ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সিন্ডিকেটের কারসাজি, চরম অস্বস্তিতে জনগণ

দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দ্রব্যমূল্য বেড়েই চলেছে

এম শাহজাহান ॥ ঘরে চাল না থাকলেও আগে চিনি কিনতে হয় গৃহকর্ত্রী রাশেদা খানমের। তার আদরের ছোট্ট মুমুর সব ধরনের খাবার তৈরিতে প্রয়োজন হবে এই চিনির। সকালের নাস্তা শেষ না হতেই স্বামীর জন্য তৈরি করতে হবে চা। এই চা বানাতেও চিনি লাগবে সবার আগে। এই যখন অবস্থা, তখন এই পণ্যটির দাম দ্বিগুণ বেড়ে আর কমছে না। বরং এক টাকা দু’টাকা করে প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে দাম। চিনির দাম যখন বাড়ছে তখন স্বস্তি নেই তেতোতেও। কারণ, তেতোর প্রধান উপকরণ লবণ বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ দামে। শুধু তাই নয়-চাল, ডাল, ভোজ্যতেল এবং পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন রাশেদা খানমের মতো দেশের কোটি কোটি ভোক্তা। কোরবানি সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের মসলার দামও বেড়ে গেছে ইতোমধ্যে। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে অস্বস্তি বিরাজ করছে সব শ্রেণীর ক্রেতাদের মধ্যে। ভোক্তাদের জিজ্ঞাসা-আন্তর্জাতিক বাজারে যখন মূল্য কমছে তখন কেন বাংলাদেশে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে? তবে এসব প্রশ্নের সঠিক কোন উত্তর নেই সংশ্লিষ্টদের। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এসব সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজি, জিম্মি হয়ে পড়ছে প্রশাসন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট চক্র কি তাহলে সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্বল বাজার মনিটরিং, প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হলেও তা কার্যকর না হওয়া, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে যে আইন রয়েছে তা প্রয়োগ না হওয়া, ভ্রাম্যমাণ আদালত নিষ্ক্রিয় থাকা এবং পণ্যমূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং টিম শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা টিসিবিকে শক্তিশালী করার পরামর্শ রয়েছে তাদের। এদিকে, ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি’র তথ্যমতে, গত এক বছরে চিনির দাম বেড়েছে ৭০ শতাংশ এবং ৪৭ শতাংশ বেড়েছে ভোজ্য লবণের দাম। আর ওই সময়ে জাত ও মানভেদে ৭ থেকে ২৮ শতাংশ বেড়েছে ডালের দাম, ভোজ্যতেল ৮ শতাংশ এবং জাত ও মানভেদে চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত। কোরবানি সামনে রেখে পেঁয়াজের দাম এখন বাড়লেও সারাবছর দাম নিয়ে তেমন কোন হৈ-চৈ পড়েনি। বরং গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম ৫৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে রসুনের দাম বেড়েছে ৮৩ শতাংশ পর্যন্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, এটা সত্য যে, সরকারী পলিসির কারণে গত এক বছরে চিনির দাম বেশ বেড়ে গেছে। যদিও মূল্য এত বাড়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে বাজারে কিছু কারসাজি করা হতে পারে। কেন দাম বেড়ে চিনির দাম আর কমছে না তা অনুসন্ধান করা হচ্ছে। লবণের দাম বাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পণ্যটির দাম কমে আসবে। চাহিদার ঘাটতি পূরণে দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ ও ডালের দাম এখনও মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম যাতে আর না বাড়ে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। জানা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ট্যারিফ কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। কোরবানি ঈদের আগে বাজার মনিটরিং কমিটির তদারকি বাড়ানোসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম বাড়ানো হবে। ইতোমধ্যে ভোজ্যতেল, চিনির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুই পণ্যের দাম কত হওয়া উচিত, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন থেকে প্রতিবেদন নিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। উভয় পণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি মূল্য, পরিশোধন ব্যয় এবং সরকারের শুল্ক-করাদিসহ উৎপাদন খরচ হিসাব করে ট্যারিফ কমিশন দেখিয়েছে, রিফাইনারিগুলো অযৌক্তিক হারে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের অন্য সংস্থাগুলোও একই মত দিয়েছে। জানা গেছে, গত রমজানে রিফাইনারিগুলো হঠাৎ তেল ও চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আগাম কোন আলোচনা করেননি মিল মালিকরা। দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা দ্বিগুণ করার তথ্য তুলে ধরে ট্যারিফ কমিশনে একটি আবেদন পাঠিয়েছেন মিল মালিকরা। তাতে নিজেদের মুনাফাও দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়। আবার পণ্যের দাম যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সে জন্য চিনির ওপর আরোপিত ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারেরও দাবি করেছেন তারা। অবশ্য বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের বিরোধিতা করে বলেছে, রিফাইনারিগুলো কম দামে আমদানি করা চিনি অধিক মুনাফায় অযৌক্তিকভাবে বেশি দরে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। ভোজ্যতেল ও চিনির রিফাইনারিগুলো আগে ১ শতাংশ মুনাফা ধরে পণ্যের দাম নির্ধারণ করত। এখন তা ২ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে। কেজিপ্রতি পণ্যের দাম নির্ধারণে পরিবেশকদের মুনাফা দুই টাকা থেকে চার টাকা এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা দুই টাকা থেকে চার টাকা করার প্রস্তাব করেছে। চিনি ভোজ্যতেল ও লবণের দাম বেশি নেয়া হচ্ছে ॥ পণ্যের দর ও জাহাজ ভাড়া মিলিয়ে এক কেজি চিনির উৎপাদন খরচ পড়ে ৪৬ টাকা। গত জুনে ইউনাইটেড সুগার মিলস অপরিশোধিত চিনি আমদানি করেছে প্রতিটন ৩২০ ডলার দরে। এসব দরে আমদানি করা চিনি বর্তমানে দেশের বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে। অথচ আমদানি ব্যয়, পরিশোধন খরচ এবং সরকারের শুল্ককর ও ভ্যাট পরিশোধসহ প্রতিকেজি চিনিতে খরচ পড়ে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। প্রতিকেজিতে পাইকারি ব্যবসায়ী বা পরিবেশক এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের দুই ও তিন টাকা করে লাভ ধরলে কেজিপ্রতি দর হওয়ার কথা ৫৫ থেকে ৫৭ টাকার মধ্যে। কিন্তু কারসাজি করে সেই চিনি এখন বিক্রি করা হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। এ নিয়ে দ্রব্যমূল সংক্রান্ত এক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মৌলবীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও চিনি ব্যবসায়ী হাজী মোঃ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, মিলমালিকদের কারণে চিনির দাম কমছে না। এছাড়া অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত চিনির শুল্কহার সমন্বয় করা হলে চিনির দাম কমে আসবে। এদিকে, গত মাসের শেষের দিকে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে দুই থেকে চার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে এ কাজ করেছেন তারা। সরকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত শুক্রবার প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৯৪ থেকে ৯৮ টাকা। এছাড়া সয়াবিন তেল লুজ প্রতিলিটার ৮২-৮৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে ভোজ্যতেলের এই মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে, টিসিবির তথ্যমতে, বাজারে প্রতিকেজি পরিশোধিত লবণের দাম এখন ২৫ টাকা থেকে ৩৮ টাকা পর্যন্ত। গত বছর এই সময়ে প্রতিকেজি লবণের দাম ছিল ১৫ থেকে ২৮ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে লবণের দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। এ অবস্থায় দেশের বাজারে কাঁচা লবণের দাম বাড়ার কারণে খাবার লবণের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। ঘাটতি লবণের চাহিদা মেটাতে জরুরী ভিত্তিতে দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৭৫ হাজার মে. টন শিল্প লবণ এবং বাকি ৭৫ হাজার মে.টন ভোজ্য লবণ হিসেবে আমদানি হবে। যদিও লবণ আমদানিতে শিল্প ও ভোজ্য লবণ হিসেবে কোটা সৃষ্টি করায় দাম বাড়াতে সিন্ডিকেট চক্র কারসাজি করতে পারে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসের ব্যবধানে মসুর ডালের দাম ৩৫ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি মসুর ডালের দাম ছিল ৫০ হাজার ৪৪০ টাকা। গত মাসের এই দিনে টনপ্রতি মসুর ডালের আন্তর্জাতিক দর ছিল ৭৭ হাজার ৯০৭ টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দর কমেছে ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর গত এক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দর কমেছে ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে গত এক মাসে দাম এক টাকাও কমেনি। বছরওয়ারি হিসাব করলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ২৪ শতাংশ দরপতন হলেও দেশের ভেতরে দাম বেড়েছে প্রায় ৭ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া কোরবানি ঈদ সামনে রেখে ইতোমধ্যে পেঁয়াজসহ মসলা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যদিও গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম হ্রাস পেয়েছে। বর্তমান প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫-৪৫ টাকা। এছাড়া চালের দাম সামান্য বাড়লেও বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। গরিব ও সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
×