ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিডিয়ার নেতিবাচক রিপোর্ট জঙ্গীবাদ দমনে বাধা

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ১৩ আগস্ট ২০১৬

মিডিয়ার নেতিবাচক রিপোর্ট জঙ্গীবাদ দমনে বাধা

৫ আগস্টের দৈনিক প্রথম আলোতে ‘ব্লক রেইড মানে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা’ শিরোনামে একটা খবর পড়লাম। ১ জুলাই গুলশানে রেস্তরাঁয় জঙ্গি হামলার পর থেকে জঙ্গী তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে। প্রথম আলোর সংবাদদাতা মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন বাসিন্দার সঙ্গে আলাপকালে তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথাগুলো রিপোর্টে তুলে ধরেন। রিপোর্টে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকসহ পুলিশের বিভিন্ন উর্ধতন কর্মকর্তার মন্তব্য এবং বক্তব্য তুলে ধরা হয়। যে কোন প্রবন্ধ, রচনা, গদ্য বা কলামের একেবারে শেষের স্তবকটিতে সাধারণত থাকে মূল বক্তব্য উপস্থাপনার জন্য। সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে এই বক্তব্য মূলত পত্রিকাটির নীতিগত অবস্থান তুলে ধরারই নামান্তর। উল্লেখিত রিপোর্টের বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। রিপোর্টের শেষে প্রথম আলোর নীতিগত অবস্থানটি অধিকতর পরিষ্কার করার জন্য বক্তব্য নেয়া হলো তাদেরই ঘরানার হিসেবে পরিচিত আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের। শাহদীন মালিক বললেন, ‘পরোয়ানা ছাড়া শুধু সন্দেহ করে এভাবে তল্লাশি চালানো অনুচিত। যেহেতু বেশিরভাগ তল্লাশিতে কিছু পাচ্ছে না, তাতে মনে হচ্ছে পুলিশের তথ্য ঠিক ছিল না। এ ক্ষেত্রে দরকার সঠিক তথ্য নিয়ে অভিযান চালানো। তা করা হলে মানুষও পুলিশকে তথ্য দিতে এগিয়ে আসবে। তা না হলে পুলিশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’ রিপোর্টার খবরটি পরিবেশনের মাধ্যমে যে ভীতিগত আবহ সৃষ্টি করেছেন, তা লক্ষণীয়। শাহদীন মালিকের কণ্ঠে প্রথম আলো বলতে চেয়েছে যে, কোন ধরনের অভিযোগ ছাড়া তল্লাশি চালানো নাকি ঠিক না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাকি কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ভাষার মারপ্যাঁচে অস্বীকার করছেন না যে, একেবারেই কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। একই সঙ্গে এও বলছে যে, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে’ কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে কিছু অন্তত পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে সেই অর্জনকে ম্লান করে দিতেই কি এই রিপোর্ট করা। কিন্তু কেন! কিছুদিন আগে কল্যাণপুরে যে জঙ্গী আস্তানার হদিস পাওয়া গিয়েছিল এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সেখানে নয় জঙ্গী নিহত হয়েছিল, সেটাও কিন্তু ছিল ‘ব্লক রেইড’-এর আওতাধীন পুলিশী কর্মকা-। সেটা কি বাংলাদেশ পুলিশের জন্য বিশাল জয় ছিল না? তারই ধারাবাহিকতা ধরে পুলিশের এই ‘ব্লক রেইড’ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বক্ষেত্রে জঙ্গী ধরা না পড়লেও অন্তত ক্রাইম জাস্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত উঁচুমাত্রার একটা সফলতা হিসেবেই পরিগণিত হওয়া উচিত অথচ প্রথম আলোর রিপোর্টে পুলিশের এই ‘ব্লক রেইড’ কার্যক্রমকে এমন একটা নেতিবাচক খবর হিসেবে প্রকাশ করা হলো, যা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে বলেই অনুমেয়। পুলিশ জানিয়েছে, ব্লক রেইডের আওতায় খিলগাঁও, হাজারীবাগ, জুরাইন, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর, সূত্রাপুর ও উত্তরা পশ্চিম এলাকায় সাতটি তল্লাশিতে ৪৬ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্যগুলোতে সন্দেহভাজন কাউকে পায়নি পুলিশ। আটকদের মধ্যে ৩৪ জন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ৬ জনকে মাদকসহ আটক করা হয়। নিয়মিত মামলায় গ্রেফতার করা হয় বাকি ৬ জনকে। এই সমীক্ষায়ও বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদারিত্বের যথেষ্ট নজির পাওয়া যাচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য! অথচ ওই পত্রিকার রিপোর্টের আবহ সঙ্গীতে বাজানো হলো বিষাদের সুর! অভিযানে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন এমন একাধিক ব্যক্তির বক্তব্য নিয়ে প্রথম আলো নালিশের সুরে রিপোর্ট করল। অথচ রিপোর্টের ভুক্তভোগীরা কোথাও বলেননি, কোন্ ধরনের বিড়ম্বনার শিকার তাঁরা হয়েছেন! তাঁরা ভয় পেয়েছেন, এটাই স্বাভাবিক। ব্যাচেলরদের বাক্স-পেটরা, ল্যাপটপ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে পুলিশ। জঙ্গী ধরার অভিযানে এটাই স্বাভাবিক রুটিন! এর ব্যত্যয়ে বরং পুলিশকে দায়িত্বে গাফিলতির দায় নিতে হতো। ভুক্তভোগী কেউ কেউ বলেছেন, দরজায় কড়া নাড়ার পরে দরজা খুলতেই দেখেছেন, পুলিশের উঁচিয়ে ধরা বন্দুকের নল, সবাইকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলেছে পুলিশ, সবাই ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছেন। এটা শুনে অবশ্যই কারও মনে সুখকর কোন অনুভূতি বয়ে আনতে পারে না। পুলিশের বন্দুকের নলের আগায় কেউই স্বস্তি পেতে পারেন না। কিন্তু পুলিশ নিজেও কি স্বস্তিতে ছিলেন? কল্যাণপুরে যখন পুলিশ রেইট দিয়েছিল, তখন কোন্দিক দিয়ে প্রথম গুলি ছোড়া হয়েছিল, তা কিন্তু প্রথম আলোর অজানা ছিল না। গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনার পরে পুলিশ নিজেও প্রতিটা অভিযানে ভীতসন্ত্রস্ত থেকেছে। পুলিশও মানুষ! গুলশান বা শোলাকিয়ায়ও পুলিশ কল্পনাও করেনি যে, জঙ্গীরা তাদের ওপর অতর্কিতে গুলি ছুড়বে বা হামলা করবে। একাধিক পুলিশকে আমরা ঘটনাস্থলেই নিহত হতে দেখেছি। কড়া নাড়ার পরে ঘরের ভেতর থেকে যখন কেউ দরজা খুলেছে, পুলিশ তো তখন কাউকে গুলি করেনি বা কোন অত্যাচারও করেনি। নিকট অতীতে পুলিশের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে পুলিশ বন্দুকের নল উঁচু করে না ধরে একটি লাল গোলাপ বাড়িয়ে দিলে কি মানবাধিকার রক্ষা পেত! জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এভাবে অভিযান কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরাও শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আসেনি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’ যেই চেয়ারে বেচারা মানবাধিকার কমিশনার সাহেব বসে আছেন, সেই চেয়ার থেকে যে বক্তব্য হওয়া উচিত, তিনি তাই বলেছেন অথচ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এই বক্তব্যকে হাই-লাইট করে পরোক্ষভাবে আরও যৌক্তিক করা হয়েছে এই বলে যে, পুলিশের এই ধরনের ‘ব্লক রেইড’ গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে কি বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনী হাতে চুড়ি পরে বসে থাকবে! আইনজ্ঞ শাহদীন মালিক উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘যেহেতু বেশিরভাগ তল্লাশিতে কিছু পাচ্ছে না, তাতে মনে হচ্ছে পুলিশের তথ্য ঠিক ছিল না।’ হ্যাঁ, ওই ঘরানার এই প্রবক্তার কথা সত্যি! তবে পত্রিকাটি বা শাহদীন মালিক এটাও বলেননি যে, কল্যাণপুরে ব্লক রেইডের পূর্ব মুহূর্তেও পুলিশের হাতে কোন গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। তাঁরা জানতেনও না যে, সেখানে দুর্ধর্ষ ৯ জঙ্গী ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র হাতে প্রস্তুত ছিল পুলিশ নিধনের জন্য। তাঁরা এটাও বলেননি যে, ব্লক রেইডের আওতায় খিলগাঁও, হাজারীবাগ, জুরাইন, কামরাঙ্গীরচর, শ্যামপুর, সূত্রাপুর ও উত্তরা পশ্চিম এলাকয় সাতটি তল্লাশিতে যে ৪৬ জনকে আটক করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারেও পুলিশের কাছে আগাম কোন তথ্য ছিল না। অর্থাৎ আগাম তথ্য দিয়ে পুলিশ হয়ত এক দুজনকে ধরতে পারত। কিন্তু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা সবার তথ্য কি পুলিশ পেত? প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, আগাম তথ্য থাকলে মার্কিনীদের টুইন টাওয়ার ধ্বংস হতো না জঙ্গী প্লেনের আঘাতে। আগাম তথ্য ছাড়াই ৯/১১ এর পরে ব্লক-রেইডের মাধ্যমে এফবিআই ও সিআইএর হাতে হাজার হাজার জঙ্গী আমেরিকার ভেতরে ও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরা পড়েছিল। একজন জেলে পুকুরে অনেকবার জাল ফেলে প্রতিবারই মাছসহ জাল ডাঙ্গায় তুলতে পারেন না। এ দাবি বা আবদার করাটাও হাস্যকর। আমরা মনে করি, ব্লক রেইড দেয়া না হলে কল্যাণপুরের দুর্ধর্ষ ৯ জঙ্গীর দ্বারা হয়ত গুলশান-২ এর চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারত, যা পুলিশ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রতিরোধ করেছে। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলোকে, বিশেষ করে প্রথম আলোর এ ধরনের পরোক্ষ এবং ঢালাও নেতিবাচক রিপোর্টিংয়ের আগে ভেবে দেখা উচিত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পুলিশ তাঁদের যৎসামান্য সামর্থ্যরে মধ্য দিয়েও যেভাবে জঙ্গীবাদ মোকাবেলা করছে, সেই কাজে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সহযোগিতামূলক রিপোর্ট উপস্থাপন করাই উচিত। জাতীয় স্বার্থে এবং প্রয়োজনে মিডিয়াকেও এগিয়ে আসা উচিত জঙ্গীবাদ দমনের জন্য। একটা দেশের সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই উদ্দেশ্যে কাজ করেন এবং সরকার তথা নিরাপত্তাবাহিনীকে যথাযথ সহায়তা করেন তাহলে সে দেশে কোন জঙ্গীবাদ দীর্ঘস্থায়ী বাসা বাঁধতে পারে না। লেখক : বিশ্লেষক ও সাংবাদিক ংধননরৎ.ৎধযসধহ@মসধরষ.পড়স
×