ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী মদিনা

হে মহামানব একবার এসো ফিরে

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৩ আগস্ট ২০১৬

হে মহামানব একবার এসো ফিরে

যদি প্রশ্ন করি বাঙালীর হাজার বছরের আশা-আকাক্সক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আমাদের চেতনায় কে আত্মস্থ করেছেন? উত্তর একটাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা মহামানব শেখ মুজিবুর রহমান বিশ শতকের আধুনিক দর্শন-ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদ চিন্তা-চেতনা বাঙালীর মননে, সেবায় গেঁথে দিয়েছেন অতি যতেœ। আমাদের বিস্মৃত জাতিসত্তাকে তিনি জাগ্রত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালীর কাছে একজন ব্যক্তির নাম নয়। তিনি এক অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমী ইতিহাস। যিনি বাঙালীর কাছে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন শুধু তাঁর লক্ষ্যে অটল, স্থির ছিলেন বলে। শেখ মুজিব স্কুল জীবন থেকেই প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তারপর ধাপে ধাপে সংগ্রাম-আন্দোলনে এগিয়ে গেছেন। জীবনব্যাপী করেছেন আন্দোলন। এ দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় কখনও মুজিব ভাই, কখনও শেখ সাহেব থেকে হয়ে উঠলেন স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা। ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তিনি বেড়ে ওঠেন। প্রকৃতিপ্রেমী শেখ মুজিব বাবুই পাখির বাসার শৈলী দেখে মুগ্ধ হতেন। মাছরাঙা পাখি ডুব দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য নিমগ্ন হয়ে দেখতেন। শালিক, ময়না, দোয়েল পাখির কিচির-মিচির ধ্বনি তাঁকে আকৃষ্ট করত। শুধু তাই নয়, জীবজন্তু সংগ্রহ এবং সযতেœ পালন করা ছিল তাঁর অন্যতম শখ। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন হৃদয়বান। সাথী বন্ধুদের দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে বিচলিত করত। তাদের যে কোন সমস্যা সমাধা না করা পর্যন্ত স্থির হতে পারতেন না। মানুষের দুঃখ-বেদনা-বঞ্চনা তাঁকে শৈশব থেকে ব্যথিত করে। এই কোমলমতি বালক একেবারে ছেলেবেলা থেকেই কোন অন্যায় দেখলে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আর শৈশব থেকে নিজ অধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। কৈশোরেই তিনি রাজনীতিতে দীক্ষা নেন। তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্্রাওয়ার্দী। শেখ মুজিব ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলেজে ভর্তি হলেন কলকাতায়। সেই সময় যুক্ত হলেন পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৪৭ সালে তিনি গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী লাভ করেন। আর সেই বছরই দেশ ভাগ হয়ে যায়। বাংলার পূর্বাংশ হলো পূর্ব পাকিস্তান। দেশ ভাগের পরপরই শেখ মুজিব বুঝতে পারলেন বাঙালীরা স্বাধীনতা লাভ করেনি। এটি ঔপনিবেশিক শাসনের হাত বদল মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান একটি ভৌগোলিক ইউনিট। কোন স্বাধীন দেশ নয়। পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তা-চেতনার চরিত্র পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সবচেয়ে বড় অন্তরায় দুই অংশের ভাষাগত ব্যবধান এবং দেড় হাজার মাইলের দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক ও সামরিক হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তান সবক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। আর তাই জন্মলগ্ন থেকে নির্মম রাজনৈতিক শাসন ও অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে। প্রথম আঘাত আসে বাঙালীর অস্তিত্ব মাতৃভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালে মার্চ মাসে পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কণ্ঠে উচ্চারণ করেনÑ একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পরে পল্টন ময়দানে জনসভায় একই কথা বলেন। ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাত মাসের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালী শুরু করে সংগ্রাম-আন্দোলন। দেশ ভাগের পর শেখ মুজিব কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। যুক্ত হলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবি আন্দোলনের সঙ্গে। অচিরেই তিনি কারারুদ্ধ হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের ধর্মঘট আন্দোলন সমর্থন করায় তাঁকে বন্দী করা হয়। জেলে বসেও তিনি ভাষা আন্দোলনের কাজ করেন। শুধু আন্দোলন নয়, একই সঙ্গে সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নবগঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। তাঁর নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার গুণে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সংবিধান রচনার মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর প্রতিবাদে সুসংবদ্ধ জোর আন্দোলন শুরু হয়। যার পুরোভাগে ছিলেন শেখ মুজিব। বস্তুত, ভাষা আন্দোলনই স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন বাংলার ইতিহাসে আরেক মাইলফলক। শাসক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা দাবিতে নির্বাচনী ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও ‘বাংলা’ ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ ভোটে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে শেখ মুজিব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্টের এক মন্ত্রিসভায় তরুণতম মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব শপথ গ্রহণ করেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ৯২-ক ধারা জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়া হয় এবং অনেকের সঙ্গে শেখ মুজিবকেও বন্দী করা হয়। ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হলে শেখ মুজিব আবার মন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। মাত্র কয়েকমাস পর ১৯৫৭ সালে পার্টিকে সুসংগঠিত করার প্রত্যয়ে শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৫৮ সাল। পাকিস্তানের অন্ধকারের ইতিহাস। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে মার্শাল ল’ জারি করেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলেন। এ সময় তিনি দীর্ঘ ১৪ মাস কারাজীবনযাপন করেন। মুক্তি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ১৯৬২ সালে তাঁকে আবার কারাবরণ করতে হয়। ১৯৬৩ সালে রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হন। এ বছরেই হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন। তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বাঙালীরা উপলব্ধি করে পূর্ব পাকিস্তানীরা কতখানি নিরাপত্তাহীন অবস্থানে বসবাস করছে। যুদ্ধশেষে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক সম্মেলনে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ দফা দাবিতে তিনি পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো গঠন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসহ প্রাদেশিক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন। এই দাবির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ ৬ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের দাবিতে মাশাল ল’ উপেক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করল। ধীরে ধীরে বাঙালীর জাতীয়তাবাদী চেতনা পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হলো। সমগ্র জাতি স্বাধীনতার লক্ষ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এগিয়ে চলে। প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা কর্মসূচী বাঙালীর মুক্তি সনদ বা ‘ম্যাগনা কার্টা ফর বেঙ্গলিজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। আন্দোলন জোরদার হলে ১৯৬৬ সালে ৮ মে প্রতিরক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। শুধু গ্রেফতার করেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি, শেখ মুজিবকে নিঃশেষ করার উদ্দেশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। এই মামলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পাকিস্তানী জান্তা বুঝে গেল শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে পাকিস্তান থেকে। তাই ১৯৬৮ সালে ১৭ জুন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে ঢাকা জেল থেকে কুর্মিটোলা সামরিক শিবিরে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। বাঙালীর দৃঢ় ধারণা জন্মে শেখ মুজিবকে শেষ করার উদ্দেশ্যেই এই মামলা দেয়া হয়েছে। সমগ্র দেশবাসী একত্রিত হয়ে ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান ঘটায়। সেøাগানে সেøøাগানে রাজপথ মুখরিত হয়Ñ ‘জেলের তালা ভাংব শেখ মুজিবকে আনব’। গণঅভ্যুত্থানে সামরিক জান্তার শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। শেষ পর্যন্ত শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক জান্তার প্রধান হলেন। শেখ মুজিবের মুক্তির পর ১৯৭০ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভায় তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেই জনসভায় শেখ মুজিবকে দেশবাসী বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সেশন বসার দিন ধার্য করা হয়। এক মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিকামী জনতা ফুঁসে উঠল। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অমর পঙ্্ক্তি ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এই আহ্বানে সমগ্র জাতি একত্রিত হয়ে উত্তাল সমুদ্রের মতো উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ভাষণের শেষ পঙ্ক্তিÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী জান্তা গণহত্যা চালায়। তখন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয়দীপ্ত আহ্বানে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ, জাফলং থেকে সুন্দরবন মুক্তিপাগল মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দী হলেন বঙ্গবন্ধু। শতাব্দীর নৃশংসতম জেনোসাইডকে উপেক্ষা করে বাঙালী ভয়ঙ্কর পাকিস্তানী আর্মিকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। আমরা পেলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু অঙ্গীকার করেছিলেন ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। এমন আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, সাহস আর অনমনীয় বজ্রের মতো কঠোর দুর্জয় মনোবল শিশুর মতো সহজ-সরল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী একজনই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু চরিত্রে জাতীয়তাবাদী, স্বভাবে গণতন্ত্রী, বিশ্বাসে সমাজতন্ত্রী এবং আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষ। খ্যাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিক সিরিল ডানের মতে-‘তিনি সুদর্শন প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনলবর্ষী বক্তা এবং শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো ক্ষমতা রাখেন।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বাঙালীর স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরও প্রামাণ্য দলিল। ১৯৬৭ সালে জেলখানায় বসে তিনি আত্মজীবনী লেখেন। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাস লেখেননি। লিখেছেন নিজের জীবনকথা। ১৯২০ থেকে ১৯৫৪-৫৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর অনুভূতির কথা পরম আপনজনের মতো করে লিখেছেন। এটি যেমন সময়ের দলিল একই সঙ্গে সময়োত্তীর্ণ জীবনের কাহিনী। দেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস দেশ বিভাগ-পরবর্তী রাজনীতি সম্পর্কে এমন প্রামাণ্য দলিল আমাদের জন্য অমূল্যপ্রাপ্তি। তিনি বিশ্বাস করতেন, আন্দোলন করতে হলে এবং কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারা প্রচার করার জন্য সংবাদপত্রের বড় প্রয়োজন। তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেনÑ ‘হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে খরচ লাগে তা পেলে পরে আর যোগাড় করতে অসুবিধা হবে না।... মুসলিম লীগ অফিসের নিচের তলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সাহেবই কাগজের লেখাপড়ার ভার নিলেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল । ব্যবহারও অমায়িক। সমস্ত বাংলাদেশেই আমাদের প্রতিনিধি ছিল।’ এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’ (পৃষ্ঠা ৪০) আমরা জানি বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ সংগ্রামকাল মাত্র নয় মাস। কিন্তু পরোক্ষ সংগ্রামের ব্যাপ্তি চব্বিশ বছর। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা লাভের সাত মাসের মধ্যেই বাঙালীকে সংগ্রাম-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। এই চব্বিশ বছরের সংগ্রামী আন্দোলনে একেবারে প্রথম থেকে প্রতিটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন। সঠিক পথ দেখিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে অর্ধেকের বেশি সময় তাঁকে কারাবন্দী থাকতে হয়েছে। এতটুকু আদর্শ থেকে সরে যাননি। এতটুকু ভীত হননি। সব সময় বাঙালীকে মাথা উঁচু করে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বলেছেন। যখনই কোন সঙ্কট এসেছে তিনি রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে জাতিকে আহ্বান জানিয়েয়েছেনÑ ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’...। জাতি কোনরকম প্রশ্ন না করেই তাঁর সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আপোসহীন নীতির ডাকে সাড়া দিয়ে সংগ্রাম-আন্দোলন করেছে। সেই মহৎপ্রাণ মানবপ্রেমী মানুষটিকে একদল বিপথগামী মানুষরূপী পশু নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকা-ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ তার প্রত্যাশিত যাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। ১৫ আগস্ট শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ সময় সামরিক শাসন ও সংবিধান বিকৃতির পর তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশকে আবার আগের ধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তখন গুলশানের ঘটনা দেশবাসীকে স্তম্ভিত করে দেয়। এটা নৃশংস নিষ্ঠুরতা! নির্মম সহিংসতা বাংলাদেশের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। যদিও আমরা জানি জঙ্গীবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা; কিন্তু যে দেশ বঙ্গবন্ধুর মানবপ্রেম মানুষের অধিকারবোধ ও অসাম্প্রায়িক রাজনীতির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে দেশে এমন ঘটনা ঘটা বড়ই অস্বাভাবিক। আমাদের পরিচিত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ কখনই স্থান পেতে পারে না। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বড়ই প্রয়োজন। আমরা সমস্বরে উচ্চারণ করিÑ হে মহামানব একবার এসো ফিরে শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরীর ভিড়ে এখানে মৃত্যু হানাা দেয় বার বার লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার হে মহামানব একবার এসো ফিরে। (বোধন, সুকান্ত ভট্টাচার্য)
×