ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নদী ভাঙ্গন এখন বড় সমস্যা

বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে সব নদীর পানি কমছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৫ আগস্ট ২০১৬

বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হচ্ছে সব নদীর পানি কমছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বেশিরভাগ নদীর পানিই কমতে শুরু করেছে। বন্যা পরিস্থিতিও দ্রুত উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে পানি নেমে যাওয়ার পথে উপকূলে নদী মোহনায় কিছু জেলায় নতুন করে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মূলত ভাঙ্গাবাঁধ এবং অমাবস্যার কারণে জোয়ারে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলের কয়েকটি জেলা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এদিকে বন্যার পানি দ্রুত নামলেও বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙ্গনের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে বন্যার্তরাও নতুন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। বৃহস্পতিবার মাত্র ২২ স্থানে নদ-নদীর পানি বাড়ার খবর পাওয়া গেছে। এর বাইরে সমতলের পর্যবেক্ষণ স্টেশনের ৫৮টি স্থানের পানি দ্রুত কমছে। বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে মাত্র ১৬টি স্থানের পানি। এর মধ্যে ধলেশ্বরীর দুটি স্থানের পানি এবং পদ্মার গোয়ালন্দের পানি বিপদসীমার বেশি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৬ স্থানে নদীর পানি বিপদসীমার কিছু ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বিপদসীমার মাত্রা আগের চেয়ে অনেক নিচে নেমে এসেছে। ঢাকার চার নদী বিশেষ করেÑ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এখনও বাড়ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত এ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। বৃহস্পতিবারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বালু নদীর পানি ডেমরায় ১৫ সেন্টিমিটার ও তুরাগের পানি মিরপুরে ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এর ফলে ঢাকায় বন্যার কোন আশঙ্কা নেই বলে তারা জানিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, উত্তর ও মধ্যাঞ্চল থেকে পানি নামতে শুরু করলেও ভাটিতে গিয়ে মোহনার কাছে কিছু কিছু জেলায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। মূলত বন্যা হচ্ছে অমবস্যার প্রভাবে নদী মোহনায় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে। একই কারণে ভোলার সদর, তজুমদ্দিন ও মনপুরায় ২০ গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার জানিয়েছেন। অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার এলাকায় মেঘনা নদীতে পানির চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে। অমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রভাবে গত কয়েক দিন ধরে ভোলা সদরের রাজাপুর, পূর্ব-ইলিশা, পশ্চিম-ইলিশা ইউনিয়ন জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। রাজাপুর, পূর্ব-ইলিশা ও পশ্চিম-ইলিশার কয়েকটি সড়ক ডুবে গেছে। এলাকার অধিকাংশ স্কুল-মাদ্রাসা পানির নিচে ডুবে রয়েছে। ওই সব এলাকার বাড়িঘর, ফসলের ক্ষেত ও পুকুর ডুবে গেছে। মানুষ গবাদিপশু ও ঘরের আসবাব নিয়ে জংশন-আলীমাবাদ বাঁধ সড়কে ওঠে আশ্রয় নিয়েছে। অপরদিকে তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানিতে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়া মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মাঝে জেগে ওঠা শতাধিক চর অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে। ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে চরাঞ্চলসহ বেড়িবাঁধের বাইরের ৩০ সহস্রাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে উপকূলীয় জেলা বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে জোয়ারের পানিতে ভাসছে বরগুনার ছয় উপজেলার ৪৫টি গ্রামের অর্ধলক্ষ মানুষ। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ফসলের জমি ও মাছের ঘের। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে জেলায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বাঁধে ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। উপকূলীয় জেলা হওয়ার কারণে ঝালকাঠিতে পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি জোয়ারের পানির কারণে নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ছে। তবে এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে এলাকায় ফসলের ক্ষতি হতে পারে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলে সব নদী থেকে পানি দ্রুতই নেমে যাচ্ছে। আগামীতে এ ধারা অব্যাহত থাকবে। উজানে বৃষ্টিপাত না থাকায় ও দেশের ভেতরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। ফলে জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। এদিকে মধ্যাঞ্চল থেকেও বন্যার পানি নামার কারণে রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর জেলাসমূহের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। আগামীতে পদ্মা নদীর পানি হ্রাস পাওয়ার পূর্বাভাসও দেয়া হয়েছে। পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে এ অঞ্চলে নতুন করে বন্যার আশঙ্কা আপাতত নেই বলে তারা জানিয়েছে। বেশিরভাগ এলাকা থেকে পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ এখনও কমেনি। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও অনেকে এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে যারা আশ্রয় নিয়েছে তারা এখনও বাড়িঘরে ফিরতে পারেনি। বন্যায় ফসল ও গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও গবাদিপশুর ব্যাপক খাদ্য ও আশ্রয় সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফরিদপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পানি কমলেও বন্যাদুর্গত মানুষের দুর্ভোগ লাঘব হয়নি। জেলায় বন্যা শুরু হওয়ার পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচটি উপজেলায় মোট পাঁচ হাজার দুই শ’ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে আউশ এক হাজার ৫০৯, বোনা আমন দুই হাজার ৪১৮, রোপা আমন বীজতলা ২৩, রোপা আমন এক হাজার ১১০ ও বিভিন্ন ধরনের সবজি ১৪০ হেক্টর। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যাদুর্গত পরিবারের মধ্যে চার শ’ মেট্রিক টন চাল ও নগদ নয় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বন্যাদুর্গত মানুষরা গো-খাদ্য নিয়ে তীব্র সঙ্কটে পড়েছে। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী বলেছেন, গো-খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী যাতে কিনতে পারে এজন্যই দুর্গতদের মধ্যে নগদ নয় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, ধলেশ্বরী নদীর পানি কমলেও দেলদুয়ারের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল আটিয়া, দেউলি, এলাসিন, লাউহাটি ও ফাজিলহাটি ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ধলেশ্বরী নদীসংলগ্ন হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেউলী ইউনিয়ন। দেউলী ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই বন্যাকবলিত। ইতোমধ্যে দেউলী-ঝুনকাই বেড়িবাঁধে কয়েকটি স্থানে ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া ছিলিমপুর-ঝুনকাই রাস্তার দুটি স্থানে, মাইঠাইন-চকতৈল রাস্তার মাইঠাইনে, ছিলিমপুর-দেউলী রাস্তার স্থলবর্ষা নামক স্থানে ভেঙ্গে গেছে। ধলেশ্বরী নদীর তীব্র ভাঙ্গনে ২ শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ৪৫টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যাকবলিত হওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ৩শ’ হেক্টর লেবু, ৭০ হেক্টর বীজতলা, ১ হাজার হেক্টর বোনা আমন, ৪শ’ হেক্টর রোপা আমন, ১শ’ ২০ হেক্টর সবজি, ১৫ হেক্টর আউশ ও ৪৫ হেক্টর জমির কলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। কুড়িগ্রাম থেকে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার জানান, বন্যা পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে ভাঙ্গন। নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি থাকায় আশ্রয় কেন্দ্র ও উঁচু বাঁধের অধিকাংশ আশ্রিত মানুষ ঘরে ফিরতে পারেনি। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে নদীর তীব্র ভাঙ্গন। যাত্রাপুর এলাকার প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি দুধকুমোর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কয়েক দিনে এসব এলাকায় প্রায় ৫শ’ মানুষের ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি ব্রহ্মপুত্র এবং দুধকুমোর নদীর ভাঙ্গনে ভেঙ্গে গেছে। এছাড়াও ব্রহ্মপুত্রের চিলমারীর রমনা, উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর, শ্যামপুরে ব্যাপক ভাঙ্গন চলছে। এদিকে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও ওষুধ সঙ্কট রয়েছে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিভাগের ৮৫টি টিম কাগজকলমে থাকলেও মাঠপর্যায়ে তাদের দেখা মিলছে না। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করা হলেও সমন্বয়ের অভাবে প্রকৃত বানভাসীদের অনেকেই ত্রাণ সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
×