ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এম. নজরুল ইসলাম

আমাদের নেতা ও রোল মডেল

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৫ আগস্ট ২০১৬

আমাদের নেতা ও রোল মডেল

এখনও মনে হয় এই সেদিনের কথা। টিএসসি পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। পাশেই সবুজ চত্বর। সেখান থেকে বেরিয়ে নীলক্ষেত পার হয়ে নিউমার্কেট। একটু এগোলে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে ৩০ মিরপুর রোডে মহানগর ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিস। সেখানে নেতা-কর্মীদের ভিড়। নিউমার্কেট থেকে মিরপুর রোড ধরে এগিয়ে গেলে লেকের ধারে ৩২ নম্বরের সেই বাড়ি। সেই তীর্থে মানুষের ভিড় লেগে থাকবে সে তো জানা কথাই। ছাত্রজীবনে এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, এই ৩০ মিরপুর রোড, ৩২ নম্বরের প্রতি অন্যরকম এক আকর্ষণ ছিল আমাদের। ৩২ নম্বরের এই বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই বাড়িটি থেকে প্রতিদিন সকালে যে দীর্ঘদেহী, ঋজু তরুণটি বেরিয়ে আসতেন তাঁর আকর্ষণও কম ছিল না আমাদের কাছে। তিনি তখন আমাদের নেতা, রোল মডেল। আমরা তাঁকে অনুসরণ করি। অনুকরণ? হয়তো অজান্তে চেষ্টা করেছি। তাঁর ঠোঁটের ওপর পুরু গোঁফ। একচিলতে হাসিতে কোন কার্পণ্য ছিল না। লোক দেখানো নয়, হৃদয়ের সবটুকু ছোঁয়া যেন পাওয়া যেত প্রশ্রয়ের ঐ স্মিত হাসিতে। আমাদের সেই সময়টি ছিল একেবারেই অন্যরকম। সদ্য স্বাধীন দেশ। সর্বত্র মুক্তির হাওয়া। মুক্ত বাতাসে তখন আমাদের বিচরণ। নিষেধের বেড়াজাল ছিল না। অনুপস্থিত অবাঞ্ছিত কারও চোখ রাঙানিও। শাসনের নাগপাশ ভেঙ্গে আমাদের ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’। সেই পথে ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ কিছু তরুণ ‘আমরা চকিত অভাবনীয়ের ক্বচিৎ-কিরণে দীপ্ত’। ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে’ আমাদের চিত্ত তখন ঝলমল করে। আমাদের মন ও মননে সেই আলোর শিখার পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্রাণময় তরুণ, যাঁর চোখে কালো ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। উচ্ছল তারুণ্যের ঈর্ষণীয় উজ্জ্বলতায় তিনি ছিলেন আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। তাঁর আকর্ষণে আমরা ছুটে যাচ্ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কখনও ৩০ মিরপুর রোডের ছাত্রলীগ অফিসে, কখনওবা ধানম-ির ৩২ নম্বরে। যদি তাঁর দেখা পাই! তিনি হয়ত বলবেন, ‘সব খবর ভালো তো?’ জানতে চাইবেন, ‘লেখাপড়ার খবর কী?’ হয়ত পিঠে হাত রেখে দেবেন জরুরী কোন সাংগঠনিক নির্দেশনা। শুধুই কী রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন কিংবা মধুর ক্যান্টিন, সেখানেও তাঁর সরব উপস্থিতি। খেলার মাঠে গিয়ে তাঁকে পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী এ্যাথলেট তিনি। ঢাকা স্টেডিয়ামে তাঁকে পাই। ক্লাব ফুটবলের সংগঠক তিনি। সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও দেখি তাঁকে সমান সক্রিয়। গলা ছেড়ে গাইছেন। আজকের বাংলা পপ সঙ্গীতের সূচনা যাঁদের হাত ধরে তিনি তো সেই অগ্রণীদেরই একজন। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী নামের ব্যান্ড দলের অন্যতম সংগঠক। নাটকের মঞ্চেও তাঁর সপ্রাণ উপস্থিতি। ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা কে অস্বীকার করবে? আবার নিভৃত গৃহকোণে সুর তুলতেন সেতারে, এ খবরও আমাদের অজানা ছিল না। আমাদের কাছে তাঁর কত গল্প জমা তখন! সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়েও যুদ্ধোত্তর দেশে কেন তিনি নিয়মিত বাহিনীতে গেলেন না? দেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন তিনি। শুরু থেকেই যদি গুণগত পরিবর্তন করে দেয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনীতি হবে কলুষমুক্ত, এমনই স্বপ্ন দেখতেন তিনি। নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতেন তিনি অন্যদের ভেতর। যে কোন সংগঠনের শীর্ষ পদটি গ্রহণ করার সব যোগ্যতা ছিল তাঁর। নেননি। নিজেকে নেপথ্যের কর্মী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আজ সুদূর প্রবাসে বসে যখন দেখি দেশে জঙ্গী-সন্ত্রাসের দানবীয় তা-ব, তখন তাঁর কথা খুব মনে পড়ে। আজ যদি তিনি থাকতেন! যখনই দেশে যাই সেই অসম্ভব আকর্ষণ আজও অনুভব করি। প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে গিয়ে বাংলা একাডেমি, টিএসসি হয়ে যাই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। নীলক্ষেত-নিউমার্কেট পেরিয়ে মিরপুর রোড ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হাজার মানুষের ভিড়ে খুঁজি তাঁকে এই বুঝি ৩০ মিরপুর রোডের বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ছবির মতো চোখে ভাসতে থাকে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের কত-শত স্মৃতি-ছবি। অসাধারণ হয়েও খুব সাধারণ ছিলেন তিনি। সাধারণের মধ্যেই নিজেকে মানানসই মনে করতেন। সহজে সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। নিজেকে কোনদিন জাহির করতে যাননি যে মানুষটি, তিনি শেখ কামাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘যাঁহারা যথার্থ দেশহিতৈষী তাঁহারা অল্প উপকারকে নিজের অযোগ্য বলিয়া ঘৃণা করেন না। তাঁহারা ইহা নিশ্চয় জানেন যে যদি হাঙ্গাম করা উদ্দেশ্য না হয়, দেশের উপকার করাই বাস্তবিক উদ্দেশ্য হয়, তবে অল্পে অল্পে একটু একটু করিয়া কাজ করিতে হয়, তাহাতে এক রাত্রের মধ্যে যশস্বী হওয়া যায় না বটে, মোটা মোটা কথা বলিবার সুবিধা হয় না বটে কিন্তু দেশের উপকার হয়। তাঁহারা ইহা জানেন যে, মস্ত মস্ত উদ্দেশ্য জাহির করিলে দেশের যত না কাজ হয়, ছোটো ছোটো কাজ করিলে তাহার চেয়ে বেশি হয়।’ কবিগুরুর এই কথাগুলো শেখ কামালের সঙ্গে কেমন হুবহু মিলে যায়! লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও মানবাধিকারকর্মী হধুৎঁষ@মসী.ধঃ
×