ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবে শুরু হবে- জানে না সুনামগঞ্জ এলাকার মানুষ

সুনামগঞ্জে আগুয়া সেতুর নির্মাণ কাজ ১০ বছর ধরে বন্ধ

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩০ জুলাই ২০১৬

সুনামগঞ্জে আগুয়া সেতুর নির্মাণ কাজ ১০ বছর ধরে বন্ধ

রাজন ভট্টাচার্য, হাওড়াঞ্চল থেকে ফিরে ॥ সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা ব্রিজ থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন। জেলা শহর থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রায় ৯৫ ভাগ পাকা রাস্তা। তাহেরপুর উপজেলা ও ফতেপুর ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে আগুয়া নদী। অর্থাৎ এই নদী পার হলেই যেমন ইউনিয়নে প্রবেশ সম্ভব; তেমনি দ্রুততম সময়ে পেঁৗঁছা যায় তাহেরপুর। এ কারণে তাহেরপুরের বেশিরভাগ মানুষই এ পথে যাতায়াত করেন। অথচ এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘশ্বাস হলো ‘আগুয়া সেতু’। দুই উপজেলাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল আগুয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। এলাকাবাসীর স্বপ্ন পূরণে সেতুর নির্মাণ কাজ প্রায় ১০ বছর আগে শুরু হয়েছিল। কিন্তু নক্সায় ত্রুটি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে কিছুদিনের মধ্যেই কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গচ্ছা যায় সরকারের কয়েক কোটি টাকা। নদীর দু’প্রান্তে নির্মিত হয়েছিল সেতুর সামান্য গার্ডারের কাজ। আর এ সামান্য নির্মাণ কাজই হাওড়াঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা এখনও আশায় বুক বেঁধে আছেনÑ সেতুর কাজ হবে। বর্ষায় পানির সঙ্গে এলাকাবাসীর যুদ্ধ আর থাকবে না। দুর্ভোগ লাঘব হবে কয়েক লাখ মানুষের। উন্নত হবে গোটা এলাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেতুটির নির্মাণকাজ বন্ধের পর পেরিয়ে গেছে অন্তত সাত বছর। এর মধ্যে নতুন করে আর কোন অগ্রগতিও নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এ নিয়ে কোনকিছু ভাবেন না। সুনামগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগ বলছে, সেতুটির রি-ডিজাইন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এটিসহ আরও সাতটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। এক বছরের মধ্যে প্রস্তাব পাস হতে পারেÑ এমন আশা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে সেতুর দু’পাশের সংযোগ সড়কও ভেঙ্গে গেছে। প্রতি বর্ষায় বাড়ছে ভাঙনের মাত্রা। সওজ বিভাগ বলছে, নতুন পরিকল্পনায় সেতুর দু’পাশে সংযোগ সড়কও নির্মাণ করা হবে। হাওড় এলাকা হওয়ায় সড়কের দু’পাশে রাস্তার নিচের অংশ পাকা থাকবে পানির স্রোতে যেন সড়কের ক্ষতি না হয়। যারা নৌকায় নিয়মিত নদী পারাপার হচ্ছেন, তাদের সবার দৃষ্টি সামান্য কাজ হওয়া সেতুর অংশের দিকে। জানতে চাইলে, সুনামগঞ্জের সওজ অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত ডিজাইনে ত্রুটিসহ নানা জটিলতায় সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি জানান, সেতু নির্মাণের সময় এসেসমেন্ট সঠিক হয়নি। ফলে কাজ করতে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সওজের সমন্বয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর প্রকল্পটি শেষ করার ক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি ছিল না। তিনি জানান, সেতুটি নির্মাণের জন্য আবারও তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন করে ডিজাইনও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ সেতুসহ আরও সাতটি ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্প ইতোমধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আশা করি আগামী এক বছরের মধ্যে প্রকল্প পাস হয়ে আসবে। এরপরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফতেপুর ব্রিজের কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কবে এ সেতু নির্মাণ শুরু হয়েছিল কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান ঠিকাদারির কাজ পেয়েছিল এরকম কোন তথ্য নেই সওজের হাতে। পাশাপাশি প্রথম প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়নি। সওজ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে সেতু নির্মাণ শুরু করতে গিয়ে অর্থ অপচয়েরও কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, কুমিল্লার একটি প্রতিষ্ঠান সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছিল। এলাকাবাসী জানেও না কেন সেতুটির কাজ বন্ধ। তারা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া যাদের গাফিলতির কারণে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়েছে কিংবা সরকারী অর্থ অপচায় হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি সড়ক বিভাগ। সুনামগঞ্জ শহর থেকে অটোরিক্সায় ফতেপুর। মাঝাখানে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি হাওড়। নদী পার হওয়ার আগে মাত্র দুটি দোকানই সম্বল। রাস্তার কানায় কানায় হাওড় ও নদীর পানি। স্রোতে উত্তাল আগুয়া নদী। চারপাশের বাড়িঘরে পর্যন্ত পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া চলাচলের কোন উপায় নেই এলাকার মানুষের। ফতেপুর বাজার কিংবা তাহেরপুর যেতে নদী পারাপারে এমমাত্র সম্বল একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত নৌকাটি চলে। তারপর নিজস্ব নৌকা ছাড়া নদী পারাপারের কোন ব্যবস্থা নেই। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে ফতেপুর বাজারেও এখন পানি। নদী পাড়ে যারা দোকান করেছেন তাদের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী কামাল জানালেন, দোকানে কখনও হাঁটুপানি জমে। তখন দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়। তবে শুকনো মৌসুমে একেবারেই নিরাপদ। ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা রিংকু চক্রবর্তী জানান, ইউনিয়নের একপাশে শনির হাওড়। একপাশে নদী। বর্ষায় নদী আর হাওড় এক হয়ে যায়। তখন চারপাশজুড়ে পানি আর পানি। শুকনো ও বর্ষা সব মৌসুমে জেলা সদরে যাতায়াত করতে হলে নদী পার হওয়ার বিকল্প নেই। সেতু নির্মাণ হলে এলাকাবাসীর দুর্ভোগের অবসান হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী আশরাফ জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাদের একমাত্র দাবি থাকে আগুয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করা। সদ্যসমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আমাদের এমন দাবি ছিল। প্রতিবার আমরা প্রাণের দাবিটুকু জানিয়ে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এখন নদীর দু’পাশে সেতুর সামান্য নির্মাণের অংশ দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ। তবুও সবাই আশায় বুক বেঁধে আছি। হয়ত আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে। ফতেপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান শাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমি ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব নেয়ার আগে থেকেই সেতু নির্মাণের কাজ বন্ধ ছিল। নানা কারণে সেতুটির কাজ শেষ করতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন আলোচনা হয়নি। তিনি জানান, ফতেপুর ও তাহেরপুর উপজেলার মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হলো এই রাস্তা। অথচ সেতুটির নির্মাণকাজ অজ্ঞাতকারণে বন্ধ রয়েছে। তিনি জানান, সেতুটির কাজ বন্ধ হওয়ায় প্রায় ২০ লাখ মানুষের যাতায়াতে কষ্ট হচ্ছে। সেতুটি হলে তাহেরপুরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। জেলা শহর থেকে উপজেলায় যেতে সময় কম লাগবে। ফতেপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার অরুণ কান্তি দাশ ঝুনু জনকণ্ঠকে বলেন, সেতুর অভাবে এলাকার মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বছরের পর বছর। বিশেষ করে বর্ষায় পানি বেশি হওয়া দুই উপজেলার সঙ্গে এই রাস্তা দিয়ে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নদীর একপাশ পর্যন্ত যানবাহন আসে। অথচ সেতু থাকলে সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর পর্যন্ত সড়ক পথেই চলাফেরা সম্ভব। এতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটত। তিনি জানান, নদী ভাঙ্গনে এই এলাকার মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষায় ব্যাপক স্রোত হওয়ায় প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে হাজারও পরিবার। এতে দিন দিন দু’পাশের পরিধি বাড়ছে। সে তুলনায় সেতুসংলগ্ন এলাকায় ভাঙ্গনের মাত্রা কম বলে জানান তিনি। ফতেপুরের নবনির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়্যারম্যান রণজিৎ চৌধুরী রাজনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনও বন্ধ ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বর্তমান চেয়ারম্যানের নির্বাচনের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল এই নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজ শেষ করা।
×