ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চার দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী ॥ জেলা প্রশাসকদের ১৯ নির্দেশনা

কল্যাণপুরে দ্রুত সফল অভিযানে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৭ জুলাই ২০১৬

কল্যাণপুরে দ্রুত সফল অভিযানে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় নিহতরা সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটাতে তৈরি হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা নিহত হওয়ায় দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। মঙ্গলবার সকালে নিজের কার্যালয়ে চারদিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে জেলা, উপজেলা/থানা পর্যায়ে কমিটি গঠন করে সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত সবাইকে খুঁজে বের করার জন্য জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জেলা প্রশাসকরা ফলপ্রসূভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য ‘সামারি ট্রায়াল’ দাবি করেছেন। টিআর-কাবিখা প্রকল্পের আওতা কমিয়ে পল্লী রেশনিং চালু করারও দাবি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা। এছাড়া পুলিশের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ করেন। মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শাপলা হলে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। এর পর জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জ, রাজবাড়ি এবং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। এরপর বিভাগীয় কমিশনারদের পক্ষ থেকে বক্তব্যের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং এরপর মন্ত্রী শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন এবং সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মঙ্গলবার সকালে কল্যাণপুরে অভিযান চালানোর ফলে দেশে আরেকটি ভয়ঙ্কর জঙ্গী হামলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। গুলশানের মতো আরেকটি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের চেষ্টার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসায় সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছে। এর আগে সোমবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে পুলিশ ও র‌্যাব ঢাকার কল্যাণপুরের এক বাড়িতে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে গিয়ে হামলার মুখে পড়ে। সারারাত উত্তেজনার পর ভোরে সোয়াট সদস্যরা এক ঘণ্টার অভিযানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ওই ভবনের পঞ্চম তলায় পাওয়া যায় সন্দেহভাজন নয় জঙ্গীর লাশ। শেখ হাসিনা বলেন, মঙ্গলবারও একটি ঘটনা ঘটেছে কল্যাণপুরে। সেখানে কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাবে বলে প্রস্ততি নিয়েছিল। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অভিযানের বিবরণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মধ্যরাতেই সে জায়গা ঘেরাও করা হয় এবং সকাল ৫টায় অপারেশন চালানো হয়। নয়জন সন্ত্রাসী সেখানে মৃত্যুবরণ করেছে। একজন আহত অবস্থায় ধরা পড়েছে, একজন পালিয়ে গেছে। নিহতদের সবার পরনে কালো পাঞ্জাবি ও সঙ্গে ব্যাকপ্যাক থাকার কথা জানিয়ে আইজিপি শহীদুল হক সকালে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, এরা জেএমবি সদস্য এবং গুলশানের হামলাকারীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযানে অংশ নেয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে আমাদের পুলিশ বাহিনী এই অপারেশনটা চালিয়েছে। তারা (সন্ত্রাসীরা) সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিল, বোঝা যাচ্ছিল যে তারা যে কোন ধরনের নাশকতা ঘটানোর জন্য তৈরি হয়ে ছিল। এই পদক্ষেপ নেয়ার ফলে বিরাট বড় ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। একজন পুলিশ আহত হলেও এ বাহিনীর নেয়া পদক্ষেপে দেশ, জাতি রক্ষা পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ায় জন্য পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের এই সন্ত্রাস অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে এবং এটা প্রতিরোধ করতেই হবে। এটাই হচ্ছে সব থেকে বেশি প্রয়োজন। মানুষের জীবনমান নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য। আমরা চাইনা আমাদের দেশটা এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অভয়ারণ্য হোক। বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটনের প্রত্যয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আজ বিশ্বের কছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। যদিও এই দুই একটা ঘটনার জন্য আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এ অবস্থাও আমরা কাটাতে পারব। কারণ এই জঙ্গী সন্ত্রাসীদের স্থান কখনও বাংলার মাটিতে হবে না। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদী কর্মকা-ের এই সঙ্কট নতুন নয় বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আপনাদের মনে থাকা উচিত, আমরা দেখেছি এই দেশে ৫০০ জায়গায় একই দিনে বোমা হামলা হয়েছে ২০০৫ সালে। কিবরিয়া সাহেব ও আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছে। নিজেও হামলার সম্মুখীন হয়েছি। এ জাতীয় ঘটনা কিন্তু পঁচাত্তরের পর থেকে বারবার ঘটে যাচ্ছে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধারের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ধর্মের নামে মানুষ হত্যার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই যে নতুন উপসর্গ দেখা গেছে। এটাকে যে কোনভাবে হোক মোকাবেলা করতে হবে। এর আগে অগ্নি সন্ত্রাস চালিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের সহযোগিতায় প্রতিটি এলাকায়, জেলায় জেলায় আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলেই আমরা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সরকারের নীতি যে কোন ধরনের সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ কখনই বাংলাদেশে হতে দেব না। এটা আমাদের দমন করতেই হবে। সেজন্য আমি সমগ্র জাতিকে আহ্বান করায় একটা জাতীয় ঐক্য আজ সৃষ্টি হয়েছে। সকলেই এই জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসকদের ভূমিকার কথাও মনে করিয়ে দেন সরকারপ্রধান। আপনাদের ওপর বিরাট দায়িত্ব। আপনারা যারা মাঠ প্রশাসনে কাজ করেন, তাদের দায়িত্ব কিন্তু অনেক বেশি। সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী তৃণমূল পর্যায়ে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি গঠনের কথা তুলে ধরে তিনি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত সবাইকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন এই কমিটিকে। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সর্বোচ্চ মেধা, বুদ্ধি, দক্ষতা ও শক্তি দিয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে এ সন্ত্রাস আমাদের রুখতেই হবে। বাংলাদেশে কখনই সন্ত্রাসীদের ঠাঁই হবে না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকদের জন্য ১৯টি নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী। নির্দেশনাগুলো হলো ॥ সরকারী সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আপনাদের আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, যৌতুক, ইভটিজিং এবং বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে পরিত্রাণের জন্য আপনাদের দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে আপনাদের ব্রতী হতে হবে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। শিক্ষার সকল স্তরে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ত্যাগের হার হ্রাস এবং ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারী ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুত, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘœ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে জনপ্রিয় করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এ ধরনের অনৈতিক কর্মকা- কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলী অর্থাৎ ‘স্টান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার, ২০১০’ অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে। শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রফতানি নির্বিঘœ করা এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির যে কোন অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইতিহাস চেতনা, জ্ঞানস্পৃহা ও বিজ্ঞান মনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে। কঠোরভাবে মাদক ব্যবসা, মাদক চোরাচালান এবং এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া, পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
×