ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ মুহিতুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ মুহিতুল ইসলাম

মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়ে থাকে। কথাটির সত্যতা ও যথার্থতার প্রমাণ পৃথিবীতে অনেক আছে। বরং কথাটি অসার প্রমাণে মাঝে-মধ্যে অনেকে পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায়। তবে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্ববোধ, মহানুভবতা ও খাঁটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ প্রচণ্ড দৃঢ়চেতা ব্যতিক্রমধর্মী কিছু মানুষও সমাজে দেখা যায়। এমনই একজন মানুষ এদেশের আপামর জনসাধারণের হৃদয় ব্যথিত করে চিরতরে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। তিনি নিষ্ঠাবান, সহজ-সরল ও সততার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মুহিতুল ইসলাম। গত ২৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার ২টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। কিডনি জটিলতা ও ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে তিনি গত ১১ জুলাই বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। নেফ্রোলজি বিভাগের ডাক্তার অধ্যাপক রফিকুল আলমের তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তাঁর রিসেপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ ছিলেন মুহিতুল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘৃণ্য ঘাতকরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন পরিবারের অনেক সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তখন মুহিত ধানম-ির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বাড়িটিতেই ছিলেন। ঐ (১৯৭৫) বছরই ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট বাংলার মীরজাফর খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষা করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। তারপরও ১৯৭৬ সালের ২২ অক্টোবর নিজের বিপদের কথা চিন্তা না করে অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে ঐ জঘন্য হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিলেন লালবাগ থানায়। পরে মুহিতুল বলেছেন, ‘বিবেকের তাড়নায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। থানার ডিউটি অফিসার মামলা না নিয়ে উল্টো চড়-থাপ্পড় মেরে আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন।’ ডিউটি অফিসার বলেছিলেন, ‘তুইও মরবি আমাদেরও মারবি’। সেই ডিউটি অফিসার মহোদয়ের ডাবল প্রমোশন হয়েছিল কিনা তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে মার খেয়ে থানা থেকে বের হয়ে আসতে হলেও মনের ভেতরে তোলপাড় করা পুঞ্জীভূত বেদনা কোনদিনই মুছে ফেলেননি মুহিত। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন- একদিন না একদিন মামলা করবই। সে সুযোগও পেয়েছিলেন নির্লোভ-নির্মোহ কর্তব্যপরায়ণ এই মানুষটি। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মামলা করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। তিনি এবার ধানম-ি থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার আইনী প্রক্রিয়া। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আরোহণ করলে বদলে যায় দৃশ্যপট। থেমে যায় বিচার প্রক্রিয়া। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে বিচার শুরু হয় এবং খুনীদের বিচার শেষ হয়। ঘাতকদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে জেনে মুহিত সেদিন স্বর্গীয় আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। মুহিত ছিলেন ১৫ আগস্টের সেই কালরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতে। তার চোখের সামনেই ঘটে হত্যাকা-। মুহিতুল সেদিন ঘাতকদের কবল থেকে রাসেলকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। মাত্র নয় বছরের নিষ্পাপ ছোট্ট রাসেলকে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা মুহিতুলকে সবচেয়ে বেশি ব্যথিত করেছিল। সে যন্ত্রণাবোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। ইতিহাসের ঐ জঘন্যতম দিনটিতে রাসেল মুহিতকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো?’ রাসেল কাঁদছিল। এক পর্যায়ে সে মায়ের কাছে যাওয়ার কথাও বলেছিল। মুহিতুলের কাছেও মনে হয়েছিল ঘাতকরা হয়ত এই ছোট্ট শিশুটিকে মারবে না। সেজন্যই রাসেলকে মারবে না বলে মুহিত তাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিল। না, ঘাতকরা সেদিন এসেছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। নরপিশাচরা রাসেলকে মুহিতের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। শিশু রাসেলকে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতা মুহিতের বুকের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি করেছিল। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সে ব্যথা ভুলতে পারেননি। তবে মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে সেদিন বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা- আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচ ঘাতকের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। দ-িত বেশ কয়েকজন এখনও পলাতক। ১৯৯৮ সালের বিচারিক আদালত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদ- প্রদান করে। রায়ের বিরুদ্ধে আপীল হলে প্রথমে বিভক্ত রায় দিলে পরে তৃতীয় বেঞ্চে ১২ জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখে। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ আসামি সুপ্রীমকোর্টে আপীল করে। বিচার প্রক্রিয়া শেষে পাঁচ আসামির মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। ১৫ আগস্ট ধানম-ির ৩২ নম্বরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর সেদিনই মুহিতুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আটক অবস্থায়ই তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের একজন কর্মচারীর সহায়তায় তিনি সেখান থেকে পালাতেও সক্ষম হয়েছিলেন। সোজা গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আবার গ্রেফতার করে ঢাকায় এনে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা করার পর থেকে পুলিশের পাহারায় থাকলেও ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তা তুলে নেয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এবং পরে ২০০১ সালের পরও তাকে নানা রকম অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়েছে। আমি এই সোনার মানুষটির বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×