ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাইব্যুনাল সরানো যাবে না ॥ আট সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৮ আগস্ট ২০১৬

ট্রাইব্যুনাল সরানো যাবে না ॥ আট সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালটি পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে সরানো যাবে না। ট্রাইব্যুনাল ওখানেই থাকবে এবং অবশিষ্ট যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধী আছে তাদের বিচার হবে। ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। এ সময়ের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল সরানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আটটি সংগঠনের পক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান আইসিটি ভবনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন জড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গের যে ভবনে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম বিচার হয়েছিল সেই ‘প্যালেস অব জাস্টিস’ পরে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে, যা উত্তর প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে না নাৎসি নৃশংসতার কথা। গণহত্যার বিচারের অন্যতম উদ্দেশ্যে হচ্ছে ভবিষ্যত গণহত্যা নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি গণহত্যা জাদুঘরে রূপান্তরিত করা। এই উদ্দেশ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০০৯ সালে লেখা চিঠিতে আমরা বলেছিলাম এই ভবনকে ভবিষ্যতে ’৭১-এর গণহত্যা এবং বিচারের জাদুঘর ও আর্কাইভ হিসেবে দেখতে চাই। ট্রাইব্যুনাল না সরানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন আপনার প্রতি আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার এবং এই বিচারিক ভবন কেন্দ্র করে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং বিচারবঞ্চিত সমগ্র জাতির আশা অনুভূতি ও স্বপ্ন পদদলিত করবেন না। শাহরিয়ার কবির সংবাদ সম্মেলনে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে ৭ দফা দাবি তুলে ধরে বলেন, আপনি গণহত্যাকারী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা চলাকালে তার এক আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করেছেন এবং কথা বলেছেন, যা আপনি স্বীকারও করেছেন। এ বিষয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ করলে আপনি এই পত্রিকাকে শাস্তি দিয়েছেন। যা আমাদের বিবেচনায় ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। যেহেতু অভিযোগ ছিল আপনার বিরুদ্ধে, জনকণ্ঠের মামলায় আপনার এজলাসে না থাকা ছিল বাঞ্ছনীয়, কিন্তু তা হয়নি। ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধীদের চলমান মামলার আপীল ও রিভিউয়ের শুনানিতে কিছু মন্তব্য ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের উৎসাহিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের বিচারের মান ক্ষুণœ করেছে। তিনি আরও বলেন, গণহত্যাকারী কামারুজ্জামানের মামলার শুনানির এক পর্যায়ে প্রকাশ্য আদালতে প্রধান বিচারপতির আসনে বসে স্বীকার করেছেন ’৭১-এর অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন। একাত্তরে শান্তি কমিটি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিস লীগ, যে দলের নেতাদের ’৭১-এর গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আপনার আদালতে বিচার হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আপীলের রিভিউর কোন বিধান না থাকলেও আপনারা আপনাদের ক্ষমতাবলে অভিযুক্তদের রিভিউয়ের সুযোগ দিয়েছেন। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের বিচারের মান বৃদ্ধি করলেও রিভিউর নামে গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদ- মাসের পর মাস বিলম্বিত হওয়ায় ৩০ লাখ শহীদ পরিবারসহ বিচারপ্রত্যাশী গোটা জাতি হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এ বিচার চলাকালে শহীদ পরিবারের বহু সদস্য গণহত্যাকারীদের শাস্তি না দেখে মৃত্যুবরণ করেছেন, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত বেদনাবহ। শনিবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শ্রম এ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি সামছুল হুদা, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাসিনী, উদীচীর সভাপতি কামাল লোহানী, প্রজন্ম ’৭১-এর তৌহিদ রেজা নুর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক ওসমান গনি, মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবিব, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, সাংস্কৃতিক জোটের হাসান আরিফ, মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম ও কাজী মুকুল। শাহরিয়ার কবির সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে থেকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ হয়েছে। প্রথমেই আমরা হোঁচট খেয়েছিলাম যখন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজনকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী জামায়াতীদের সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। এর পর ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ট্রাইব্যুনালের স্থান হিসেবে যখন আইন মন্ত্রণালয় আব্দুল গনি রোডের এক টিনের ছাপড়া নির্বাচন করে তখনও আমরা প্রতিবাদ করেছি। আইন মন্ত্রণালয়কে আমরা ২০০৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম রাজধানীর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবনে এই ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা প্রয়োজন। এবং আমরা নির্দিষ্টভাবে পুরনো হাইকোর্ট ভবনের কথা বলেছিলাম। আইন মন্ত্রণালয় আমাদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করলে আমরা ২০০৯ এর ১০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে এই বিচারের জন্য কেন পুরনো হাইকোর্ট ভবন প্রয়োজন তা উল্লেখ করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদের অনুরোধে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনে ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের ঐতিহাসিক বিচার কার্যক্রম আরম্ভ হয়। শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, আমরা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম বহুল আলোচিত মীর কাশেম আলীর মামলা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো গত ১৮ আগস্ট সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে চিঠি দিয়েছে আগামী ৩১ অক্টোবরের ভেতর পুরনো হাইকোর্ট ভবন ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার নির্দেশিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ে বরাদ্দকৃত এই ঐতিহাসিক ট্রাইব্যুনাল আড়াই মাসের কম সময়ের ভেতর সরিয়ে নেয়ার যে নোটিস জারি করেছেন তাতে মনে হতে পারে এটি সুপ্রীমকোর্টের অধীন অন্যান্য সাধারণ ট্রাইব্যুনালের মতো। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সুপ্রীমকোর্টের স্থান সংকুলানের জন্য আরও বহু জায়গা আছে, সেখানে ভবন সম্প্রসারিত হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের মামলার সংখ্যা যত বাড়ছে একাত্তরের গণহত্যার ভয়াবহতা নতুন নতুন মাত্রায় দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। যখন ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা ও সচলতা আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন তখন নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা যেমন উল্লসিত হবে একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার ও ভুক্তভোগীদের চার দশকের অধিক সময়ের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আরও বৃদ্ধি করবে। তিনি প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলেন, আপনার প্রতি আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার এবং এই বিচারিক ভবন কেন্দ্র করে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং বিচার বঞ্চিত সমগ্র জাতির আশা অনুভূতি ও স্বপ্ন পদদলিত করবেন না।
×