ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আজ জাতীয় কবি নজরুলের প্রয়াণ দিবস

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না...

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৭ আগস্ট ২০১৬

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না...

মোরসালিন মিজান ॥ ‘আমাদের এই যে দেশ আর সমাজ, এ একদম মরুভূমি হয়ে পড়েছে। ঘড়ায় ঘড়ায় পানি এনে অনেক সেঁচে দেখলাম, তাতে এ মরুর কিছুই করা গেল না। তাই এবার সাগরের পানে চলেছি। দেখি, মেঘ হয়ে ফিরে এসে জল হয়ে ঝরে পড়ে একে সুজলা-সুফলা করতে পারি কি না’- নজরুল বলেছিলেন। এভাবে বলে কয়েই চিরবিদায় নিয়েছিলেন সাম্য, প্রেম ও মানবতার কবি। আজ ১২ ভাদ্র ১৪২৩ বঙ্গাব্দ, শনিবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম প্রয়াণ দিবস। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে পৃথিবীকে বিদায় জানান তিনি। চির অভিমানী কবির উচ্চারণÑ তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/ কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না।/ নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ...। গন্ধবিধুর ধূপ হয়ে জ্বলা দুখু মিয়াকে আজ গানে-কবিতায় স্মরণ করবে বাঙালী। কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদের জয়গান হবে সর্বত্র। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সকল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি নারীর প্রতি উপেক্ষা কখনও মেনে নেননি। সমাজের নীচু শ্রেণীর মানুষদের কাছে টেনে নিয়েছেন। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এই কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। নিজের জাত চেনাতে কবির উচ্চারণÑ ‘আমি চির বিদ্রোহী বীরÑ/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ কাজী নজরুল ইসলাম অমর অক্ষয়। মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরও এতটুকু ম্লান হননি। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের নতুন যুগস্রষ্টা এখনও বিস্ময়কর আলো হয়ে জ্বলছেন। পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালীকে। তার কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ারটির স্রষ্টা তিনি। অসাম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানানভাবে নাড়া দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। কাছাকাছি সময়ে রচিত তার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসাড়তা সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার সাড়া জাগানো কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। এ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়। গদ্য রচনার সময়ও স্বতন্ত্র চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। তার প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকেই তার সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এখানে বসেই তিনি লিখেছেনÑ ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সংকলন ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন ‘যুগবাণী’। তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগ বিস্মিত করে বড় বড় প-িতদের। জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। ক্ষণজন্মা মানুষটি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতিদরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের পড়ালেখার শুরু মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাকে। রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন কবি। বালক বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যোগ দেন লেটো দলে। এই লেটো দলেই তার সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। পরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। যৌবনে সেনাসদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনযাপন করেন নজরুল। তবে ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চির বিদ্রেহী রণক্লান্ত নজরুল বাক্শক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ-ভোগের পর এখানেই পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। প্রতিবারের মতো এবারও নানান আয়োজনে দিবসটি পালন শুরু করেছে বাঙালী। শুক্রবার বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ছায়ানট। সান্ধ্যকালীন আয়োজনে ছিল গীতিআলেখ্য। কাল রবিবার বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে নজরুল বিষয়ক একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। অনুষ্ঠানে একক বক্তৃতা করবেন বিশিষ্ট গবেষক-প্রাবন্ধিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন নজরুল গবেষক ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এছাড়াও কবির স্মৃতিধন্য জায়গাগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
×