিক পরিচয়েরও কোন প্রভাব পড়েনি। পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের নিকট দেয়া পত্রে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মীর কাশেম আলী ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ছিলেন। আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গণহত্যায় জড়িত ছিল। একই সঙ্গে এই বাহিনীর সদস্যরা গণহত্যায় পাকিস্তানী বাহিনীকেও সহায়তা করে। এই বাহিনীর সদস্যরা সে সময়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী নিধনেও জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে পাকিস্তান এ কথা উল্লেখ করে বলা হয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করা হয়েছিল। তবে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির কোথাও বলা হয়নি, যেসব যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশের নাগরিক, তাদের বিচার করা যাবে না। সূত্র জানায়, ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শীতল সম্পর্ক চলে আসলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এর আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে বাংলাদেশ। সে সময়ও পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। সে সময় ঢাকার পাক হাইকমিশনারকে তলবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত বছর ডিসেম্বরে ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টা তলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে বহিষ্কার করা হয়। ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ। তারই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের বিচার ঘিরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। এই প্রেক্ষিতে দুই দেশের কূটনীতিককে তলব পাল্টাতলব ও বহিষ্কার পাল্টাবহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। তবে পাকিস্তানই বারবার দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত করে চলেছে। এদিকে যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকর করায় ইসলামাবাদ গভীরভাবে মর্মাহত। মীর কাশেমের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে পাকিস্তানের বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের আগে সংঘটিত কথিত অপরাধের অভিযোগে ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়ায় মীর কাশেমের মৃত্যুদ- কার্যকর করায় পাকিস্তান গভীরভাবে মর্মাহত। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়, ত্রুটিপূর্ণ বিচারের মাধ্যমে বিরোধীদের দমন গণতান্ত্রিক চেতনার পুরোপুরি পরিপন্থী। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর থেকেই কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, মানবাধিকার গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ বিচারের কার্যক্রম, বিশেষ করে এর নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবী ও সাক্ষীদের নানাভাবে হয়রানির খবরের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অংশ হিসেবে ক্ষমাশীলতার পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে না নিতে রাজি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে সেই অঙ্গীকার সমুন্নত রাখা উচিত। উল্লেখ্য, সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল থাকায় ১৯৭১ সালের আল বদর নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাশেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার যোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গণহত্যায় সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী শনিবার রাতে মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। তুরস্কের দুঃখ প্রকাশ স্টাফ রিপোর্টার ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় পরিষদ সদস্য মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকর করায় দুঃখ প্রকাশ করেছে তুরস্ক। রবিবার এক বিবৃতিতে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় পরিষদের সদস্য মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকরের খবরে আমরা দুঃখিত। বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা আবার বলতে চাই, এ ধরনের কার্যকলাপের মাধ্যমে অতীতের ক্ষতে প্রলেপ দেয়া যাবে না এবং আমরা আশা করি, এ ধরনের ভুল পদক্ষেপ ভ্রাতৃপ্রতীম বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবে না।
×