ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি নিখুঁত চারা রোপণ ফলন বেশি

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩০ আগস্ট ২০১৬

আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি নিখুঁত চারা রোপণ ফলন বেশি

এমএ রকিব ॥ কৃষকের লাঙল-জোয়াল বাঙালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যের অংশ। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চাষাবাদের ইতিহাস। চিরায়ত বাংলার রূপের সন্ধান করতে গেলে কৃষিকাজের এই দুই উপকরণের কথা যেমন আসবে, তেমনিই আসবে হালের বলদের কথাও। সভ্যতার ক্রমবিকাশের হাত ধরে যন্ত্রনির্ভর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় আজ উপেক্ষিত হচ্ছে সেই লাঙল-জোয়াল, বাঁশের তৈরি মই আর হালের বলদ বা গরু। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দেশে এখন কৃষকের আবাদি মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ও ধানের চারা রোপণের নতুন প্রযুক্তি ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ মেশিনসহ চাষাবাদের নানা যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রের ব্যবহারে একদিকে যেমন সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় হচ্ছে; তেমনই পাওয়া যাচ্ছে অধিক ফলন। বর্তমান সরকারও কৃষিক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনতে সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপ’। সরকারের দীর্ঘমেয়াদী এই মহাকর্মপরিকল্পনায় তিন ধাপে ২০৪১ সাল পর্যন্ত কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিভিন্ন টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণের জন্য ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের পর এবার দেশের কৃষকের হাতে ধানের চারা রোপণের আধুনিক প্রযুক্তি ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর মাঠ দিবস ও কৃষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশব্যাপী চালাচ্ছে যন্ত্রটির প্রদর্শনী এবং উদ্বুদ্ধ ও সচেতন করে তোলা হচ্ছে কৃষকদের। যাতে কৃষকরা পাওয়ার টিলারের মতো এ যন্ত্রটিরও ব্যবহার শুরু করেন। ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ সময়, অর্থ ও শ্রম সাশ্রয়ী এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ টেকসই একটি কৃষি প্রযুক্তি। এ যন্ত্রের সাহায্যে কম খরচে, কম সময়ে ও স্বল্প পরিশ্রমে এবং সারি করে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর নিখুঁতভাবে ধানের চারা রোপণ করা যায়। এমনকি শ্রমিকের হাতে লাগানো সম্ভব নয়, এমন অল্প বয়সী চারাও এ যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণ করা যায়। আবার একই সঙ্গে ১টি বা ২টি চারাও রোপণ করা যায় এ যন্ত্র দিয়ে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সেলিম হোসেন জানান, বর্তমানে শ্রমিক দিয়ে এক বিঘা জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে কৃষকের যেখানে খরচ হয় ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা এবং ৪-৫ জন শ্রমিকের সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। সেখানে পেট্রোলচালিত রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রে এক বিঘা জমিতে চারা রোপণ করতে ২শ’ ৫০ থেকে ৩শ’ টাকা খরচ হয় এবং সময় লাগে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ মিনিট। তিনি জানান, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রের সাহায্যে লাগানো ধানের ফলন অন্যান্য প্লটের ফলনের চেয়ে বেশ ভাল। এর অন্যতম কারণ, এই যন্ত্রের মাধ্যমে রোপিত ধানক্ষেতে কুশির সংখ্যা অন্যান্য ক্ষেতের চেয়ে বেশি হয়। এ বিষয়ে কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, দিন দিন কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বেড়ে গেছে শ্রমিকের মজুরি। এ পরিস্থিতিতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি জানান, যান্ত্রিকীকরণ হলে কৃষি ফলন অন্তত ১০% বৃদ্ধি পাবে। ধানের চারার বয়স ঠিক রেখে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’ যন্ত্রের সাহায্যে চারা রোপণ করা হলে তাতে কার্যকরী কুশির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে পরিচর্চা খরচ কমে যাবে এবং ফলনও বৃদ্ধি পাবে। সূত্র জানায়, সারাদেশে উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে ৩০% সরকারী ভর্তুকিতে কৃষকরা যন্ত্রটি ক্রয় করতে পারবেন। দুই ধরনের এ যন্ত্রের মূল্য ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। এ যন্ত্রে ব্যবহারের জন্য বীজতলা তৈরি করতে ট্রে’র ওপর দুই থেকে আড়াই সেন্টিমিটার মাটির স্তর তৈরি করে সেখানে অঙ্কুরিত বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। প্রতিটি ট্রেতে বপনের জন্য বীজ লাগে ১শ’ ৩০ থেকে দেড় শ’ গ্রাম। চারার বয়স ১৫ থেকে ২০ দিন হলে সেগুলো রাইস ট্রান্সপ্লান্টার যন্ত্রে ব্যবহার উপযুক্ত হয়। গত ২১ আগস্ট মাঠ দিবসে কথা হয় ১২ বিঘা জমির মালিক কুষ্টিয়া সদর উপজেলার উজানগ্রাম ইউনিয়নের মাধবপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক তালেব আলী ম-লের (৭০) সঙ্গে। তিনি বলেন, জীবনের অনেকটা সময় তার কেটে গেছে লাঙল-জোয়াল আর বলদের সঙ্গে। বাপ-দাদাকেও তিনি দেখেছেন গরু দিয়ে হালচাষ করতে আর শ্রমিকের হাত দিয়ে ধানের চারা লাগাতে। কিন্তু বর্তমানে যান্ত্রিকতায় দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। তিনি বলেন, এতদিন দেখে আসছি ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করতে। আর এখন দেখছি ধানের চারা লাগানোর নতুন যন্ত্র (রাইস ট্রান্সপ্লান্টার)। গরু দিয়ে হালচাষের কদর একেবারেই কমে গেছে জানিয়ে কৃষক তালেব আলী বলেন, কম সময়ে বেশি জমিতে চাষ দিতে সক্ষম হওয়ায় জমির মালিকরা এখন পাওয়ার টিলার দিয়েই জমি চাষ করাচ্ছেন। বর্তমানে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে অনেক সাফল্য এনে দিয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, যান্ত্রিক পদ্ধতিতে হালচাষে সময় কম লাগে। এছাড়া অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন হয় না। জানা গেছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ রোডম্যাপে সরকারের তিন ধাপে ২০৪১ সাল পর্যন্ত মহাকর্মপরিকল্পনায় রয়েছেÑ ২০২১ সালের মধ্যে শস্য রোপণে ২০ শতাংশ পর্যন্ত যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ। রোপণ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার হলেও ২০৪১ সালের মধ্যে তা ৮০ শতাংশে উন্নীত।
×