ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তুহিন রহমান

মার্কিনীদের রাজত্ব, চীনের ভরাডুবি

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৪ আগস্ট ২০১৬

মার্কিনীদের রাজত্ব, চীনের ভরাডুবি

অলিম্পিক মানেই যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য। এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বরাবরের মতো এবারও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই দেশে ফিরেছেন মার্কিন ক্রীড়াবিদরা। যুক্তরাষ্ট্র রাজত্ব ধরে রাখলেও ভরাডুবি হয়েছে এশিয়ার দেশ চীনের। সবশেষে তিন অলিম্পিকের সাফল্য এবার ব্রাজিলের রিওতে দেখাতে পারেননি চীনা এ্যাথলেটরা। চার বছর আগে ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে জেতা ৪৬ স্বর্ণ এবারও অটুট রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ জিতেছে আগের চেয়ে বেশি। রৌপ্য সংখ্যা ৩৭ ও ব্রোঞ্জ ৩৮টি। সবমিলিয়ে ১২১ পদক জিতে তালিকায় অন্যদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে থেকে শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের কব্জায় রেখেছে মার্কিনীরা। লন্ডন অলিম্পিকে মোট ১০৩টি পদক জিতেছিল তারা। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল এবার রাশিয়ার ক্রীড়াবিদদের নিয়ে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিষিদ্ধ ড্রাগ ব্যবহার ছড়িয়ে পড়েছিল দেশটির এ্যাথলেটদের মধ্যে। সে কারণে রাশিয়ান ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ড এ্যাথলেটরা ছিলেন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সে কারণেও এবার অন্য দেশগুলোর পদক বেড়েছে। পুরো রাশিয়াকেই রিও অলিম্পিক থেকে নিষেধাজ্ঞার দাবি উঠেছিল, শেষ পর্যন্ত ১১৮ জন নিষিদ্ধ হন। পূর্ণ শক্তির দল নিয়ে আসতে না পারলেও রাশিয়া গতবারের মতো এবারও চতুর্থ স্থান নিয়েই শেষ করেছে। তবে বেজিং অলিম্পিকে এক নম্বর ও লন্ডনে দ্বিতীয় হওয়া চীনকে এবার হটিয়ে দ্বিতীয় সেরা হয়েছে গ্রেট ব্রিটেন। অর্থাৎ ভরাডুবি হয়েছে চীনাদের। অলিম্পিক ইতিহাসে বরাবরই অপ্রতিরোধ্য যুক্তরাষ্ট্র। এবারও ৫৫৫ সদস্যের বিশাল দল নিয়ে রিও অভিযানে আসে তারা। এর মধ্যে ২৯২ জনই ছিলেন মহিলা ক্রীড়াবিদ, যা অলিম্পিকের জন্য নতুন রেকর্ড। এর আগে কোন দেশের পক্ষেই এত মহিলা ক্রীড়াবিদ অলিম্পিকে অংশ নেয়নি। তাই অলিম্পিকের নতুন রেকর্ড গড়ে যুক্তরাষ্ট্র। মহিলাদের চেয়ে পুরুষ ক্রীড়াবিদের সংখ্যাই কম, মাত্র ২৬৩ জন! এই বিশাল দলটি এবার দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে। দশমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র পদক জয়ের সেঞ্চুরি করেছে এবার। তবে ১৯৮৪ সালে লস এ্যাঞ্জেলেস গেমসের পর এটাই অলিম্পিকে সর্বাধিক পদক জয় আমেরিকার। আয়োজক হিসেবে লস এ্যাঞ্জেলেসে ১৭৪ পদক জিতেছিল তারা। তবে অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২৩৯ পদক জিতেছিল যুক্তরাষ্ট্র ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইসে অনুষ্ঠিত আসরে। সবমিলিয়ে অলিম্পিক ইতিহাসে এবারের সাফল্যটি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সেরা অর্জন। অবশ্য লন্ডন অলিম্পিকে হয়েছিল ৩০০ স্বর্ণের লড়াই, এবার হয়েছে ৩০৬টি স্বর্ণের। গত ৩২ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা এই সাফল্য পাওয়ার পেছনে ছিল বেশ কয়েকজন ক্রীড়াবিদের দুর্দান্ত নৈপুণ্য। কিংবদন্তি সাঁতারু মাইকেল ফেলপস একাই ৫ স্বর্ণ ও ১ রৌপ্য জয় করেন। মহিলা সাঁতারে বেশ কয়েকটি বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী কেটি লিডেকিও ৪ স্বর্ণ ও ১ রৌপ্য জয় করেন। এছাড়া জিমন্যাস্টিকসের সম্রাজ্ঞী হিসেবে স্বীকৃত সিমোন বিলেস ৪ স্বর্ণ ও ১ ব্রোঞ্জ জয় করেন। আর এদের কারণেই সবাইকে ছাড়িয়ে এবারও সেরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় সেরা দল হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এবার ব্যবধানটা অনেক ব্রিটেনের। ২৭ স্বর্ণ, ২৩ রৌপ্য ও ১৭ ব্রোঞ্জসহ ৬৭ পদক নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে তারা। গত আসরে চীন ৩৮ স্বর্ণ, ২৯ রৌপ্য ও ২১ ব্রোঞ্জসহ ৮৮ পদক নিয়ে দ্বিতীয় হয়েছিল। এবার তারা তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে ২৬ স্বর্ণ, ১৮ রৌপ্য ও ২৬ ব্রোঞ্জসহ ৭০টি পদক সংগ্রহ করেছে। তবে চাপের মুখে থাকলেও রাশিয়ার নৈপুণ্যে তেমন হেরফের হয়নি এবারও। ১৯ স্বর্ণ, ১৮ রৌপ্য ও ১৯ ব্রোঞ্জসহ ৫৬টি পদক জিতে চতুর্থ তারা। গত অলিম্পিকেও একই অবস্থানে ছিল ২২ স্বর্ণসহ মোট ৭৭ পদক জিতে। পদক তালিকায় সেরা দশের অন্যরা হচ্ছেÑজার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়া। এবারের গেমসে ২৮টি ক্রীড়ার ৩০৬টি ইভেন্টে বিশ্বের ২০৭টি দেশের সর্বমোট ১১ হাজার ৫৪৪ জন ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করেন। ৩০৬টি স্বর্ণসহ মোট পদকের সংখ্যা ছিল ৯৭৫টি। অলিম্পিকে সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রের আশপাশে নেই কোন দেশ। তবে বিগত কয়েকটি আসরে তাদের ভালভাবেই টেক্কা দিয়েছিল চীন। সেই চীন এবার অধিপত্য ধরে রাখতে পারেনি। মার্কিনীদের টেক্কা দূরে থাক, গ্রেট ব্রিটেনের পেছনে থেকে তৃতীয় হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অথচ দেশের বাইরের কোন অলিম্পিকে এবারই সবচেয়ে বেশি ৪১০ জন এ্যাথলেট পাঠিয়েছিল তারা। সর্বশেষ তিনটি অলিম্পিকে কখনও দুইয়ের নিচে নামেনি চীন, ২০০৮ বেজিংয়ে ঘরের মাটির অলিম্পিকে তো ছিল সবার ওপরে। কিন্তু এবার রিওতে হয়েছে ছন্দপতন। সব মিলিয়ে রিও অলিম্পিক চীনের জন্য গত ২০ বছরে সবচেয়ে বাজে। তবে হতাশ হয়ে বসে থাকছে না চীনারা, এখনই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নেমে পড়ছে চার বছর পরের টোকিও অলিম্পিকের জন্য। ২০০৮ বেজিং অলিম্পিক বাদ দিলে এই শতাব্দীতে দেশের বাইরের অলিম্পিকগুলোয় চীনের এ্যাথলেটের সংখ্যা যেমনি বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পদকের সংখ্যাও। ২০০০ সিডনি, ২০০৪ এথেন্স ও ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে স্বর্ণের পদক ছিল যথাক্রমে ২৮, ৩২ ও ৩৮টি। নিজ দেশের অলিম্পিকে (২০০৮ বেজিং) স্বর্ণের পদক ছিল সর্বোচ্চ ৫১। কিন্তু রিওতে এসে স্বর্ণের পদকের ধারাটা ধরে রাখতে পারেনি চীনারা। ব্যর্থতা প্রসঙ্গে চীনের অলিম্পিক কমিটির প্রধান লিউ পেং বলেন, রিওতে আমরা খুব বেশি পদক জিততে পারিনি। অলিম্পিকে কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে সেটিও আগে থেকে বুঝতে পারিনি। কয়েক বছর ধরে বেশি বেশি দেশ অলিম্পিককে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে, বিশ্বজুড়ে খেলার মান বেড়েছে, প্রতিযোগিতাও তীব্র হয়েছে। রিওর ৪১০ জনের দলের এক-তৃতীয়াংশই প্রথমবারের মতো খেলেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যজ্ঞে। লিউয়ের বিচারে এই অনভিজ্ঞতাও ব্যর্থতার একটি কারণ। তিনি বলেন, আমরা ওদের ভাল প্রশিক্ষণ দিয়েছি, কিন্তু শুধু অনুশীলনই যথেষ্ট নয়। এত প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে এ্যাথলেটদের অনেক বেশি কিছুই ভাবতে হচ্ছে, মানসিক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর আগে এই পর্যায়ে তো ওরা খেলেনি। পদক তালিকায় সবার ওপরে থাকার লক্ষ্য যাদের, তৃতীয় হওয়া সেখানে ব্যর্থতাই। এই ব্যর্থতা ঘুচিয়ে ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের জন্য আরও ভালভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে চীন এখন থেকেই। এ প্রসঙ্গে লিউ বলেন, কীভাবে খেলার মান ও দক্ষতা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে নতুন মানসিকতা ও ধারণা দরকার আমাদের। অভিজ্ঞতা আর শিক্ষাও লাগবে।
×