ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবহমান গ্রামবাংলার বিস্মৃত উপাদান, জীবন সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ জুলাই ২০১৬

আবহমান গ্রামবাংলার বিস্মৃত উপাদান, জীবন সংস্কৃতি

মোরসালিন মিজান ॥ পটচিত্রের ইতিহাস অনেক পুরনো। বারো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত চর্চাটি বিশেষ পরিলক্ষিত হয়। যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিল না, তখন পটচিত্র বাংলার ঐতিহ্যকে সযতেœ ধারণ করেছিল। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক এ শিল্পকর্ম। আজকের দিনে তেমন চোখে পড়ে না। বিলীন হওয়ার পথ ধরেছে বলা যায়। তবে আশার কথা যে, কোন কোন শিল্পী এখনও পটচিত্রের চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। চিত্রকলার উৎকর্ষের দিনে, এগিয়ে যাওয়ার দিনে তারা পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন। নতুন করে তুলে আনছেন গৌরবগাথা। পটুয়া নাজির হোসেন এই বিরল শিল্পীদের অন্যতম। তরুণ শিল্পীর একক পটচিত্র প্রদর্শনী ‘বাংলার বাঘ’ এখন চলছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায়। পটুয়া নাজির হোসেন লোকচিত্রকলার বিশেষ ধারায় বাংলাকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন। গৌরবময় অতীত ও সমকালীন ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছবি এঁকেছেন তিনি। বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের প্রতীক বাঘ তার পটের মূল চরিত্র। শিল্পীমনের ভাব-ভাষা প্রকাশে প্রধান অনুষঙ্গ করেছেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে। প্রদর্শনীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দেশাত্মবোধ। এই বয়সে এত দেশাত্মবোধ, নিজ কৃষ্টির প্রতি এমন আনুগত্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। পটে অঙ্কিত চিত্রই পটচিত্র। পট শব্দের অর্থ কাপড়। কাপড়ের ওপর দেশজ রং এবং তুলির স্বতন্ত্র ব্যবহারে পটচিত্র দৃশ্যমান হয়। যারা পট আঁকেন তারা পটুয়া পরিচয়ে পরিচিত। স্বশিক্ষিত শিল্পীরা বংশানুক্রমিকভাবে পটচিত্র আঁকার কাজ করেন। নাজির এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। শেকড় সন্ধানী শিল্পী ভালবেসে, কেবল ভালবাসার টানেই পট আঁকেন। আঁকার মূল রসদ সংগ্রহ করেন গ্রাম থেকে। আর যেহেতু রাজধানী শহরে বাস, এখান থেকেও গ্রহণ করেন অনেক কিছু। সমকালীন শিল্পী কাজ করেন এ্যাক্রিলিক মাধ্যমে। এভাবে নিজস্বতা নিয়ে প্রকাশিত হন নাজির। মাত্র অর্ধশত ছবি দিয়ে সাজানো গ্যালারি ভেতরে দারুণ দোলা দিয়ে যায়। কনটেম্পরারি আর্টের জটিল জগত থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মুক্তি দেয়। সরল সুন্দরের হাতছানি অগ্রাহ্য করা যায় না। বরং পটচিত্রের ভূবনে ডুব দিতে ইচ্ছে করে। নাজির হোসেন পটচিত্র অঙ্কনের মৌল নিয়মগুলো মেনে ছবি এঁকেছেন। তার উজ্জ্বল রঙে কথা বলে ধর্ম, পুরাণ, লোকায়ত বিশ্বাস। রাম-রাবণের যুদ্ধ তার পটের বিষয় হয় এখনও। বহুল পঠিত গল্পমতে, রাম-রাবণের যুদ্ধে আহত লক্ষণ। বৈদ্যের পরামর্শÑ বৈশল্যকরণী পাতার রস ক্ষতস্থানে লাগালে লক্ষণ ভাল হয়ে যাবে। হিমালয়ে আছে বৈশল্যকরণী লতা। কিন্তু হনুমান গাছটি চিনতে ব্যর্থ হয়। অগত্যা হিমালয় থেকে পুরো এক পর্বত উঠিয়ে নিয়ে আসে। পৌরাণিক কাহিনীর হনুমানকে এ সময়ে দাঁড়িয়ে আঁকেন পটুয়া। নাজিরের শেকড় সন্ধানী মনের আরেক উদাহরণ হয়ে আসে বেহুলা। একাধিক পটে স্বামী লক্ষীন্দরকে বাঁচানোর একলা সংগ্রাম। নদীর জলে ভেলা ভাসিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছেন বেহুলা। জনপ্রিয় লোকগাথা থেকে আরও অনেক উপাদান সংগ্রহের চেষ্টা দেখা যায় প্রদর্শনীতে। নাজির হোসেন আবহমান গ্রামবাংলার বিস্মৃত উপাদান, জীবন সংস্কৃতির নানান দিক পটচিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। শিল্পীমনের কল্পনা, রসবোধ, ফ্যান্টাসি ইত্যাদিও যোগ হয়েছে। নাজিরের আঁকার খুব উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যÑ তিনি বলার, অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বাঘকে আশ্রয় করেন। এ প্রদর্শনীর বেলায়ও ঘুরেফিরে বাঘ এসেছে। বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিচিত্র ও বহুমাত্রিক উপস্থাপনা দিয়েছেন শিল্পী। নাজিরের ইচ্ছায় ডোরাকাটা প্রাণীটি পটের মূল চরিত্র বা নায়ক হয়ে ওঠে। মানুষের প্রতিদিনের জীবন ও প্রকৃতির সঙ্গে দারুণভাবে সম্পর্কিত হয়। কাল্পনিক সম্পর্ক বটে। আঁকতে গিয়ে অদ্ভুত ব্যঞ্জনা দেন পটুয়া। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যে চিত্র শিল্পী আঁকেন, তার প্রতিপর্বে দৃশ্যমান হয় বাঘ। ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচের যে ছবি পটুয়া আঁকেন, সেখানে দক্ষ হাতে বৈঠা ধরতে দেখা যায় বাঘ মামাকে। কল্পনাপ্রিয় শিল্পীমন শাপ, পাখি, প্যাঁচা ইত্যাদির মুখেও বাঘের প্রতিকৃতি জুড়ে দেন। নাজিরের পটচিত্রে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয় বাংলার উৎসব পার্বন। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের ছবি আঁকতে গিয়ে কত যে অনুষঙ্গ খুঁজে নেন তিনি! বাদ যায় না বাংলার বাউল। সুরের দেশ গানের দেশকে আঁকেন পটুয়া। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির প্রতি ভীষণ মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতার কথা বলার পাশাপাশি নাজির বৃক্ষের যে প্রাণ আছে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেন। গাছের ছবি আঁকতে গিয়ে সেখানে মানুষের প্রতিকৃতি জুড়ে দেন। চোখ বসিয়ে দেন। পট আঁকার পাশাপাশি রীতি অনুযায়ী থাকে গানও। ‘সবুজ গাঁ’ শিরোনামে তৈরি স্ক্রলে কয়েকটি ছবি। ছবির নিচে গানের কথা। যেমন- সবুজ গাঁয়ে জন্ম আমার সবুজ আমার মন/তাই তো আমি সবুজ নিয়ে ভাবি সারাক্ষণ...। গানের কথা ও চিত্রভাষা পরস্পরকে সমর্থন করে। এগিয়ে যায়। এগিয়ে যাক নাজির হোসেনও।
×