ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর উন্মুক্ত নর্দমা শিশু মৃত্যুর ফাঁদ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৩ জুলাই ২০১৬

রাজধানীর উন্মুক্ত নর্দমা শিশু  মৃত্যুর ফাঁদ

আজাদ সুলায়মান ॥ ওয়াসার পাম্প, নর্দমার পয়ঃনালা ও উন্মুক্ত নালা এখন শিশুদের মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বার বার একই কায়দায় শিশুদের প্রাণহানি ঘটলেও কোন প্রতিকার নেই। রাজধানীতে এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, খোলা স্যুয়ারেজ ও নালা। শাহজাহানপুরের জিহাদ, শ্যামপুরের নিরব, মহাখালীর সানজিদার পর একই পরিণতি ঘটল মিরপুরের সাব্বিরের। শুক্রবার বেলা এগারোটায় মিরপুরের একটি নর্দমা থেকে সাব্বিরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার মৃতদেহ উদ্ধারের পরপরই ওই এলাকাবাসী চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শিশুটির মৃতদেহ সামনে রেখেই বিক্ষুব্ধ লোকজন গালিগালাজ করেছে সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসাকে। এমনকি উদ্ধারকারীদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার বিকেলের কোন এক সময় মিরপুরের কমার্স কলেজের পেছনে একটি পয়ঃনিষ্কাশন নালায় পড়ে যায় জুনায়েদ হোসেন সাব্বির নামে চার বছরের এ শিশুটি। এ ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় পরিবারের সদস্যরা সন্দেহজনকভাবে সন্ধ্যার দিকে ফায়ার সার্ভিসকে জানায়। রাত পৌনে এগারোটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেন। রাতে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্মকর্তা মাহমুদুল হক জনকণ্ঠকে জানান, বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে চারটার দিকে মিরপুর-১ নম্বরের কমার্স কলেজের পেছনে সাব্বির নামে চার বছরের একটি শিশু স্যুয়ারেজ নালায় পড়ে যায়। রাতে আমাদের কাছে খবর আসে। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ও চার ডুবুরি রাত পৌনে এগারোটায় ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। মিরপুর ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুল আল আরেফিন জানান, বিকেলে একই এলাকার আমির হোসেনের ছেলে সাব্বির স্যুয়ারেজ লাইনে পড়ে নিখোঁজ হয়। শিশুটির বাবা গাড়িচালক আমির হোসেন জানান, বিকেল তিনটার দিকে ছেলে সাব্বির তার নানার সঙ্গে ওই ময়লা নালার পাশে খেলছিল। শিশুটির নানা বিষয়টি খেয়াল করেননি। কিছুক্ষণ পর দেখেন শিশু সাব্বির তার সামনে নেই। এর পর থেকে ওই ময়লার নালায় পড়ে গেছে বলে ধারণা করেন তারা। একপর্যায়ে রাত নয়টার দিকে তারা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। তাদের ধারণা, শিশু সাব্বির ওই নর্দমার নালায় পড়ে যায়। রাত পৌনে দশটা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ওই ময়লার ড্রেনেজ নালার এক কিলোমিটার পর্যন্ত ডুবুরি দল বার বার উদ্ধার অভিযান চালিয়ে শিশু জুনায়েদকে না পেয়ে ফিরে আসে। রাতে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করে চলে যান দমকলবাহিনীর সদস্যরা। পরদিন শুক্রবার সকাল থেকে আবারও শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। চলে পৌনে দুই ঘণ্টা। এর মাঝেই তার মৃতদেহের সন্ধান মেলে ৬নং রোডের পেছনে নালার জালের পাশে। নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর পাওয়া তার মৃতদেহ। এ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, শুক্রবার বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে ওই নালার মধ্যে একটি ময়লার স্তূপ পরিষ্কার করার পর শিশুটির লাশ পাওয়া যায়। স্যুয়ারেজের খালের পাশে ঘর তুলে সেখানে বসবাস করে সাব্বিরের পরিবার। বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে হালকা বৃষ্টির মধ্যে সে খালপাড়ে খেলছিল। হঠাৎ তার নানা শিশুটিকে দেখতে না পেয়ে ধরে নেন- নিশ্চিত পানিতে পড়ে গেছে। স্বজনদের অভিযোগ, ডুবুরিরা ঠিকমতো সহায়তা করেননি। জুনায়েদের এক মামা নিজে পানিতে ডুবে ডুবে সন্ধান চালিয়ে মৃতদেহ দেখতে পান। পরে ডুবুরিরা এসে তার সঙ্গে যোগ দেন। খোলা ছয় ফুট চওড়া ও চার ফুট গভীর ওই নর্দমার ড্রেন দিয়ে বাসাবাড়ির পয়ঃনিষ্কাশনের পানি, ময়লা পানি ও বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে। বাসা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে এমনই নোংরা পরিবেশে শিশুটির মৃতদেহের সন্ধান মেলে। মৃতদেহের সুরতহাল দেখে পুলিশ ও ডুবুরিদের ধারণা, শিশুটি পানিতে পড়ার মিনিট কয়েকের মধ্যেই প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু তার স্বজনরা এটা মানতে পারছেন না। তাদের অভিযোগ, বার বার খবর দেয়ার পরও তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে যায়নি সিটি কর্পোরেশনের ক্লিনার ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। তারা অনেক বিলম্বে সেখানে গিয়ে সন্ধান তৎপরতা চালায়। যদি খবর পাওযার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ঘটনাস্থলে হাজির হতো তাহলে শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা যেত। নালায় পড়ে নিখোঁজ হওয়ার প্রায় ১৯ ঘণ্টা পর চার বছরের শিশু জুনায়েদ হোসেন সাব্বিরকে পাওয়া গেছে মৃত অবস্থায়। ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, শুক্রবার বেলা ১০টা ৫০ মিনিটে ওই নালার মধ্যে একটি ময়লার স্তূপ পরিষ্কার করার পর শিশুটির লাশ পাওয়া যায়। জিহাদ থেকে সাব্বির ॥ শাহজাহানপুরে শিশু জিহাদের করুণ মুত্যু ঘটে ওয়াসার পাম্পে পড়ে গিয়ে। ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর হৃদয়বিদারক ওই ঘটনায় রাজধানীসহ গোটা দেশে তোলপাড় চলে। রাজধানীসহ কোটি কোটি মানুষ সারারাত জেগে টেলিভিশনের সামনে বসে লাইভ উদ্ধারকাজ প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু পরদিন বিকেল তিনটার দিকে মহল্লার তিন উদ্যমী যুবকের নিজস্ব উদ্ভাবনী যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ধার করা হয় জিহাদের মৃতদেহ। একদিকে ওয়াসার গাফিলতির দরুন খোলা পাম্পে পড়েছে জিহাদ, অন্যদিকে তাকে উদ্ধারেও ওয়াসা ও দমকলবাহিনীর ব্যর্থতা চরম ন্যক্কারজনক। এ দুটি সংস্থা যখন উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে তার পরই তিন উদ্যমী যুবক নিজস্ব পদ্বতিতে উদ্ধার করে জিহাদের মৃতদেহ। তার আগেও ঘটেছে আরও অনেক কা-কীর্তি। বিকেলে ঘুমন্ত মাকে ফাঁকি দিয়ে বাইরে খেলতে যায় জিহাদ। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি মাঠের এক কোণে ছিল ওয়াসার ঢাকনাবিহীন পাম্প। খেলতে গিয়ে হঠাৎ ওই পাম্পে পড়ে যায় জিহাদ। সেদিন ছিল শুক্রবার বিকেল চারটা। বালুরমাঠ সংলগ্ন ওয়াসার ওই পানির পাম্পের কাছে ফাতেমা (৬), পুষ্পিতা (৭) ও মনসুরসহ (৭) কয়েকজনের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করছিল। দৌড়াদৌড়ির একপর্যায়ে জিহাদ ওয়াসার পাম্পের একটি পরিত্যক্ত খোলা পাইপের ভেতর পড়ে যায়। ফাতেমা ও পুষ্পিতা বিষয়টি কলোনির বাসিন্দাদের জানায়। এ সময় একজন প্রত্যক্ষদর্শী ওই কূপের কাছে গিয়ে কান পেতে কান্না শুনতে পায়। সঙ্গে সঙ্গেই খবর দেয়া হয় জিহাদের মায়ের কাছে। তাদের মাধ্যমে খবর পেয়ে ফায়ার সার্র্ভিসের পাঁচটি ইউনিট উদ্ধারকাজ শুরু করে। ছুটে আসে দমকল, ওয়াসা ও মিডিয়া। চলে সরাসরি উদ্ধারকাজের সম্প্রচার। নগরবাসী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে টিভির সামনে। দেশবাসী শিশুটির জীবিত উদ্ধারের প্রার্থনাও করেছে কায়মনোবাক্যে। রাত তিনটার দিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক সাংবাদিকদের বলেন, ভেতরে কোন লাশের অস্তিত্ব নেই বা কোন মানুষ থাকার আলামত মিলছে না। বিষয়টি গুজবও হতে পারে বলে ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সরকারের দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্যের পর মুহূর্তেই নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। জিহাদ অপহরণ, পূর্বশত্রুতার জের ধরে হত্যা, অন্যকে বিপদে ফেলতে জিহাদের পিতা পরিকল্পিতভাবে ছেলে লুকিয়ে রেখে নাটক সাজাতে পারে অথবা সরকার বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দেশবাসীর দৃষ্টি ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দিতেও পরিকল্পিতভাবে এমন কাজ করতে পারে। এমন গুজব ডালপালা মেলতে থাকে। এমন গুজবের পর রাত সাড়ে তিনটার পর শাহজাহানপুর থানা পুলিশ জিহাদের পিতাকে তাদের হেফাজতে নেয়। পরদিন শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ভেতরে কোন লাশের অস্তিত্ব নেই জানিয়ে তাদের উদ্ধার তৎপরতা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন। তবে স্থানীয় উদ্ধারকারীদের ফায়ার সার্ভিস সহায়তা করার আশ্বাস দেয়। এমন ঘোষণার আধা ঘণ্টা পরই স্বেচ্ছাসেবী ও স্থানীয়রা জিহাদের লাশ ওই পাইপ থেকে উদ্ধার করে। জিহাদের লাশ উদ্ধারের পরপরই তার পিতাকে পুলিশ পাহারায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। জিহাদের পিতা সেখানে অভিযোগ করেন, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পাইপের ভেতরে কোন লাশ বা মানুষের অস্তিত্ব নেইÑ এমন ঘোষণার পরই পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। তাকে ক্রসফায়ারসহ নানা ভয়ভীতি দেখায়। এদিকে লাশ উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর শাস্তি দাবিসহ ওই এলাকায় বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভকারীরা ওয়াসার ওই পাম্পসহ বেশকিছু দোকানপাট ভাংচুর করে। থানা হেফাজতে পিতাকে জিহাদের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য দিতে বলা হয়। একপর্যায়ে তাকে চাপও দেয়া হয়। জিহাদ নিখোঁজ হওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়। কোন পূর্বশত্রুতার জের ধরে বা ব্যক্তিগত স্বার্থে জিহাদকে কেউ অপহরণ করেছে কি-না বা সত্যই জিহাদ ওই পাইপে পড়েছে কি-না সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। আলোচিত ওই ঘটনার পরদিন শনিবার রাতে জিহাদের পিতা নতুন পাম্প স্থাপনকারী এসআর হাউজের স্বত্বাধিকারী আব্দুস সালাম ও রেলওয়ের সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিদের গাফিলতির কারণেই তার ছেলে পাইপে পড়ে মারা গেছে। পাইপের মুখে ঢাকনা থাকলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না। এ ঘটনায় হাইকোর্টের এক রায়ে জিহাদের পিতাকে ত্রিশ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় বিবাদীদের। নিরব ॥ জিহাদের পর কিছুদিন ওয়াসার চোখে পড়ে খোলা স্যুয়ারেজ ও ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের তদারকিতে। কিন্তু বছর না যেতেই আবারও ঘটে একই ধরনের দুর্ঘটনা। এবার শিকার হয় নিরব নামের এক শিশু। ঘটনাস্থল রাজধানীর কদমতলীতে। ওয়াসার স্যুয়ারেজ পাইপে পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে পাঁচ বছর বয়সী শিশু নিরবের। কাকতালীয় হলেও সত্য, জিহাদের মতো নিরবও ডিসেম্বর মাসেই খেলতে গিয়ে প্রায় একই সময়ে ওয়াসার পাইপেই পড়ে যায়। জিহাদের লাশ ২৩ ঘণ্টা পর উদ্ধার হয়েছিল। আর নিরবের লাশ উদ্ধার হয় চার ঘণ্টা পর ঘটনাস্থল থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার ভাটিতে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে। এ ঘটনাও তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দেয় সরকার। কিন্তু ঘটনার আট মাস পর আজও প্রকাশ করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদন। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণকারী ঠিকাদারকে হন্যে হয়ে খুঁজলেও তার সন্ধান পায়নি। লাইন তৈরির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করলেও আজও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ শুক্রবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজও নিরব পরিবারের শোক কাটেনি। তার পিতা রেজাউল করিম আরএফএল কোম্পানিতে কর্মরত। তিনি আজও শিশুপুত্রের ছবি বুকে নিয়ে কাঁদেন। নিরবের মা নাজমা বেগম শোকে এখনও পাথর হয়ে আছেন। মাসিক ৩ হাজার টাকায় সুরুজ মিয়ার ৭৮ নম্বর একতলা টিনশেড বাড়ির একটি কক্ষে ভাড়ায় বসবাস করেন। বাড়ির সামনেই রেললাইন। সেই লাইন ঘেঁষা ছোট্ট খালের পাড়ে ত্রিভোজ আকৃতি একটি খেলার মাঠ। তাতেই পাড়ার সব ছেলেমেয়ে বিকেল হলেই নানা ধরনের খেলায় মেতে ওঠে। সেখানে ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইন। নতুন তৈরি করা লাইনে পর পর দুটি চৌবাচ্চা রয়েছে। তার একটি পুরোপুরি সিমেন্টের পাটাতন দিয়ে ঢাকা। আরেকটি অর্ধেক ঢাকা। প্রায় পাঁচ ফুট পাটাতনের আড়াই ফুট সিমেন্টের পাটাতন দিয়ে ঢাকা; বাকিটুকু ফাঁকা। ঘটনার দিন নিরবের পিতা ছিলেন কর্মের তাগিদে বাইরে। মা সংসারের কাজে ব্যস্ত। এই ফাঁকে সমবয়সী হৃদয় ও রাতুলের সঙ্গে সেই মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিল সে। দৌড়াদৌড়ির এক পর্যায়ে সেই ম্যানহোলে পড়ে যায় নিরব। সঙ্গে সঙ্গে খেলার সাথীরা বিষয়টি সেখানে থাকা লোকজনকে জানায়। লোকজন স্যুয়ারেজ লাইনের কাছে যেতে যেতেই প্রচ-গতিতে যাওয়া নিরবকে টেনে নিয়ে যায় স্যুয়ারেজ লাইনের ভেতরে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি দল ও পুলিশ উদ্ধার অভিযানে নামে। তারা ভাঁটির দিকে অন্তত ১০টি স্যুয়ারেজ লাইনের ইস্পাতের পাটাতন গ্যাস কাটার দিয়ে দ্রুত কেটে নিরবকে সার্চলাইট দিয়ে খুঁজেন। কিন্তু স্যুয়ারেজ লাইনের পানির গতি মারাত্মক বেশি থাকায় নিরবকে উদ্ধার করতে পারেনি। কারণ নিরব যে স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মৃত অবস্থায় পড়েছে সেখান দিয়ে কদমতলী এলাকার সব কারখানার বর্র্জ্য ও পানি বের হয়। শেষ পর্যন্ত নিরব স্যুয়ারেজ পানির লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ে। তখন সন্ধ্যা আনুমানিক ছয়টা। সেই স্যুয়ারেজ লাইনের পাশেই একজন বৃদ্ধ মাছ শিকারের জন্য বড়শি ফেলেছিলেন। আচমকা একটি শিশুর মরদেহ স্যুয়ারেজের লাইন দিয়ে তিনি পড়তে দেখেন। এরপর তিনি নামতে যান। এ সময় পানির তোড়ে নিরব আবার ডুবে যায়। আর নিরবকে দেখা যাচ্ছিল না। তার কথায় সবাই সেই স্যুয়ারেজ লাইনের কাছে গিয়ে হাজির হন। তৎক্ষণাত ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা সেখানে নিরবকে খুঁজতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত রাত আটটার পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরীরা নিরবকে সেখানে থাকা বালু উত্তোলনের ড্রেসারের পাখার সঙ্গে আটকে থাকা অবস্থায় উদ্ধার করে। পরদিন নিরবকে মাদারীপুর জেলার কালকিনি থানাধীন পুরঘাটা এলাকার পশ্চিম বেণুগ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। সানজিদা ॥ জিহাদ ও নিরবের পর মরণ যেন অপেক্ষায় ছিল আরও এক শিশুর। হতভাগ্য সেই শিশুটিই সানজিদা। মহাখালীর খালে পড়ে যাওয়া ছয় বছরের কন্যাশিশু সানজিদা আক্তারও প্রাণ হারায় নিরবের মতোই। গত ১২ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল দশটার দিকে সানজিদাকে উদ্ধার করা হয়। মৃত শিশুটিকে উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদের রীতিমতো ১৯ ঘণ্টা অভিযান চালাতে হয়েছে। লাশ উত্তোলনের সময় শত শত মানুষ ভিড় করেন খালের দুই পাড়ে। সেই ভিড়ের মধ্যেই ছোট মেয়ের এমন মৃত্যুর খবরে বারবার মূর্ছা যান পিতামাতাসহ পরিবারের অনেকেই। সানজিদার এমন মৃত্যুতে শোকের ছায়া এখনও কাটেনি। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল লাগোয়া পূর্বদিক দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটির পাড়ে খেলতে গিয়ে পড়ে যায় দুই শিশু সানজিদা আর তামিম। তামিম কোনমতে মাটি খামচে উপরে উঠতে সক্ষম হয়। কিন্তু সানজিদা খালের পানিতে ডুবে যায়। সানজিদার মা রুবি আক্তার সাংবাদিকদের বলছিলেন, দুপুর দেড়টার দিকে ঘটনাটি ঘটে। খালের পানির গভীরতা ১৪ থেকে ১৫ ফুট। সাঁতার না জানায় সানজিদা ডুবে যায়। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার বড় ছেলেসহ ৮-১০ জন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁজতে থাকে। সানজিদা যেখানে পড়েছিল তার কাছেই সেন্ডেল দুটো খালের পানিতে ভাসছিল। স্থানীয়রা সানজিদাকে উদ্ধার করতে না পেরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। দুপুর তিনটা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যার পর জেনারেটরের সাহায্যে সার্চলাইট জ্বালিয়ে টানা রাত বারোটা পর্যন্ত অভিযান চালায়। কিন্তু হদিস মেলেনা সানজিদার। খালের পাড়ে রাস্তা না থাকায় উদ্ধার অভিযান রাত বারোটায় মহাখালী এলাকায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে খালের পানিতে স্রোত থাকায় ভাটির দিকে অভিযান চলতে থাকে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় সকাল ১০টায় সানজিদার মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা। ডুবুরিরা জানান, সানজিদা যেখানে পড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে মাত্র দেড় শ’ গজ ভাঁটির দিকে একটি ময়লার স্তূপের ভেতরে ঢুকে আটকে ছিল সানজিদার লাশ। স্রোতের টানে সানজিদা নিচে চলে যায়। এরপর ময়লার স্তূপে ঢুকে পড়ে। কোথাও যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন খালের পানির নিচে থাক ময়লার স্তূপে লাশ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। সে মোতাবেক ময়লার স্তূপ সরানো হয়। আর ময়লা সরাতে সরাতেই সকাল দশটার দিকে সানজিদার লাশ মেলে। সানজিদার লাশ যখন খালের পাড়ে আনা হয়, তখন দুই পাড়ে শত শত মানুষের ভিড় জমে। ছোট্ট শিশু সানজিদার পরনে হাফপ্যান্ট ছিল। নোংরা পানিতে শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যায়। এমন নির্মম মৃত্যু মেনে নিতে পারছিলেন না সেখানে উপস্থিত লোকজন। সবার মুখেই আফসোস। তারা অবুঝ শিশুর কষ্টের মৃত্যুতে কাঁদছিল। এ সময় ভিড়ের মধ্যে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন সানজিদার মা-বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। সানজিদার পিতা মহাখালী বাস টার্মিনালের ভ্যানচালক। ছোট ভাই, এক বোন আর পিতামাতার সঙ্গে সানজিদা মহাখালী দক্ষিণপাড়া বস্তিতে মাসিক আড়াই হাজার টাকা ভাড়ায় একটি কক্ষে বসবাস করছিল। সানজিদাকে আগামী জানুয়ারিতে স্কুলে ভর্তি করার পরিকল্পনা ছিল পিতামাতার। দায় কার ॥ রাজধানীতে ওযাসার ঢাকনাবিহীন পাম্প, খোলা নর্দমা, ও পয়ঃনিষ্কাশনের পানিতে পড়ে ঘটছে এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। গত দুই বছরে চারজন শিশুর করুণ মৃত্যুর দায় কার? এ প্রশ্নই এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। শুক্রবার মিরপুরে যখন জুনায়েদের লাশ উদ্ধার করা হয় তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র মারুফ সাংবাদিকদের সামনে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এভাবেÑ আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে ওই ধরনের নর্দমা খোলা রাখা ছিল বলেই এ দুর্ঘটনা। এ নর্দমা যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়া থাকত তাহলে জুনায়েদ পড়ত না, মরত না। জুনায়েদের নানা বলেছেন, হঠাৎ করে নাতি আমার পড়ে গেল। দেখতেও পারলাম না। যদি এখানে না আসতাম, তাহলে তো নাতি আমার পানিতে পড়ত না। অভিভাবকদের অভিযোগ, জিহাদের দুর্ঘটনা থেকেও শিক্ষা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ানোর পর একটি রুলিংও দেয়া হয়। এ ধরনের খোলা নদর্মা খাল, ঢাকনাবিহীন পাম্প ও অন্যান্য বিপজ্জনক জলাশয় তদারকির জন্য সুনির্দিষ্ট একটি নির্দেশনা থাকার পরও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। রাজধানীতে এ সঙ্কট দেখভাল করার দায়ভার ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের। কিন্তু বারবার তাদের গাফিলতিতেই ঘটছে এ ধরনের দুর্ঘটনা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতে এ ধরনের অসংখ্য মৃত্যুফাঁদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা শিশুদের জন্য বিপজ্জনক। শিশু জিহাদ থেকে জুনায়েদ পর্যন্ত চার চারটি দুর্ঘটনার পরও আর এ ধরনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে নাÑ তেমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। এখনও মিরপুরের এ নর্দমা, মহাখালীর খাল কবেনাগাদ সংস্কার করে শিশুদের জন্য নিরাপদ করা হবে তাও অনিশ্চিত।
×