ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টের পর রিলেতেও স্বর্ণপদক, তিনিই যে বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সের অবিসংবাদিত সম্রাট এতে আর কোন সন্দেহ থাকল না

‘ট্রিপল ট্রিপল’ জৌলুসে ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের ইতিহাসে অমর বোল্ট

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২১ আগস্ট ২০১৬

‘ট্রিপল ট্রিপল’ জৌলুসে ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের ইতিহাসে অমর বোল্ট

ইতিহাসে অমরত্ব পেয়ে গেলেন তিনি। সঙ্গীদের সঙ্গে বীরদর্পে দৌড়ালেন। আসলেন, দেখলেন, আবারও হাসতে হাসতে জিতে গেলেন। তিনি ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের রাজা উসাইন বোল্ট। গোটা পৃথিবী ততক্ষণে জেনে গেছে ‘ট্রিপল-ট্রিপল’ স্বপ্ন পূরণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে গেলেন বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সের অবিসংবাদিত সম্রাট বোল্ট। তিন ইভেন্টে টানা তৃতীয় হ্যাটট্রিক আনন্দের সৌরভ ছড়িয়ে দিলেন অলিম্পিকস পার্কে। বনে গেলেন সর্বকালের সেরা এ্যাথলেট। ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে ব্যক্তিগত স্বর্ণপদক জয়ের পর রিলেতেও একই চিত্র। হয়ত রিওই হতে যাচ্ছে তার শেষ অলিম্পিকস। কিন্তু ক্যারিয়ারে ঊষালগ্নের মতোই, জয় করলেন ৪+১০০ মিটার রিলের প্রত্যাশিত স্বর্ণপদক। গৌরবময় এই অর্জনে তার সহযোদ্ধা ছিলেন আসাফা পাওয়েল, ইয়োহান ব্লেক ও নিকেল এ্যাশমিড। বেজিং থেকে লন্ডন হয়ে রিও অলিম্পিকসেও তিন ইভেন্টে টানা তৃতীয় সোনার পদক। যে রেকর্ড অলিম্পিক গেমসের ১২০ বছরের ইতিহাসে আগে কখনও দেখা যায়নি। এমন যার ক্যারিয়ার তিনিই যে কিংবদন্তি এতে আর কোন সন্দেহ থাকল না। রিলে শেষে আবার সাড়া জাগানো পোজ ‘দ্যা লাইটনিং বোল্ট’। বোল্ট ম্যাজিকে ৩৭ দশমিক ২৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণপদক জ্যামাইকার। ৩৭ দশমিক ৬০ সেকেন্ডে সিলভার জাপানের। আর ব্রোঞ্জ জেতা কানাডা দল সময় নিয়েছে ৩৭ দশমিক ৬৪ সেকেন্ড। বলে রাখা দরকার, এবার কিন্তু নতুন শক্তির আবির্ভাব দেলে অলিম্পিক গেমসের আকর্ষণী এই ইভেন্টে। রৌপ্য জিতে এশিয়ার গর্ব বনে গেল জাপান। ট্র্যাক এ্যান্ড ফিল্ডের লড়াইয়ের পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র কিছুই পেল না। এটা যেমন নতুন ঘটনা তখন জাপানের জন্য এটা ইতিহাস। লন্ডন অলিম্পিকস শুরুর আগে কেউ বাজি ধরেননি বোল্টকে নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা আগেভাগেই বলে দিয়েছিলেন, বোল্ট হাসতে হাসতেই তার ইভেন্টের সব সোনার পদক নিয়ে যাবেন। ঠিক তাই হলো। বোল্ট যেন নামার জন্য নেমেছিলেন ট্র্যাকে। হাসতে হাসতে একের পর এক সোনার মেডেল জিতে বেরিয়ে যাওয়া তাই প্রমাণ করে। যদিও তার সাফল্য নিয়ে কোন ধোঁয়াশা ছিল বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গত, বোল্ট শুধু বিশ্বসেরা স্প্রিন্টারই নন। ক্রীড়াবিশ্বের অন্যতম গ্ল্যামার তারকাও। কিংস্টনে ২০০২ জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সবচেয়ে কম বয়সী বোল্ট সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে ছিলেন রেকর্ড গড়ে। সেই শুরু। আর কয়েক বছরের মধ্যে রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়াটা অভ্যাসে পরিণত করে স্প্রিন্টের অবিসংবাদিত সম্রাট হয়ে ওঠেন ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার জীবন্ত কিংবদন্তি। কোন মন্ত্রে এত সফল বোল্ট? উত্তর সহজ। ট্র্যাকে তিনি যে চিতার মতো দৌড়ান। লম্বা পা দু’টো ছুটে চলে ক্ষুধার্ত বাঘের শিকার ধরার মতো। এখানেই অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম বোল্ট। তার সমক্ষ এই গ্রহে বর্তমানে যে কেউ নেই সেটাই প্রমাণ করলেন রিওতে ‘নয়ে নয়’ মেরে। ২০০৪ এ্যাথেন্স অলিম্পিকে ইনজুরির কারণে প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে গিয়েছিলেন। কেবল হাতাশ নয়, দারুণ এক যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়েছিল। সেই হতাশাই ১২ বছরে বছরে বদলে দেয় তার ক্যারিয়ার। এবার ২৯ বছর বয়সে শেষ বারের মতো অলিম্পিকসে খেলতে নেমে একই কীর্তি দেখালেন। যা কবে কে ভাঙবেন বা আদৌ পারবেন কিনা প্রশ্ন উঠতেই পারে। অন্য সময়ের মতো রিলে রেসে নিজের শেষ ইভেন্টটাতেও সানগ্লাস, কানে হেডফোন, কালো ট্র্যাকস্যুটে আপাদমস্তক ঢাকা শরীরটা স্টেডিয়ামে ঢুকতেই যেন উৎসব শুরু হয়ে গেল। দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন বরাবরের মতো দুই হাত তুলে। বোল্টের টার্গেট ছিল আগের দু’বারের মতো রিওতেও তার সবক’টি ইভেন্টে মুকুট অক্ষত রাখা। গতকাল রাতে সতীর্থদের নিয়ে অন্যদের পেছনে ফেলে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করার পর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বোল্ট বলছিলেন, রিওতে পা রেখেই জানিয়ে দিয়েছিলাম সবক’টি সাফল্য ধরে রাখাই আমার লক্ষ্য। আর সেটাই প্রমাণ করে দিলাম। গৌরবময় এই সাফল্যের জন্য সবার আগে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছি। আগের রেকর্ড স্পর্শ করতে না পারলেও ১০০ ও ২০০ মিটারের টাইমিং নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। এই ফর্ম বজায় রেখে রিলে রেসে শেষ হাসি হাসলেন তিনি। রিও অলিম্পিক গেমস শুরুর আগে উসাইন বোল্টের প্রত্যাশা বা সাফল্য পাওয়া নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল ইনজুরির কারণে। কিন্তু স্প্রিন্টের দুই সোনার পতক জেতার পর পরিষ্কার বোঝা গেল জ্যামাইকার গতিদানবের সাফল্য নিয়ে আর কোন সংশয় নেই। শুক্রবার রাতে সে রোশনাই দেখল গোটা পৃথিবী। বলার অপেক্ষা রাখে না, বোল্ট সুপার হিউম্যান। স্প্রিন্টার হিসেবে অনেক উঁচুতেই ছিলেন। পরপর তিনটি অলিম্পিকে নিজের প্রিয় ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেকে আরও বেশি উচ্চতায় নিয়ে গেলেন এবার। কেমন হলো শুক্রবার রাতের দৌড়? এটা বলার আগে উল্লেখ করা দরকার বোল্টের সর্বাধিক গতি ঘণ্টায় ৪৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। যা তিনি দৌড়ান ৫৫-৬০ থেকে ৭৫-৮০ মিটার পর্যন্ত ঘণ্টায় ৪২ কিলোমিটার গতিতে। অন্য স্প্রিন্টাররা এটা পারেন না। এখানেই বোল্টের সঙ্গে অন্যদের বড় পার্থক্য। দেখা গেছে ৫৫-৬০ থেকে ৮০ মিটার পর্যন্ত নিজের সেরা গতিতে দৌড়ান তিনি। রিলের ফাইনালে সবার শেষে নিকেলের কাছ থেকে ব্যাটন হাতে নিয়ে আরেকবার তা দেখিয়ে দিলেন। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস। নিজ দেশের হয়ে রিলের দৌড়ে বোল্টের গতি ছিল শুরু থেকেই ‘বিদ্যুত’। যেখানে গ্রাউন্ড রি-এ্যাকশন ফোর্স কাজে লাগালেন তিনি। উচ্চতা, ফুট লেন্থ, শারীরিক গঠন কাজে লাগিয়ে বোল্ট যা করতে পারেন, সেখানে অন্যরা তা পারেন না। এদিনও পারলেন না। অন্যান্য দেশের স্প্রিন্টারদের সঙ্গে বোল্ট বা জ্যামাইকানদের একটা পার্থক্য আছে। জ্যামাইকানরা এখনও স্প্রিন্ট ট্রেডিশনাল সিস্টেম মেনে চলেন। যেখানে ট্রেনিংয়ে তারা লং রানিংকে গুরুত্ব দেয়। যেমন ৩০০ মিটার পর্যন্ত দৌড়ায়। অন্য দেশের স্প্রিন্টাররা ট্রেনিংয়ে শর্ট ডিসট্যান্স রানকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। আমেরিকানরা স্পিড এনডুরেন্সকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বোল্টের ওসব দরকার হয় না। আগেও অনেবার বুঝিয়েছেন। এবার তার শেষ ইভেন্ট রিলেতেও আরেকবার বুঝালেন। বোল্ট জানেন কখন জ্বলে উঠতে হয়। এখন যতটা পারা সম্ভব, ঠিক সময়ে সেই সেরা টাইমিংটাই করেছেন। সময় আরেকটু ভাল হতে পারত। না হওয়ার কারণ রিকভারি টাইম কম পাওয়া। সবারই জানা জুনে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে ভুগছিলেন বোল্ট। অন্য অনেকে এই অবস্থায় অলিম্পিকের ট্র্যাকে নামারই স্বপ্ন দেখতেন না। তিনি বোল্ট বলেই ফিরে আসতে পেরেছেন। প্রসঙ্গত, ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখে ফেললেও এক সময় সবাইকে সরে যেতে হয়। ‘ট্রিপল-ট্রিপল’-বিরল অর্জনের পর বোল্ট নিজেও বুঝলেন, এবার সরে যাবার সময় হয়ে গেছে। তাই জানিয়েও দিলেন ২০১৭ বিশ্ব-চ্যাম্পিয়নশিপের পর অবসর নেবেন, যা একেবারে নির্ভুল সিদ্ধান্ত।
×