ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য নিরাপত্তার পর পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বারোপ

পোল্ট্রি খাত এগিয়ে যাচ্ছে, রফতানির পথ উন্মুক্ত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৭ আগস্ট ২০১৬

পোল্ট্রি খাত এগিয়ে যাচ্ছে, রফতানির পথ উন্মুক্ত হচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ খাদ্য নিরাপত্তার সফলতার পর পুষ্টি নিরাপত্তার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। প্রাণিজ আমিষের এ চাহিদা পূরণে পোল্ট্র্রি খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের বড় পরিকল্পনা রয়েছে। তবে পোল্ট্র্রি শিল্পের মালিকগণ বলছেন, এ খাতটি যখন দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রফতানির প্রস্তুতি নিয়েছে তখন চলতি অর্থবছরে কর অব্যাহতি প্রথা বাতিল করে করের হার বাড়িয়ে নতুন করে করারোপ করা হয়েছে। গার্মেন্টের পর পোল্ট্রি খাতে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান বেশি, যে সংখ্যা বর্তমানে ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ খাতে বর্তমানে বিনিয়োগ ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৫ শতাংশ। জিডিপিতে পোল্ট্র্রির অবদান প্রায় আড়াই শতাংশ। বর্তমানে সারাদেশে পোল্ট্র্রি খামার রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৭০ হাজার। মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১৮শ’ মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে ২ কোটি ২৫ লাখ। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন ১ কোটি ৫ লাখ। আগে ডিম ও ব্রয়লার মুরগি আমদানি করতে হতো। বর্তমানে দেশের উৎপাদনেই চাহিদা মিটছে। হ্যাচিং ডিমের জন্য দেশে ৭টি গ্রান্ড প্যারেন্ট স্টক (জিপিএস) ফার্ম আছে। প্যারেন্ট স্টক (পিএস) ফার্ম রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৮০টি। এছাড়াও আধুনিক ফিড মিল থেকে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদিত হচ্ছে ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ফিড মিলও আছে। সব মিলিয়ে ফিড মিলের ৯৫ শতাংশ দেশই যোগান দিচ্ছে। বার্ড ফ্লু (এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা) রোগ নিয়ে যে পোল্ট্রি শিল্পে বিস্তর ক্ষতি হয়ে হুমকির মুখে ছিল বর্তমানে তা কেটে গেছে। এখন পোল্ট্রি শিল্প মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে জাতিসংঘের ফুড এ্যান্ড এ্যাগ্রিকালচারাল অর্গনাইজেশনের (এফএও) নিয়ম অনুযায়ী জনপ্রতি ১শ’ ৪টি ডিম খাওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশে বর্তমানে জনপ্রতি ডিম খাওয়ার হার বছরে ৪৫টি। এ হার বাড়াতে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পানায় মাথাপিছু ডিম খাওয়ার হার এফএও’র নির্ধারিত হারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মুরগির মাংস খাওয়ার হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যগত কারণে সারাবিশ্বে বর্তমানে রেড মিট (গরু ছাগল ভেড়া দুম্বা উটের মাংস) খাওয়ার পরিবর্তে হোয়াইট মিট (মুরগির মাংস) খাওয়ার ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উন্নত বিশ্বের মানুষ বছরে মুরগির মাংস খায় ৪০ থেকে ৪৫ কেজি। বাংলাদেশের মানুষ মুরগির মাংস খায় বছরে ৪ দশমিক ২ কেজি। একটা সময় এ দেশের মানুষ ফার্মের ব্রয়লার মুরগি খেত না। বর্তমানে পুষ্টির প্রয়োজনে এ সাদা মুরগির মাংস খাওয়া শুরু হয়েছে। এছাড়াও চিকেন নাগেট, সসেজ মিটবল বার্গার, ড্রাম স্টিক, সমসাসহ অনেক মজাদার ও সুস্বাদু খাবার তৈরি হচ্ছে মুরগি দিয়ে। গ্রামের মানুষ ও বর্তমান প্রজন্ম মুরগি থেকে কম দামে প্রাণিজ আমিষ পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ও এফএও’র যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষকে বছরে অন্তত ৪৩ দশমিক ৮০ কেজি প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ গ্রহণ করছে ১৫ দশমিক ২৩ কেজি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ ফল- দেশে দৈনিক মুরগির মাংসের ঘাটতি জনপ্রতি ২৬ গ্রাম ও ডিমের ঘাটতি ২৩ গ্রাম, যে কারণে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ খর্বাকৃতির, ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ কম ওজনের এবং ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ শীর্ণকায়। প্রাণিজ আমিষের এ চাহিদা তথা পুষ্টি মোকাবেলায় সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক অন্তত সাড়ে চার কোটি ডিম এবং দৈনিক সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদন করতে হবে। মোট প্রাণিজ আমিষের ৪৫ শতাংশ যোগান দেয় পোল্ট্রি শিল্প। এ শিল্প বাড়াতে বিনিয়োগ দরকার ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, গত শতকের ৮০’র দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। একদার আমদানিনির্ভর খাতটি রফতানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিঙ্কেজ কারখানা। এ শিল্পের কোনকিছুই ফেলে দেয়ার নয়। পোল্ট্রির বিষ্ঠা বা লিটারে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস। ডিমের খোসা দিয়ে তৈরি হয় জৈবসার এবং ঘর সাজানোর আর্ট ওয়ার্ক। কৃষির পরই পোল্ট্রি শিল্পকে বাড়ানো হলে আগামীর পুষ্টির চাহিদা ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, এমনটিই মনে করেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞগণ। একই সঙ্গে এ খাতটি দিন দিন রফতানির সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে। এক সূত্র জানায়, ইউরোপীয় দেশগুলোতে গরুর মাংসের ওপর সাবসিডি তুলে নেয়া হচ্ছে। মুরগির মাংসের ওপর থেকে সাবসিডি তুলে নেয়া হবে। এ সকল দেশে মুরগির মাংস রফতানির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে পরে বহু বিলিয়ন ডলারের মার্কেট উন্মুক্ত কবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রতি মুরগির মাংস খাওয়ার হার ৫০ দশমিক ১ কেজি। কানাডায় এ হার ৩৬ দশমিক ৫ কেজি। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডমি খায় জাপানের মানুষ জনপ্রতি বছরে ৬শ’টি। উন্নত দেশে এ হার জনপ্রতি বছরে ২শ’ ২০টি।
×