ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোজাম্মেল খান

জঙ্গী দমনে প্রয়োজন অভীষ্টের ঐক্য

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৯ আগস্ট ২০১৬

জঙ্গী দমনে প্রয়োজন অভীষ্টের ঐক্য

গুলশান ক্যাফে হত্যা-ট্র্যাজেডির পর সামাজিক মিডিয়ার পাশাপাশি দেশে এবং বিদেশে মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী শোক প্রকাশকারীদের মধ্যে এক ইতিবাচক ঐকমত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, আর সেটা হলো সরকার পরিচালিত সঙ্কট সমাধানের পদ্ধতি এবং নীতিমালার ব্যাপারে। সবচেয়ে অভূতপূর্ব বিষয় ছিল প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল যারা সরকারের সঙ্কটের হ্যান্ডলিংয়ে সরকারের কাজের প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়ে। গুলশান হামলার পর ৩ জুলাই একটি লিখিত বিবৃতিতে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বললেন : ‘কোন অর্জনই টিকবে না, যদি সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করতে না পারি। তাই আসুন সন্ত্রাসবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলি।’ খালেদা আরও বলেন, ‘আমাদের একতাবদ্ধ হতেই হবে। কে ক্ষমতায় থাকবে, কে থাকবে না এটি বড় কথা নয়। একদিন আমরা কেউ থাকব না, কিন্তু দেশটা থাকবে।’ খালেদা জিয়ার কাছ থেকে এত সুন্দর বক্তব্য আমি কোনদিন শুনিনি। তার বিবৃতিটি শুনে মনে হয়েছিল এটি বরং একজন রাজনীতিবিদের চেয়ে একটি রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে আসছে। কিন্তু তার পরের দিন তিনি আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন। কমান্ডো অভিযান চালাতে দেরি করা হয়েছে অভিযোগ করে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘তারা যখন গেছে, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। এত দেরি কেন? এত দেরিতে কেন সে কাজটি করা হলো?’ খালেদা জিয়া দাবি করেন, এটা সরকারের গাফিলতি বা ব্যর্থতা। সরকারের অযোগ্যতার কারণেই এটি হয়েছে। সরকার আজ পর্যন্ত কোন ঘটনাই ঠিকমতো মোকাবেলা করতে পারেনি। খালেদা জিয়া দাবি করেন, ‘আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অভাবে দেশে একের পর এক জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রথম থেকেই সরকার ব্যর্থ। সরকারের উচিত ব্যর্থতার দায় নিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া।’ স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভাবনা ও পরামর্শ বেরিয়ে এসেছে সরকার সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলায় কি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এ ধরনের হত্যা প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে কমবেশী সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাস-সমর্থকদের ছাড়া কোন দেশ নেই এবং বিশেষ করে যে দেশের বিরাট জনগোষ্ঠী যে ধর্মে বিশ্বাসী, দুর্ভাগ্যবশত, যার নামে সন্ত্রাস সংঘটিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক শেষে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি, কমিউনিটি পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেনÑ ‘তবে ইনশাআল্লাহ, সন্ত্রাসীদের শিকড় উৎপাটন করার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করব ... কোন ষড়যন্ত্র আমাদের অগ্রগতি রোধ করতে পারবে না। চলুন একসঙ্গে কাজ করি, আমাদের সমস্ত মতপার্থক্য পিছনে ফেলে এক নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করি।’ ২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর আবারও সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের মূল উৎপাটন করে জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে বললেন, তাঁর সরকার এসব অপরাধ কোন অবস্থাতেই বরদাস্ত করবে না। ‘যাই হোক না কেন, যে নাম বা যে আকারে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের আবির্ভাব ঘটুক না কেন এই সামাজিক অপরাধকে নির্মূল এবং ধ্বংস করতেই হবে’ বলে পুনর্ব্যক্ত করলেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় বিএনপির জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দাবির জবাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, যাদের জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে লিঙ্ক আছে এবং যুদ্ধাপরাধের রেকর্ড আছে তারা ব্যতীত, দেশের মানুষের সবার মধ্যে ইতোমধ্যে একটি সমঝোতা হয়ে গেছে। ‘সাধারণ মানুষের ঐক্য, যা সত্যিই সন্ত্রাসীদের নির্মূলের জন্য প্রয়োজন তাদের ঐক্য ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে এবং সেই ঐক্য টিকে থাকবে’, বললেন প্রধানমন্ত্রী। তবে যে দলটি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের জন্য প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে, তারা বললেন, ‘কি করে এই ঐক্য বিএনপি ও অন্যান্য দলের ছাড়া গঠিত হয়? কিভাবে একটি জাতীয় ঐক্য সম্ভব বিএনপি ছাড়াই- যে দলটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে’, বললেন নজরুল ইসলাম খান, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ১৮ জুলাই একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে। ‘প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য আমাদের হতাশ করেছে’, বললেন বিএনপি নেতা। তিনি একটি জাতীয় ঐক্য গঠনের জন্য দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান। জাতীয় ঐক্য নিয়ে এ ধরনের একটি বিতর্কের প্রেক্ষাপটে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশেষ দল ‘ঝঃড়ৎস ২৬’ নামে এক অতর্কিত অপারেশনে ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে একটি ফ্ল্যাটে ৯ সন্দেহভাজন জঙ্গী নিহত হয়। ‘এটা সবচেয়ে সফল অপারেশনগুলোর অন্যতম। আমরা জঙ্গীদের একটি গ্রুপ নির্মূল করতে পেরেছি’Ñ বললেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে। তিনি বলেন, ‘জঙ্গীরা হঠাৎ ভবনের চতুর্থতলা থেকে গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে তাদেরকে মোকাবেলা করতে হয়।’ এ ঘটনার পরবর্তী কয়েক দিন ধরে নিহত জঙ্গীদের পরিচয় বিস্তারিত মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে রয়েছে রায়হান কবীর নামের একজন যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, গুলশান ক্যাফে হামলার বন্দুকধারীদের প্রশিক্ষক ছিল, জানিয়েছেন ডিএমপির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা। কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গী আবদুল্লাহর বাবা বলেন, ‘এটা তার জন্য অপমান যে তার ছেলে একজন জঙ্গী হয়ে উঠেছে।’ তা সত্ত্বেও ২৭ জুলাই বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ (যার বাবা মোনেম খানের মন্ত্রী ছিলেন) বললেন, ‘পুলিশ দাবি করেছে যে কল্যাণপুরে নিহতরা সবাই জঙ্গী ছিল তা সন্দেহাতীত নয়। হতাহতের মধ্যে নির্দোষ মানুষও থাকতে পারে।’ একই অনুকরণে পরের দিন, রাজধানীর কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত ব্যক্তিরা আসলেই জঙ্গী কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। কল্যাণপুরে নিহতদের সম্পর্কে তার সন্দেহ হলো কেনÑ তাদের পিঠে গুলি লেগেছে। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আর কয়েকজন বিএনপি নেতা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে কল্যাণপুরে ৯ জঙ্গীকে হত্যা নিয়ে বিএনপি নেতাদের এসব বক্তব্য এবং সংশয়ের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন রাখলেন, তাহলে কি জঙ্গীদের সঙ্গে ঐ দলের গোপন যোগাযোগ ছিল? সংসদের বাজেট অধিবেশনে তার সমাপনী বক্তৃতায় নিহত জঙ্গীদের বিষয়ে বিএনপি নেতাদের মায়াকান্নায় প্রশ্ন তুলে বললেন, ‘কেন তাদের [বিএনপি নেতাদের] জঙ্গীদের প্রতি এত স্নেহ প্রকাশ পায়? এটাই আমার প্রশ্ন? তারা কি কোন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত আছেন?’ বস্তুত, নিহত জঙ্গীদের ‘নির্দোষ’ পরিচয় করার ব্রত নিয়ে বিএনপি নেতাদের বিবৃতি সামাজিক মিডিয়াতে ব্যাপক আকারে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সাবেক একজন বামপন্থী ছাত্রনেতা, যিনি বর্তমানে এক কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘কল্যাণপুরে নিহত ৯ তরুণ আসলে জঙ্গী কিনা সন্দেহ হান্নান শাহর এবং বিএনপি তার প্রতিবাদ না করায় ধরে নেয়া যায় এটা বিএনপিরও বক্তব্য। কিন্তু কেন এমন সন্দেহ? লাশগুলো কেবল কিছু জঙ্গীর সে কারণেই কি? যেহেতু এর সঙ্গে দেশী-বিদেশী বিশেষ বা সাধারণ নাগরিক, পুলিশ-সেনাদের লাশ নেই সেই কারণেই কি এই সন্দেহ? তাহলে গুলশান হত্যাকা-ের ঘটনায় কিভাবে তারা বুঝতে পারলেন, নিশ্চিত হলেন, সেই তরুণরা জঙ্গী ছিল? বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এভাবেই পথ হারাবে! সঙ্গে কি বিএনপিও? দলটি তার কোন ইস্যুতেই স্থির থাকতে পারেনি। উপযুক্ত নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তের অভাবে কেবল পথ খুঁজতেই থাকবে।’ বাংলাদেশের মেরুকরণের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ঐক্যের মোহ, যেখানে বিভাজন রেখা, দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার রক্তমাখা ইতিহাস, যে কতটা অবাস্তব সেটা আবারও সামনে উঠে এল। ১ জুলাই গুলশান ক্যাফের ওপর মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে অন্তরঙ্গনে নয়তবা বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তায় মানববন্ধনের মাধ্যমে। এইসব প্রতিবাদকারীর পরিচয়ের দিকে তাকালে দেখা যাবে এরা তারাই যারা গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল দিনগুলোয় রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, যারা তাদের হৃদয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ এবং চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার ও এর প্রক্রিয়াকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। গণজাগরণ মঞ্চের সুবর্ণ দিনগুলোয় ঐক্যের যে ব্যাপ্তি-জাল বিস্তারিত হয়েছিল বিশ্বব্যাপী তার সঙ্গে শুধু ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যই তুলনীয়। দুটো স্বর্ণ অধ্যায়েই ছিল অভীষ্ট লক্ষ্যের ঐক্য, সে সময়ে দলের ঐক্যের কোন প্রয়োজন হয়নি। এটা আবারও প্রমাণিত হলো যে, আমাদের জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলায় উদ্দেশ্যের ঐক্যই সত্যিকার পথনির্দেশক নীতি, মেরুকরণীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কল্পনারাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য নয়। আর আমাদের জাতীয় চ্যালেঞ্জের এই সন্ধিক্ষণে প্রধানমন্ত্রী অতি সঙ্গতভাবেই দৃঢ়তার সঙ্গে পুনরুল্লেখ করেছেন, ‘সাধারণ মানুষের ঐক্য, যা সত্যিই সন্ত্রাসী নির্মূলের জন্য প্রয়োজন তাদের ঐক্য, ইতোমধ্যে যা গড়ে উঠেছে।’ লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
×