ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বার্নার্ড শ

মহাকালের যাত্রায় মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২৯ জুলাই ২০১৬

মহাকালের যাত্রায় মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

১৯২৫ সালে নোবেল পুরস্কার দেয়ার পর নোবেল কমিটি জর্জ বার্নার্ড শর অভিজ্ঞানপত্রে লিখেছিলÑ ‘জর্জ বার্নার্ড শ একদিকে আদর্শবাদের ধ্বজাকে ওপরে তুলে ধরেছেন এবং পাশাপাশি তিনি চিরন্তন মানবিকতার জয়গানও গেয়েছেন। অসাধারণ কৌতুকসম্পন্ন বাক্যবাণে বিধ্বস্ত করেছেন সবার অশান্ত হৃদয়কে। তার লেখনীর মধ্যে কাব্যিক সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকত সবসময়।’ প্রকৃত অর্থেই লেখক ও ব্যক্তি জীবনে বার্নার্ড শ ছিলেন একজন কৌতুকপ্রিয় রসিক মানুষ। কিন্তু তাঁর কৌতুকগুলো যে নেহাৎ হাস্যরসাত্মক ছিল না-তা নোবেল কমিটির বক্তব্য থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। তাঁর লিখনীর মধ্যে যে সরস ভাবটি ছিল- তা বক্তব্যের ভেতরের আরও গভীরতর ভাবকে উন্মোচিত করে; কৌতুকই তীব্র ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের আকারে ছড়িয়ে পড়ে পাঠক হৃদয়ে। বার্নার্ড শ সমকালীন সময়কে তৃষিত দৃষ্টি নিয়ে দেখেছিলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন একজন কট্টর সমালোচক, তাই সমাজের ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলো তাঁর দৃষ্টি থেকে পালিয়ে যেতে পারেনি। তিনি সমাজের অসংলগ্নতাকেই উচ্চকিত করেছেন, ত্রুটিগুলো নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন তাঁর নাটকে। বিশেষত ধর্ম, সরকার, শিক্ষা, বিয়ে, শ্রেণী বৈষম্যের নানা দিক তাঁর লেখায় বার বার এসেছে। ‘কৌতুকসম্পন্ন বাক্যবাণ’ ও ‘মূল বক্তব্যে বিচিত্রতা’ই বার্নার্ড শকে নাট্যকার হিসেবে সেই সময়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তুলে দেয়। বার্নার্ড শ শৈশব থেকেই বই পড়ার অভ্যাস পেয়েছিলেন। দশ বছর না পার হতেই তিনি পাঠ করেন শেক্সপিয়ার, আলিফ লায়লা, বাইবেলের মতো ঐশ্বর্যশালী গ্রন্থ। মাত্র বারো বছর বয়সের মধ্যেই পড়ে শেষ করেন চার্লস ডিকেন্স, বায়রন ও শেলীর মতো বিশ্বখ্যাতদের বই। কিশোর বয়সে তিনি আকৃষ্ট হন দর্শনে। যৌবনে পা দেয়ার আগেই তিনি স্টুয়ার্ট মিল, হারবার্ট স্পেন্সার প্রমুখ দার্শনিকদের লেখার সংস্পর্শে আসেন। বার্নার্ড শ জীবনের বেশিরভাগ সময় আর্থিক ও খ্যাতির মধ্যে কাটালেও তাঁর শৈশব সুখের ছিল না। কেননা, তাঁর বাবা-মা দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন না। আর্থিক সাচ্ছন্দ্যও তাঁর পরিবারের ছিল না। ফলে বইপ্রীতি থাকা সত্ত্বেও শকে চরম দরিদ্রতার কারণে মাত্র পনেরো বছর বয়সে কেরানির চাকরিতে যোগ দিতে হয়। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের পাঠ নেয়া শর উপযুক্ত স্থান যে এখানে নয়, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি নিজেকে নিজে বলতেন, ‘অফিসের একঘেয়ে জীবন আমার জন্য নয়। আমার জন্য অন্যজীবন অপেক্ষা করছে। এই মানবজীবন তো আর পাব না। জীবনকে সার্থক আর সুন্দর করতে চাই আমি। আর তা করতে চাইলে চাকরিজীবন বাদ দিতে হবে আমাকে।’ জীবনকে সার্থক করার এই চিন্তা শ তার পরিবারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর পরিবার শকে বড় কিছু হওয়ার জন্যে প্রতিনিয়তই উদ্বুদ্ধ করত। কয়েক বছর চাকরি করার পর বার্নার্ড শ তাঁর মায়ের কাছে লন্ডন পাড়ি জমান। মূলত তাঁর লেখক জীবনের শুরুটা হয় এখানেই। বিশ বছর বয়সে তিনি সাহিত্য রচনার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তী দীর্ঘ নয় বছরের সাধনায় তিনি পাঁচটি উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসগুলো প্রকাশের জন্যে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রকাশনীতে পাঠিয়ে দেন তিনি। কিন্তু তাঁর একটিও কোন প্রকাশনী ছাপতে রাজি হয়নি। শ লেখক জীবনের এই ব্যর্থতার গ্লানি টেনেছেন কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারাননি। লিখেই গেছেন। তিনি জানতেন সফলতা একদিন আসবেই। তাঁর এই সাধনা পূর্ববর্তী আরেক বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের তুল্য ছিল। অবশ্য বার্নার্ড শ ইবসেন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিতও ছিলেন। ইবসেনও প্রথম দিকে প্রচুর লিখেছেন কিন্তু তাঁর নাটক দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। ইবসেন তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম ‘ক্যাটিলিন’ লিখেছিলেন ১৮৫০ সালে। এ নাটকটি মঞ্চস্থও হয়নি। একই সালে তিনি লিখেন ‘দ্য বুরিয়াল মন্ড’। নাটকটি মঞ্চস্থ হলেও দর্শক ও নাট্যবোদ্ধাদের কাছে প্রত্যাশিত সাড়া পাননি তিনি। তারপর তিনি একে একে লিখলেন ‘সেন্ট জনস ইভ’, ‘লেডি ইঙ্গার অফ ওয়েসট্রাট’, ‘দ্য ফিস্ট অ্যাট সোলহগ’, ‘ওলাফ লিলজেক্রানাস’, ‘দ্য ভাইকিংস এ্যাট হেলগেলেন্ড’, ‘লাভস কমেডি’ ও ‘দ্য প্রিটেন্ডার্স’। কিন্তু এই নাটকগুলোও তাকে কোন সাফল্য এনে দিতে পারেনি। দীর্ঘ ১৫ বছর পরে ১৮৬৫ সালে লেখা ‘ব্র্যান্ড’ নাটকের মধ্য দিয়ে ইবসেন প্রথম সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান। বার্নার্ড শকেও খ্যাতির জন্যে ইবসেনের মতো দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। প্রথম প্রথম তিনি সমালোচনা, উপন্যাস ও সঙ্গীতবিষয়ক লেখা লিখলেও পরবর্তীতে তিনি নাটক রচনায় ব্রতী হন। তাঁর হাত দিয়েই বিশ্ব নাট্যসাহিত্য অনবদ্য কিছু নাটকের সন্ধান পায়। ১৮৯০ সালে তাঁর লেখা প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়। লেখালেখির করার দীর্ঘ একদশক প্রতীক্ষার পর সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন শ। শিল্পগুণের বিবেচনায় বার্নার্ড শকে শেক্সপিয়ার পরবর্তী সেরা নাট্যকার বলা হয়ে থাকে। একই সঙ্গে শ ছিলেন ঔপন্যাসিক ও সমালোচকও। তাঁর সমালোচনা ছিল স্থির ও কঠিন। তিনি যা ভাল বুঝতেন তাই বলতেন। কখনও কখনও তাঁর বলার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘নাট্যকার হিসেবে আপনি বড় না শেক্সপিয়ার বড়। উত্তরে বার্নার্ড শ বলেছিলেন, আমি শেক্সপিয়ারের উপরে!’ শুধু তাই নয়, আরেকবার শ শেক্সপিয়ারের কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁর সমালোচনা : ‘এক হোমার ছাড়া দ্বিতীয় কারও দেখা পাইনি, এমনকি স্যার ওয়াল্টার স্কটও নন, যাকে আমি শেক্সপিয়ারের মতো এত বেশি অপছন্দ করি। মাঝে মধ্যে তার উপর আমি এতটা ক্ষেপে যাই যে, তাকে যদি কবর খুঁড়ে তুলে আনতে পারতাম আর তার গায়ে পাথর ছুড়ে মারতে পারতাম, কেবল তাহলেই এই ক্রোধ থেকে হয়ত মুক্তি পেতে পারতাম!’ এই সমালোচনা যে যথাযথ হয়নি বা ব্যক্তির গ-ি পেরোয়নি তা স্পষ্ট। প্রকৃত অর্থে, শ মাঝে মাঝেই এমন ব্যক্তিক আচরণ করতেন, যা অগ্রহণযোগ্যও ছিল। তবে তিনি যে কারও প্রশংসা করতেন না, তা নয়। নাটকে ইবসেনের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনিই বলেছিলেন, ‘তিনটি বিপ্লব, ছয়টি ক্রুসেড, দুটি বিদেশী আক্রমণ ও একটি ভূমিকম্পের ফল যা হতে পারে, ইংল্যান্ডের ওপর ইবসেনের প্রভাব তার সমকক্ষ।’ বার্নার্ড শ ৬০টির বেশি নাটক রচনা করেছেন। তাঁর অধিকাংশ নাটকই দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ১৮৯২ সালে ‘উইভোয়ার্স হাউসেস’ নাটকটি প্রকাশিত হলে বোদ্ধা ও সুধী মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়। চারদিকে শর নাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জমিদারতন্ত্র নিয়ে লেখা এ নাটকটি শাসকশ্রেণীর চরিত্রকে চমৎকারভাবে উন্মোচিত করেছে। ফলে শয়ের পরবর্তী নাটক ‘ফিল্যান্দারার’ ও ‘মিসেস ওয়ারেনস প্রফেসন’ প্রকাশের অনুমতি মেলেনি। কারণ সেন্সর বোর্ডেও ধারণা ছিল : এ দুটি নাটক পতিতাবৃত্তিকে উৎসাহিত করবে। ‘সিজার এ্যান ক্লিওপেট্রা’, ‘সেন্ট জন’, ‘ম্যান এ্যান্ড সুপারম্যান’, ‘মেজর বারবারা’Ñতাঁর বহুল আলোচিত নাটক। তবে তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সফল নাটক ‘পিগম্যালিয়ন’। যা পরবর্তীতে চলচ্চিত্র করা হয় এবং ছবিটি অস্কারও জিতে নেয়। ১৯২৮ সালে লেখা ‘দ্য এ্যাপল কার্ট’ও শর গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। এই নাটকটির মাধ্যমে তৎকালিন ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রতি বিদ্রুপ করেছেন নাট্যকার। ‘বিশুদ্ধ গণতন্ত্র’-এর নামে গণতন্ত্রের যে ফাঁক-ফোকর তা এ নাটকটিতে উঠে এসেছে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ নাটকটির উপযোগিতা এখনকার সমাজের জন্যেও সমানভাবে প্রযোজ্য। জর্জ বার্নার্ডই একমাত্র প্রতিভাধর যিনি একইসঙ্গে নোবেল পুরস্কার (১৯২৫) এবং অস্কার পুরস্কার (১৯৩৮) লাভ করেন। তিনি সবসময়ই তরুণদের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। তিনি বলতেন, নতুন কিছু করাই তরুণের ধর্ম। ১৮৫৬ সালে ২৬ জুলাই জন্মানো এই আইরিশ নাট্যকার ১৮৫০ সালের ২ নবেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তি হিসেবে শর সফলতা হচ্ছেÑ মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছেন। এখনও শিল্প সাহিত্যের মানুষদের কাছে শ তিনি অনুপ্রেরণার অমর নাম।
×