ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাখাওয়াতের ফাঁসি, সাত রাজাকারের আমৃত্যু কারাদণ্ড

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১১ আগস্ট ২০১৬

সাখাওয়াতের ফাঁসি, সাত রাজাকারের আমৃত্যু কারাদণ্ড

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যশোরের কেশবপুরের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির নেতা সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদ- অন্য সাত রাজাকারকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করেছেন ট্রাইব্যুনাল। সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিতে অথবা গুলি করে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করতে পারবে। চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করে। সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে এ রায় পড়া শুরু হয়। রায়ে মোট ৭৬৮ পৃষ্ঠা আর ১১৩৯টি প্যারা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল সংক্ষিপ্ত রায়ে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচ অভিযোগের সবই প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে চারজন, দ্বিতীয় অভিযোগে আটজন, তৃতীয় অভিযোগে চারজন, চতুর্থ অভিযোগে পাঁচজন এবং পঞ্চম অভিযোগে ছয়জন আসামি ছিলেন। রায়ে দ্বিতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে সাখাওয়াতের মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়ে আদালত বলেছে, সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার দ- কার্যকর করতে পারবে। আর মোঃ বিল্লাল হোসেন বিশ্বাস, মোঃ ইব্রাহিম হোসাইন, শেখ মোঃ মজিবুর রহমান, এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম ও মোঃ আব্দুল খালেককে দেয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদ-। এছাড়া প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম অভিযোগে আসামির বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল তার রায়ে পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সাহায্য নেয়ার কথাও বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ৭৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন। অপর বিচারপতি মোঃ সোহরাওয়ার্দীও এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। সবশেষে চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাজা ঘোষণা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ’৭১ সালের এমন অনেক তথ্য রয়েছে, যা সভ্যতা এবং আমাদের দেশের মানুষের অজানা। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। রায়ে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের গুলিতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যদাতা মিরন শেখকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নির্দেশ দিয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যশোরের কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের জোবেদ আলী শেখের ছেলে যুদ্ধাহত মিরন শেখ বর্তমানে ভিক্ষার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। রায়ে মিরন শেখ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে বিচারক এক পর্যায়ে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের পবিত্র আকাক্সক্ষা এই যে, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যশোরের কেশবপুরের মহাদেবপুর গ্রামের জোবেদ আলী শেখে ছেলে মিরন শেখের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় যুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’ রায় ঘোষণার সময় আসামিদের মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাখাওয়াত ও বিল্লাল হোসেন রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। বাকি ছয়জনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার চলে। এ মামলায় অভিযুক্ত আরেক আসামি মোঃ লুৎফর মোড়ল কারাবন্দী থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করবেন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ২৬তম রায়। এর আগে আরও ২৫টি রায় প্রদান করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ২৬টি মামলায় ৫২ জনকে বিভিন্ন দ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যুদ-, একজনের যাবজ্জীবন, একজনের ৯০ বছরের কারাদ- এবং ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে পলাতক আছে ২১ জন। প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ্ট ॥ এ রায়ে প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করছি। এ রায়ের ফলে কেশবপুরসহ সারাদেশের ভিকটিম, শহীদ পরিবার, বিচারপ্রার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে। অন্যদিকে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, যুদ্ধ চলাকালে ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ’৭১ সালে যারা এসব অপরাধ করেছে তারা সকলেই মানবতার শত্রু। আজকে যাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করা হয়েছে শুধু তারাই নয়, যারা এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা সকলেই মানবতার শত্রু। তিনি আরও বলেন, ’৭১ সালের এমন অনেক তথ্য রয়েছে, যা সভ্যতা এবং আমাদের দেশের মানুষের অজানা। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে তা উঠে এসেছে। দেরিতে হলেও নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণ, নির্যাতনকে স্বাধীনতাকামীদের দমনে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এ রায় বিচারের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনজনের আত্মত্যাগের বিষয়টি স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা হলেনÑ শহীদ মিরন শেখ, শিশু আব্দুল মালেক সরকার এবং মহীয়সী নারী আশুরা খাতুন। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যও বলা হয়েছে রায়ে। পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। আপীল করা হবে ॥ আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনকে ‘রাজনৈতিক কারণে’ জড়ানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে তার মক্কেল সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করবেন। সেখানে ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। আব্দুস সাত্তার বলেন, রায়ে সাখাওয়াতকে যশোরের কেশবপুরের চিংড়া রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে দেখানো হলেও প্রসিকিউশন এ বিষয়ে কোন দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেনি। যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রসিকিউশন দাখিল করেছিল তাদের একজনের বক্তব্য বিশ্বাস করলে অন্যজনের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য না। তাই আমরা মনে করি, সাখাওয়াত হোসেনকে রাজনৈতিক কারণেই এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে পলাতক আসামিপক্ষের আইনজীবী আব্দুস শুকুর বলেন, আসামিরা পলাতক বিধায় কিছু বলতে পারছি না। তারা যদি আদালতে থাকতেন তা হলে রায় অন্যরকম হতে পারত। যে অভিযোগে দ- ॥ পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে চারজন, দ্বিতীয় অভিযোগে আটজন, তৃতীয় অভিযোগে চারজন, চতুর্থ অভিযোগে পাঁচজন এবং পঞ্চম অভিযোগে ছয়জন আসামি ছিলেন। প্রমাণিত প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের বাংলা ২৭ আশ্বিন সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে চিংড়া বাজার রাজাকার ক্যাম্পের (তহসিল অফিস) কমান্ডার সাখাওয়াত হোসেনের নির্দেশে ১০ থেকে ১২ জন রাজাকার কেশবপুর থানার বগা গ্রামে একজন নারী এসএসসি পরীক্ষার্থীকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং ধর্ষণ করেন। এ অপরাধে সাখাওয়াত হোসেন, মোঃ ইব্রাহিম হোসেন, মোঃ আব্দুল আজিজ সরদার ও মোঃ আজিজ সরদারকে বিশ বছর করে কারাদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৮ আশ্বিন আনুমানিক ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে কেশবপুর থানার ২নং সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদ চাদতুল্য গাজীকে সাখাওয়াতসহ ২৫/৩০ জন রাজাকার ধরে নিয়ে যান। এরপর তাকে চারদিন আটক রেখে নির্যাতন করে ১ কার্তিক গুলি করে হত্যা করে। এ অপরাধে সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। অন্য সাতজনকে দেয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদ-। তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৮ আশ্বিন চিংড়া গ্রামের নূর উদ্দিন মোড়লকে ধরে নিয়ে সাখাওয়াতের নির্দেশে নির্যাতন করা হয়। এ অপরাধে সাখাওয়াত হোসেন, মোঃ ইব্রাহিম হোসেন, শেখ মোহাম্মদ মুজিবর রহমান ও মোঃ আব্দুল খালেক মোড়লকে দশ বছর করে কারাদ-াদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। চতুর্থ অভিযোগ বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের আশ্বিন মাসের শেষদিকে এক রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স কেশবপুর থানা হিজলডাঙ্গা গ্রামের আঃ মালেক সরকারকে তার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে ২৮ আশ্বিন সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে চিংড়া বাজারে গুলি করে হত্যা করে সাখাওয়াত। এ অপরাধে সাখাওয়াত হোসেনকে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। মোঃ ইব্রাহিম হোসেন, মোঃ আব্দুল আজিজ সরদার, মোঃ আজিজ সরদার ও মোঃ আব্দুল খালেক মোড়ল পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদ- দেয়া হয়েছে। পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের আশ্বিন মাসের প্রথম দিকে বেলা ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা মিরন শেখকে তার বাড়ি থেকে ১০/১২ জন রাজাকার ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি পালাতে চাইলে রাজাকাররা তাকে গুলি করেন। এতে তার বাম হাতে গুলি লাগে। এরপর তাকে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ অপরাধে সাখাওয়াত হোসেন, মোঃ ইব্রাহিম হোসাইন , এম এ আজিজ সরদার, আব্দুল আজিজ সরদারও আব্দুল খালেককে ১৫ বছর করে সশ্রম কারাদ- প্রদান করা হয়েছে।
×