ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবাদ বেড়েছে ১১৩ শতাংশ;###;উৎপাদন ছাড়িয়ে যাবে ৮০ লাখ বেল

মহাখুশি কৃষক ॥ পাটের বাড়তি দাম

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ আগস্ট ২০১৬

মহাখুশি কৃষক ॥ পাটের বাড়তি  দাম

কাওসার রহমান ॥ এবার পাটের দাম নিয়ে কৃষক মহাখুশি। দীর্ঘদিন কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে হতাশ কৃষকের মুখে এবার হাসি ফিরেছে। এখন মণপ্রতি সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকারও বেশি দামে পাট বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমে এটাই স্বাধীনতার পর পাটের সর্বোচ্চ দাম। বাজারে নতুন পাট বিক্রির শুরুতেই বাড়তি দামের সোনালি স্বপ্ন দেখছেন কৃষক। শুধু তাই নয়, এ বছর পাটের আবাদও এক লাফে প্রায় এক লাখ হেক্টর বেড়ে গেছে। শতকরা হিসাবে পাটের আবাদ বেড়েছে ১১৩ শতাংশ। অতীতে পাট আবাদের ক্ষেত্রে এত বড় উল্লম্ফন আর দেখা যায়নি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার পাটের ফলনও হয়েছে বাম্পার। এতে পাটের উৎপাদন ৮০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে; যা গত বছরের চেয়ে ১৩ লাখ বেল বেশি। বাম্পার ফলন আর ভাল দাম পাওয়ায় এবার পাট কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো, শুকানো এবং বিক্রির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। সূত্র মতে, গত কয়েক বছর পাটের কাক্সিক্ষত দাম না পেলেও এবার দাম বাড়তে পারে এমন আশায় কৃষক খুশি। কৃষক পর্যায়ে প্রতিমণ পাট গতবার মৌসুমের শুরুতে বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। কিন্তু এবার এখনই কৃষক পাটের দাম পাচ্ছে ১৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা। তাছাড়া মৌসুমের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা মণে বিক্রি হয়েছে পাট। কাঁচাপাট রফতানি নিষিদ্ধ ও ছয়টি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার আইন কার্যকর করায় পাটের সুদিন ফিরে আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দেশের হাট-বাজারগুলোতে ইতোমধ্যে পুরোদমে পাট উঠতে শুরু করেছে। দেশের বড় পাটের মোকাম নারায়ণগঞ্জে পুরোদমে চলছে পাট কেনাবেচা। মোকামগুলোতে ঈদের পর পাটের আমদানি বেড়েছে। দামের কারণে দেশের প্রায় এক কোটি পাটচাষী মহাখুশি। তারা পাট নিয়ে সুদিনের আশায় আবার বুক বেধেছেন। সারাদেশে চাষীরা এখন পাট কেটে তা জাগ দেয়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি জমির পাট কাটা হয়ে গেছে। এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি থাকায় পাট জাগ দিতে কৃষকের তেমন অসুবিধা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষককে পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে ও পাট ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি কমাতে চলতি মৌসুম থেকে মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে পাট কিনবে বলে জানিয়েছে বিজেএমসি। শুধু তাই নয়, কৃষককে পাট বিক্রির অর্থও পরিশোধ করা হবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। সেজন্য পাটচাষীদের জন্য একটি ডাটাবেজও তৈরি করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে পাইলট প্রকল্প হিসেবে সিরাজগঞ্জকে বেছে নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে বিজেএমসি সারাদেশে ৫৬ পাট ক্রয়কেন্দ্র চালু করেছে। ইতোমধ্যে পাট কেনার জন্য শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনকে (বিজেএমসি) ২৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অবশ্য বিজেএমসির পক্ষ থেকে চলতি মৌসুমে পাট কেনার জন্য ৮শ’ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল। বিজেএমসি চলতি বছর পৌনে ২৬ লাখ কুইন্টাল পাট কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ওই পরিমাণ কেনার জন্য সংস্থাটির দরকার পড়বে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি পাট মৌসুমে ৭ লাখ ২০ হাজার ৯৮৭ হেক্টর জমিতে পাট আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই জমি থেকে এ বছর ৭৭ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আবাদ হয়েছে আট লাখ ১৭ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে। এবছর অতিরিক্ত ৯৬ হাজার ৩৯৬ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ বেশি হয়েছে। ফলে এ বছর পাটের আবাদ ৮০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গতবছর সারাদেশে ৭ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছিল। আর পাট উৎপাদিত হয়েছিল ৭৪ লাখ বেল। এর আগে ২০১৪-১৫ সালে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে এবং ২০১৩-১৪ সালে ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪৩ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়েছিল। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে কোন ফসলের আবাদ এক লাফে এক লাখ হেক্টর বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। মূলত গত বছর মৌসুমের শেষদিকে পাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষক পাট চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে কারণেই এবার পাটের আবাদ এত বেশি বেড়ে গেছে। অন্যান্য বছর পাটের বাম্পার ফলনে কৃষকের মাঝে দাম নিয়ে শঙ্কা থাকে। এবছর ঠিক তার উল্টো ঘটনা ঘটছে। সুপার বাম্পার ফলনেও কৃষক মৌসুমে ভাল দাম পাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে ছয়টি পণ্যে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কারণে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় আরও ১২ পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে। এটা হলে দেশে পাটের ব্যাগের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তখন পাটের দাম কৃষক আরও বেশি পাবে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সরকার দেশে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘উচ্চ ফলনশীল (উফশী) পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং উন্নত পাট পচন’ শীর্ষক গ্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের পাট উৎপাদনকারী ৪৪ জেলার ২শ’ উপজেলাকে এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় প্রতিবছর পাট উৎপাদনের জন্য ২ লাখ এবং পাটবীজ উৎপাদনের জন্য ৫০ হাজার মোট ২ লাখ ৫০ হাজার চাষীকে বিনামূল্যে ভিত্তি ও প্রত্যায়িত পাটবীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হ্যান্ড স্প্রেয়ারসহ প্রতিবছর ২০ হাজার চাষীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। সনাতন পদ্ধতিতে পাটের একরপ্রতি ফলন ছিল ১৮-২০ মণ। বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় আধুনিক প্রযুক্তি এবং উচ্চ ফলনশীল পাটবীজ ব্যবহার করায় পাটের একরপ্রতি ফলন ৩০-৩৫ মণে উন্নীত হয়েছে। এছাড়াও গত ৫ বছরে পাটজাতীয় ফসল অর্থাৎ কেনাফ, মেস্তার ৫ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যান্ত্রিক রিবনার আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ইতোপূর্বে দেশে গড় ৪ দশমিক ৫ থেকে ৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হতো। বর্তমানে দেশে গড়ে ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর জমিতে পাট আবাদ হয়ে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এবার অনেক অঞ্চলেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণের জমিতে পাট চাষ হয়েছে। তাছাড়া অনুকূল আবহাওয়ায় পোকার আক্রমণ কম হয়েছে। এতেও ফলন হয়েছে তুলনামূলক ভাল। সবকিছু মিলে এবার পাটের উৎপাদন হবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালী বলেছেন, এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাটের চাষ বেশি হয়েছে। আশা করছি উৎপাদনও ভাল হবে। গত বছরের মতো এ বছরও পাটের দাম আশানুরূপ পেলে চাষীরা পাট চাষে আরও এগিয়ে আসবেন। উল্লেখ্য, বিশ্বের মোট পাটের ৯০ শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতে। দুই দেশই নিজের ব্যবহারের পাশাপাশি চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে। গত বছর পাট কাটা মৌসুমে ন্যায্যমূল্য নিয়ে কৃষকের মধ্যে হাতাশা ছিল। ওই বছর পাটের ভরা মৌসুম জুলাই-আগস্টে প্রতিমণ পাটের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। অক্টোবরে এসে পণ্যটির দাম হঠাৎ বেড়ে দাঁড়ায় মণে আড়াই হাজার টাকা। কৃষক কম দামে পাট বিক্রি করলেও ফড়িয়ারা লাভ করেছেন মণে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। মূলত ভরা মৌসুমে বিজেএমসি পাট না কেনায় কৃষক সস্তায় পাট বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এবছর পাট মৌসুমেই বিজেএমসি পাট ক্রয়ে মাঠে নেমেছে। এবার পাট ক্রয়ের বিষয়টি সরাসরি তদারক করছেন পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। ইতোমধ্যে তিনি বিজেএমসিতে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে পাট ক্রয়ে গুণগত মান বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগে খোলা আকারে পাট কেনা হতো, তাতে গুণগত মান নিয়ে সন্দেহ থাকত। তাই বেল আকারে পাট কিনতে হবে, যাতে গুণগত মান বজায় থাকে। বেল আকারে পাট কিনলে গুণগত মানে নিয়ে কোন সংশয় থাকবে না। যশোরের শার্শার পাকশিয়া গ্রামের পাট চাষী ময়না মিয়া জানান, তাদের এলাকায় এবার অনেকে পাট চাষ করেছেন। ফলনও ভাল হয়েছে। তিনি আরও জানান, তাদের এলাকার কৃষক ভারতের বীজ ব্যবহার করছেন। ভারতের বীজে প্রত্যেকটি চারা হয়। আবার গাছও মোটা হয়েছে। বিঘাপ্রতি পাটের উৎপাদন হয়েছে ১০ থেকে ১২ মণ হারে। এক বিঘা জমিতে পাট উৎপাদন করতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লেগেছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পাট চাষী নাহার আলী বলেন, গতবছর আমি ৫ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। বিঘাপ্রতি ৯ মন করে পাট পেয়েছিলাম। বাজারে বিক্রি করেছি ২০০০ টাকা দরে। পাট আবাদ করে গতবছর আমি প্রায় ৯৫ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে সেখান থেকে আমি প্রায় ২০-২২ মণ পাটকাঠি পেয়েছিলাম। সেগুলো বিক্রি করেছি ২০০ টাকা মণ দরে। আর এবার পাটের বাজার ভাল। এবার আমি ৭ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। এবারও ভাল ফলন পাব বলে আমি মনে করি। রাজশাহীর পবা উপজেলার মনসুর জুটমিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনসুর রহমান বলেন, এবার পাটের ব্যবসা নিয়ে তারা প্রচ- আশাবাদী। গত মৌসুমের শুরুতে ১৪শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি হয়েছে। আর ভরা মৌসুমে পাটের দাম বাড়তে বাড়তে ২৪শ’ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবার শুরুতেই পাটের দাম ১৭শ’ থেকে ১৯শ’ টাকা মণ। শেষ পর্যন্ত তা ২৮শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা সবাই লাভবান হবেন। এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টির কারণে দেশে পাটের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে কৃষক তাদের উৎপাদিত পাটের ভাল দাম পাচ্ছে। আর ভাল দাম পাওয়ার কারণে কৃষক এখন পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এবছর দেশে পাটের উৎপাদন একলাফে ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত বছরের চেয়ে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে এবার পাটের আবাদ বেশি হয়েছে।
×