ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফে আরএসও নেতা ও সৌদি নাগরিকসহ চার জঙ্গী গেস্খফতার

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩১ জুলাই ২০১৬

টেকনাফে আরএসও নেতা ও সৌদি নাগরিকসহ চার জঙ্গী গেস্খফতার

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ টেকনাফের শাপলাপুরে রোহিঙ্গাদের জঙ্গী সংগঠন আরএসও নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠককালে বহুল আলোচিত মিয়ানমারের নাগরিক আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সাবেক সামরিক কমান্ডার হাফেজ ছলাহুল ইসলাম ও এক সৌদি নাগরিকসহ ৪ জঙ্গীকে আটক করেছে বিজিবি। আটক জঙ্গীরা হচ্ছে সৌদি নাগরিক আবু সালেহ আল গাদ্দানি, (টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান নব্য আওয়ামী লীগ নেতা জাফর আহমদের বেয়াই) শাপলাপুর দারুল ইসলাম দাখিল মাদ্রাসার পরিচালক মৌলভী ছৈয়দ করিম, কক্সবাজারের লিংকরোড মুহুরি পাড়ায় গড়ে ওঠা ইমাম মুসলিম সেন্টারের পরিচালক হাফেজ ছলাহুল ইসলাম ও আরএসওর প্রথম সারির নেতা মৌলভী ইব্রাহিম। শনিবার বিকেলে জাফর চেয়ারম্যানের বেয়াই মৌলভী ছৈয়দ করিমের বাড়িতে গোপন বৈঠক থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বিজিবির উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে মাওলানা রফিক উদ্দিন, তার সহোদর মাওলানা আজিজ উদ্দিন ও বদি এমপির সহোদর মৌলভী মুজিব পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। বৈঠকে স্থানীয় সাংসদ আব্দুর রহমান বদি ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদও উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, সাংসদ বদি জঙ্গীদের বিজিবির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। বিজিবির তোপের মুখে তারাও কৌশলে কেটে পড়েন। অভিযানে তাদের কাছ থেকে একটি সৌদি পাসপোর্ট উদ্ধার করেছে বিজিবি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আবুজার আল জাহিদ। সূত্র মতে, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল হিসেবে শামলাপুরে প্রায় ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আরএসওর অর্থায়নে একটি অট্টালিকা (রোহিঙ্গা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) নির্মাণের লক্ষ্যে মূলত ওই গোপন বৈঠক হয়। এ লক্ষ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে দাওয়াত করা হয়। ভূরিভোজের জন্য জবাই করা হয়েছিল দুটি ছাগলও। সূত্র জানায়, সমুদ্র পথে অবৈধ অস্ত্র আনা-নেয়া এবং জঙ্গী কর্মকা- সহজতর হবেÑ এ ধারণায় স্থানীয় চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও তার সহোদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌলভী রফিক উদ্দিনের পরামর্শে জঙ্গী ছলাহুল ইসলাম নাগরিক আবু সালেহ আল গাদ্দানিকে আমন্ত্রণ জানান। জঙ্গীদের বরাদ্দ ২৬ কোটি টাকা জায়েজ করার জন্য স্থানীয় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে ওই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খবর পেয়ে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জরুরী বার্তা প্রেরণ করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা পেয়ে তাৎক্ষণিক টেকনাফের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদ ইকবালের নেতৃত্বে টেকনাফ ব্যাটালিয়নের বিজিবি ও পুলিশ যৌথ অভিযানে নামে। গ্রেফতার করা হয় সৌদি নাগরিকসহ চার জঙ্গীকে। বাহারছড়া এলাকায় জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কুয়েত, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের একাধিক নাগরিক প্রতিবছর ওই এলাকায় সফরে আসেন। মৌলভী আজিজ উদ্দিন ও জঙ্গী ছলাহুল তাদের সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আবুজার আল জাহিদ জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শাপলাপুরে বিদেশী নাগরিকের সঙ্গে গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে মৌলভী ছৈয়দ করিমের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। ওই সময় জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত সন্দেহে এক সৌদি নাগরিকসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতরা হলোÑ সৌদি নাগরিক আবু সালেহ আল গাদ্দানি, কক্সবাজারের লিংকরোড মুহুরি পাড়ার ইমাম মুসলিম সেন্টারের পরিচালক হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, শাপলাপুর দারুল ইসলাম দাখিল মাদ্রাসার পরিচালক মৌলভী ছৈয়দ করিম ও আরএসওর প্রথম সারির নেতা মৌলভী ইব্রাহিম। স্থানীয়দের মতে, শনিবার মৌলভী ছৈয়দ করিমের বাড়িতে বিদেশীদের নিয়ে গোপন বৈঠক কেন্দ্র করে অতি গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। দুপুর একটার দিকে বৈঠকে যোগ দেন উখিয়া-টেকনাফ আসনের এমপি আব্দুর রহমান বদি, উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌলানা রফিক উদ্দিন, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলানা আজিজ উদ্দিন ও টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র এমপি আব্দুর রহমান বদির ভাই মৌলানা মুজিবুর রহমান। পরে দুপুর দুটোর দিকে বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত পালিয়ে যান ভাইস চেয়ারম্যান রফিক, ইউপি চেয়ারম্যান মৌলানা আজিজ ও প্যানেল মেয়র মৌলভী মুজিবুর রহমান। তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে আরএসও নেতাসহ ওই বিদেশীকে আটকের বিরোধিতা করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন সাংসদ বদি ও উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর। ওই সময় জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দফতরে ফোন দিয়ে আটকদের ছাড়িয়ে নিতে তদ্বির করেন এমপি বদি। এমনকি বিজিবি কর্মকর্তার হাত থেকে জঙ্গীদের ছেড়ে দেয়ার জন্য টানাটানিও করেন তিনি। তবে বিজিবির কঠোর মনোভাব ও উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশে জঙ্গীদের ছাড়িয়ে নিতে পারেননি। পরে বিজিবির তোপের মুখে সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান ঘটনাস্থল থেকে কেটে পড়েন। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানান, প্রায় ২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করার পরিকল্পনার কথা শুনেছি। প্রশাসনের অভিযানে তা ভেস্তে গেছে। এদিকে কয়েক বছর আগে জঙ্গী সন্দেহে বেশকিছু ডকুমেন্টসহ রোহিঙ্গা জঙ্গী নেতা হাফেজ ছলাহুলকে আটক করেছিলেন সে সময়ের কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার (বর্তমান এসপি)। তবে ওই সময় স্থানীয় কতিপয় ধান্ধাবাজ নেতার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ও আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে যান তিনি। হাফেজ ছলাহুলের বিরুদ্ধে জঙ্গী তৎপরতার বহু অভিযোগ থাকলেও সেসব ছিল শুধু কাগজে-কলমে। সর্বশেষ টেকনাফের আনসার ব্যারাকে হামলায়ও জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে আরএসওর। এর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে আরএসও নেতা হাফেজ ছলাহুলের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে উত্থান এই রোহিঙ্গা জঙ্গী নেতা হাফেজ ছলাহুলের। এর পর কক্সবাজারের লিংকরোড মুহুরি পাড়ায় তিনি সরকারী বিশালাকায় বনভূমি দখল করে ইমাম মুসলিম (র) সেন্টার নামে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন আরএসওর সাবেক সামরিক প্রধান হাফেজ ছলাহুল ইসলাম। পরে সীমানা প্রাচীর দিয়ে প্রায় ১০ একরের মতো পাহাড়ী বনভূমি ঘেরাও করেন তিনি। সেখানে পাহাড় কেটে গড়ে তোলেন একের পর এক বিশাল দালান ও রোহিঙ্গা পল্লী। ওই মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত সিংহভাগ ছাত্র এবং শিক্ষক পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের। আর সেখানে প্রতিনিয়ত আনাগোনা বিদেশীদের। সূত্র জানায়, টেকনাফের হ্নীলার একটি মাদ্রাসায় গোপন বৈঠককালে রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সামরিক বিভাগের সমন্বয়কারী হাফেজ ছলাহুল ইসলামকে আটক এবং তার মোবাইলে আরবী লেখা বহু ক্ষুদেবার্তা (মেসেজ) জব্দ করেছিল পুলিশ। এসব মেসেজের বেশিরভাগই পাঠানো হয় সৌদি আরবের মদিনা থেকে। জঙ্গী ছলাহুলের মোবাইলে সংরক্ষিত কয়েকটি আরবী বার্তা অনুবাদ করে দেখা গেছে, এর মধ্যে সৌদি আরব ছাড়াও পাকিস্তান ও মিসর থেকেও মেসেজ প্রেরণের রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু সেসময় কতিপয় নেতার তদ্বির জঙ্গী ছলাহুলের বিরুদ্ধে তদন্ত থমকে যায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জঙ্গী তৈরির কারখানা হিসেবে অভিযুক্ত বহুল আলোচিত ইমাম মুসলিম ইসলামিক সেন্টারে যাবতীয় কর্মকা- চলে আসছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায়। সরকারী পাহাড় দখল করে তৈরি করা আরএসও পল্লীতে শত শত রোহিঙ্গা বসবাস করেছে।
×