ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহী অঞ্চলে একই আদলে, আদর্শে বিদ্যমান আরও বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার

নাম পোশাক পাল্টে চলছে পিস স্কুল

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৭ আগস্ট ২০১৬

নাম পোশাক পাল্টে চলছে পিস স্কুল

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ নিষিদ্ধ ঘোষণার পর নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি সাইনবোর্ড, পোশাক এবং স্কুলব্যাচও বদলে ফেলেছে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় সব পিস স্কুল। এভাবে দেদার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব কার্যক্রম। সেসব স্কুলের একটি এখন লিজেন্ড একাডেমি। অথচ জানামতে, এজন্য কোথাও থেকে কোন অনুমোদন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। সরকারের ঘোষণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জেও পিস স্কুল-কলেজের কার্যক্রম বহাল রাখা হয়েছে। একটির আগে ইম্পেরিয়াল ও অপরটির আগে প্রাইম ব্যবহার করে দিব্যি চালু রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। অথচ ভেতরে ভেতরে পিস স্টাইল ও আদলে চলছে আগেকার সব কিছুই। এমনকি পিস নামের কোচিং সেন্টারও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বহাল রয়েছে। জানা গেছে, বন্ধ ঘোষণার অধ্যাদেশের কপি এখনও দেশের সব পিস স্কুলে এসে পৌঁছেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শ্রেণীকক্ষ, পাঠ্যবই সবই আগের মতো আছে। শুধু পিস স্কুলের নামের ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে ‘লিজেন্ড একাডেমি’। এর পাশাপাশি স্কুলের ছাত্রদের আগের মতো আর হিজাব পরতে দেয়া হচ্ছে না। ছাত্রদেরও মাথায় টুপি দিতে বারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিস স্কুল বন্ধের নির্দেশনা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। তারা এরই মধ্যে স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ফেলেছে। নতুন নামে স্কুল পরিচালনার জন্য যা যা করা দরকার তারা করছে। সর্বশেষ গেল বৃহস্পতিবারও নগরীর তেরখাদিয়া এলাকায় আগের সেই পিস স্কুলটির সবকিছুই চলেছে একই কায়দায়। স্থানীয়রা জানান, নিষিদ্ধ ঘোষণার পর জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের পর ছাত্রদের পোশাক পরিচ্ছদও বদলে ফেলেছে। এখন স্কুলের ছাত্রীরাও আর হিজাব পরে না, ছাত্ররা পরে না মাথায় টুপি। অথচ এ স্কুলে মেয়েদের হিজাব ও ছেলেদের টুপি ছিল বাধ্যতামূলক। স্কুলের নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমান মোবাইল ফোনে জানান, গত ১৪ জুলাই থেকে স্কুলের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি এখন ‘লিজেন্ড একাডেমি’ নামে পরিচালিত হচ্ছে। আর স্কুলটির নাম পরিবর্তন করায় শিক্ষার্থীদের পোশাকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই আগের মতোই আছে। তিনি আরও জানান, সরকারের পিস স্কুল বন্ধের নির্দেশ নিয়ে তারা চিন্তিত নয়। কারণ তারা স্কুলের নামই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। কয়েকজন অভিভাবক জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্তে চিন্তিত না হলেও তারা (অভিভাবক) উদ্বিগ্ন। কিছুদিন আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ রাতারাতি স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ফেলে। এখন স্কুলটি আদৌ চলবে কি-না, তা নিয়ে তারা চিন্তায় পড়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্কুলটি পরিচালনা করেন জামায়াতের কিছু লোকজন। জামায়াতের টাকাতেই স্কুলটি পরিচালনা করা হয়। ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখার কর্মকর্তা মোরশেদ জামান স্কুলটির দেখভাল করেন। আর অধ্যক্ষ আলাউদ্দিনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। স্কুলটির নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিকুর রহমানও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬০ জন। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) পারভেজ রায়হান বলেন, নাম পরিবর্তন করলেই স্কুলটি প্রশাসনের নজর এড়াতে পারবে না। হঠাৎ করে নাম পাল্টে ফেলার মধ্য দিয়েই তাদের দুর্বলতা বোঝা যায়। পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে খুব শীঘ্রই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। সূত্র আরও জানায়, জাকির নায়েকের পিস টিভির সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেশকিছু মহলে ও মাজহাবের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার অর্ধেক এলাকায় আহলে হাদিস গোত্রের মাজহাবের সংখ্যা খুবই বেশি। এরা একদিকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমর্থক, পাশাপাশি জাকির নায়েকের অন্ধ ভক্ত হওয়ার কারণে প্রতিদিন নিয়মিত পিস টিভিতে জাকির নায়েকের বক্তৃতা ও ভাষণ ঝাঁক বেঁধে, কোথাও কোথাও মজলিস করে শোনার অভ্যাস করেছিল। জাকির নায়েকের এসব অনুসারী বয়ান শুনে চুপ না থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণসহ চায়ের স্টল ও বিভিন্ন স্থানে বসে সঠিক বক্তব্যের ধারক-বাহক সেজে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সেসব ব্যাপকভাবে প্রচার করত। শহরের শান্তির মোড়ে একটি বিশাল ভবনে রাতারাতি সাইনবোর্ড ওঠে যায় পিস আন্তর্জাতিক স্কুল ও কলেজের। সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা সংযোজন করে সঙ্গে ছাত্র হোস্টেল জুড়ে দিয়ে শুরু করা হয় ভর্তি। কিছুদিনের মধ্যে ১ম শ্রেণী থেকে ইলেভেন ক্লাস পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তির লাইন পড়ে যায়। তিনতলা এ ভবনের মালিক আওয়ামী লীগের এক নেতা। তিনি জেলা কমিটির একটি বড় পদ নিয়ে রেখেছেন। কয়েকটি ধাপে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও বিজয় ছিনিয়ে আনার রেকর্ড রয়েছে তার। এমনকি জেলা পুলিশিং কমিটিতেও তার নাম প্রথমদিকে রয়েছে। সরাসরি তার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে জানা যায়, তিনি মাসে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভবনটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষকদের মধ্যে একাধিক মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন। অপরটির অবস্থান শিবতলা মোড়ে বাবরি মসজিদের কাছাকাছি একটি বাড়িতে। এটি প্রথমে খোলা হয় পিস একাডেমি নামে নার্সারি থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত। বাসাটি ভাড়া করা বলা হলেও এর মালিক গোলাম মোস্তফার বাবা প্রয়াত হারুন বিশ্বাস ছিলেন জামায়াতের একনিষ্ঠ কর্মী। এ মহল্লার অধিকাংশ পরিবারের মুর্শিদাবাদ কানেকশন রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের একান্ত চিন্তা-চেতনার সিলেবাসে পরিচালিত হলেও সবকিছু তছনছ হয়ে পড়ে রয়েছে। জেলার দুটি প্রতিষ্ঠানের আদি নামের (পিস) সাইন বোর্ড পরিবর্তন হয়ে প্রথমটিতে লেখা হয়েছে ‘ইম্পেরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ।’ আর বাবরি মসজিদ (শিবতলার মোড়) সংলগ্ন পিস একাডেমির সাইন বোর্ড তুলে লেখা হয়েছে ‘প্রাইম একাডেমি’, যা সরকারী পিস স্কুল বন্ধের ঘোষণার পরও চালু রয়েছে। তবে বিভিন্ন সোর্স বলছে, নাম বদল হলেও পিস স্কুল, কলেজ ও একাডেমির আদলেই এখনও লেখাপড়া চলছে। শিক্ষকদের অভিমত, যেহেতু পিস স্কুল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তাই সাইনবোর্ড বদলানো হয়েছে। তবে পিস স্কুলের সিলেবাসসহ অন্যান্য সব ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। অবিভাবকরা যোগাযোগ করলেও একই কথা বলে আশ্বস্ত করেন কর্তৃপক্ষ। পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পিস স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে এখনও লোগো ব্যবহার ও সিলেবাস কেন চালু আছেÑ এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর না দিয়ে ভিন্নকথা বলার চেষ্টা করেন। একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে গড়ে ওঠা (শিবতলার) পিস একাডেমি (বর্তমানে প্রিমিয়ার একাডেমি) কর্তৃপক্ষ কোন কথা বলতে চাননি। মজার ব্যাপার এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে সরকারী মহিলা কলেজের গেটের কাছে প্রয়াত জহুরুল ইসলামের বিশাল বাড়িতে দুটি অংশে এখনও পিস কোচিং নাম দিয়ে (৪ আগস্ট) কোচিং ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে দুই তরুণ। একজনের নাম শামীম রেজা রিটন ও অপরজন সেলিম। এখানে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৬০ এর অধিক। আরও রহস্য ঘনীভূত হয়েছে পুলিশ সুপার নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান (পরিদর্শক) আকমন হোসেন জেলা শহরে দুটি পিস স্কুল, কলেজ ও একাডেমির খবর দিতে পারলেও জেলায় এর মোটসংখ্যা কত, তা বলতে পারেননি।
×