ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

আলোকচিত্রে উদ্ভাসিত জননায়ক তাজউদ্দীনের সংগ্রামী জীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৪ জুলাই ২০১৬

আলোকচিত্রে উদ্ভাসিত জননায়ক তাজউদ্দীনের সংগ্রামী জীবন

মনোয়ার হোসেন ॥ সাদা-কালো ছবিগুলো বলছে ইতিহাসের কথা। অধিকাংশ ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ দেশের সংগ্রামী ইতিহাস। আর সেই খরস্রোতা ইতিহাসের অনন্য এক চরিত্র তাজউদ্দীন আহমদ ধরা দিয়েছেন খ- খ- অসংখ্য ফ্রেমে। একটি ফ্রেমে একাত্তরের ডিসেম্বরে ভারতের সংবাদমাধ্যম আকাশবাণীর এক সাংবাদিক সাক্ষাতকার নিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। সাক্ষাতকারের একপর্যায়ে পাকবাহিনীর হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মরণ করে ঝরছে তাজউদ্দীনের চোখের জল। একাত্তরের নবেম্বর মাসে ধারণকৃত আরেক ছবিতে বঙ্গতাজকে দেখা যায় ভারতের কৃষ্ণনগরের মিলিটারি ফিল্ড হাসপাতালে। একাত্তরের রণাঙ্গনে আহত ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছেন। ইতিহাসের স্মৃতি জাগানিয়া এমন ২৩২টি ছবি এখন শোভা পাচ্ছে ধানম-ির গ্যালারি টোয়েন্টিওয়ানে। ছবিগুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে অসাধারণ এক দেশপ্রেমিকের কীর্তিগাথা। ক্যামেরার আলো-ছায়ায় দৃশ্যমান হয়েছে একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের কা-ারী হয়ে ওঠা মহান এই জননেতার কর্মতৎপরতা। উঠে এসেছে বঙ্গতাজের ৯ মাস অপরিসীম পরিশ্রম ও অসীম সাহসে রণাঙ্গন পরিচালনার দায়িত্ব পালনের নানা দৃশ্যপট। ছবিগুলোই যেন বলে দিচ্ছে দেশপ্রেম, সততা ও মেধার মেলবন্ধনে বাঙালীর স্বপ্নের রাষ্ট্র বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাছ থেকে কেমন করে ছিনিয়ে নেন মহান এই জননায়ক। শনিবার ছিল এই জাতীয় নেতার ৯১তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ধানম-ির প্রদর্শনালয়টিতে শুরু হলো বিশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনী। ইতিহাস আশ্রয়ী আলোকচিত্রগুলোয় দেখা মিলেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা থেকে শুরু করে ছেষট্টির ছয় দফার অন্যতম রূপকার কিংবা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উদ্দীপ্ত নেতা তাজউদ্দীনকে। শনিবার শ্রাবণের বৃষ্টিস্নাত বিকেলে মাসব্যাপী এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও ড. কামাল হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আদর্শবাদী এই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী। ছিলেন জাতির জনকের যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর। বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস তিনি জাতিকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে। বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, কোন ষড়যন্ত্রই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। বর্তমানে দেশের অগ্রগতিকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায় তাদের দূরভিসন্ধি কখনই পূরণ হবে না। এ ষড়যন্ত্রকারীরাই গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে তাদের সব বাধাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। এর প্রমাণ হিসেবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকে আমরা ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছি। স্মৃতিচারণ করে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, একাত্তরের অক্টোবর মাসের শেষদিকে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই ক্যাম্পে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহচর হিসেবে তার অবর্তমানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন সেটারই চূড়ান্ত বাস্তবায়ন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ড. কামাল হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের অসহযোগ আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধÑ এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা সব ক্ষেত্রেই তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রদর্শনীর আলোকচিত্রগুলোতে উঠে এসেছে মুজিবনগর সরকার ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা দুর্লভ মুহূর্ত। প্রতিটি ছবিই যেন বলে যায় ইতিহাসের এক মহান নাবিক ও তার সময়ের যোদ্ধাদের কথা। নতুন করে চোখের সামনে হাজির হয় পুরনো দিনের সংগ্রামের ইতিহাস। সহজেই দর্শনার্থীরা ফিরে যান অতীতের আয়নায়। নতুন প্রজন্মের কাছে বইয়ের পাতার বাইরে দৃশ্যমান হয় বাঙালীর অহঙ্কার মুক্তিযুদ্ধ, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন কিংবা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দৃশ্যকল্প। অসংখ্য ছবির মধ্যে আছে একাত্তরে শত্রুমুক্ত হওয়া যশোরের মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীন আহমদের দীপ্তভঙ্গিতে বক্তৃতার দৃশ্য। আছে জননেতার রণাঙ্গন পরিদর্শনের ছবি। মহান এই নেতা বুড়িমারী সীমান্তে আহত এক মুক্তিযোদ্ধার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছেনÑ ঠাঁই পেয়েছে এমন মমতাময় আলোকচিত্র। একাত্তরের এপ্রিলে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সংগ্রামী জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করছেন। আরেক ছবিতে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন এই অবিসংবাদিত নেতা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফ্রেমবন্দী হয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী তাজউদ্দীন। আছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় এক জনসভায় উদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে তাজউদ্দীনের বক্তৃতা দেয়ার দৃশ্য। ১৯৬৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে পরিবারের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন জননেতা। তার কোলে স্নেহের বন্ধনে আশ্রয় নিয়েছে ছেলে সোহেল তাজ। পাশে অবস্থান করছেন সহধর্মিণী জোহরা তাজউদ্দীন। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন মেয়ে রিমি, রিপি ও মিমি। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই সূত্রে জাতির জনকের প্রতি তার হৃদয়ের গভীর ভালবাসার প্রমাণ মেলে এক ছবিতে। একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি মেলার পর আকাশবাণীর এক সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে তার চোখের কোল গড়িয়ে ঝরছে অশ্রুজল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে তাকে বরণ করে নিতে ফুল হাতে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। পাশের ছবিতেই বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে দুই নেতার আনন্দের অশ্রুজলে হৃদয়স্পর্শী ভালবাসার প্রকাশ। আছে স্বাধীন দেশে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতির জনকের সঙ্গে তাজউদ্দীনের একান্ত আলাপচারিতার দৃশ্য। প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে রশিদ তালুকদার, আফতাব আহমেদ, মঞ্জুরুল আলম বেগ গোলাম মাওলা, জহিরুল হক, পাভেল রহমানসহ দেশ-বিদেশের আলোকচিত্রীদের ফ্রেমবন্দী অনবদ্য সব ছবি। এছাড়াও পারিবারিক এ্যালবাম ও তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত সংগৃহীত ছবিও রয়েছে প্রদর্শনীতে। মাসব্যাপী এ প্রদর্শনী প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আমিনুল ইসলাম তরুণ শিল্পী পুরস্কার প্রদান ॥ এ দেশের প্রথম প্রজন্মের এক উজ্জ্বল চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম। ২০১১ সালের ৮ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন এই বরেণ্য চিত্রকর। তার স্মৃতি রক্ষার্থে পরিবারের পক্ষ থেকে ২০১৩ সাল থেকে প্রবর্তন করা হয় ‘আমিনুল ইসলাম তরুণ শিল্পী পুরস্কার’। শনিবার প্রদান করা হলো ২০১৫ সালের আমিনুল ইসলাম তরুণ শিল্পী পুরস্কার। এছাড়াও নির্বাচিত ১০ শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে ছিল একটি ওপেন স্টুডিওর আয়োজন। আবেদনপত্র আহ্বান, বাছাই, প্রদর্শনী আয়োজন এবং পুরস্কার প্রদানসহ অন্যান্য আয়োজনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। ধানম-ির জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠে শনিবার বিকেলে একই সঙ্গে ওপেন স্টুডিওর উদ্বোধন এবং বিজয়ী দুজন শিল্পীকে আমিনুল ইসলাম তরুণ শিল্পী পুরস্কার প্রদান করা হয়। এবার এ পুরস্কার পেয়েছেন শিল্পী মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম শুভ ও রাজীব দত্ত। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, শিল্পী ঢালী আল মামুন, মিসেস রুবী ইসলাম এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।
×