ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাজউদ্দীন আহমদ ও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২৩ জুলাই ২০১৬

তাজউদ্দীন আহমদ ও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস

তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) তাঁর ধীশক্তি, সাংগঠনিক কুশলতা ও অকপট দেশপ্রেম স্বমহিমায় ভাস্বর। তিনি ১৯২৫ সালে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানাধীন দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৮ সালে আইএ এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৪ সালে আইন ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৭-’৭১ সময়কালের ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা বঙ্গবন্ধুর সহযোগী জাতীয় রাজনীতিকদের রাজনৈতিক কর্মকা- পর্যালোচনায় দেখব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোগী হিসেবে সকল আন্দোলনে তাজউদ্দীনের অংশগ্রহণ ছিল। একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জনাব এম এ হান্নান। এই ঘোষণা পাঠে দেশের বাঙালী সৈন্য রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণ অনুপ্রাণিত হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা বিগত পাকিস্তানী আমলের সংগ্রামী জনগণের আস্থাশীল নেতৃত্বের ফসল- এটা কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ইয়াহিয়া খান ২৬ মার্চ রাতে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বললেন, তাঁর শাস্তি হবে জানালেন এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চে ঢাকায় গণহত্যার প্রেক্ষিতে তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ঢাকা থেকে গাঢাকা দিয়ে ফরিদপুর ইমাম ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গোপনীয়তা রক্ষা করে তাদেরকে গোকুলনগর-চুয়াডাঙ্গা পথে পাঠিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ অপরাহ্ণে জনপ্রতিনিধি দ্বারা প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ মূলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। এই ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পত্রটিই বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান বা লিগেল স্ট্যাটুট। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এমএনএ ঘোষণাপত্রটি রচনা করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১১ এপ্রিল ১৯৭১ জাতির উদ্দেশে এক গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁদের যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে। (সংক্ষেপিত)।’ ১৩ এপ্রিল আমরা ফরিদপুর সংগ্রাম কমিটির আলোচনার সিদ্ধান্ত মতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ফণি মজুমদার, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, এ্যাডভোকেট ইউসুফ হুমায়ুন (ভোলা) মাগুড়া-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছি ১৪ এপ্রিল। অনেক কষ্টে ১৫ এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছি এবং কিডস্ট্রীটের এমএলএ হোস্টেলে আশ্রয় নেই। পরবর্তীতে সরকার গঠন ও শপথ অনুষ্ঠানে আমরা উপস্থিত হলাম মুজিবনগরে। উনিশ শ’ ষাটে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্রজীবন থেকে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শিক কর্মী বা সহযাত্রী। ফরিদপুরের রাজনীতিতে ষাটের দশক ছিল আন্দোলন, জেলজুলুম ও অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীর নিষ্ঠা ও শ্রম দিয়ে গড়া। আমার সঙ্গে তাজউদ্দীন স্যারের প্রথম পরিচয় হয় ছয় দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসে। আমি তখন ফরিদপুর সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পর আমি স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণ মন্ত্রীর জনসংযোগ অফিসার হিসেবে পশ্চিমবাংলার শরণার্থী শিবির সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। বাঙালী শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাদের মতামত আমার প্রতিবেদনে স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রীকে জানিয়েছি। মন্ত্রী কামারুজ্জামান বিষয়গুলো ভারত সরকারের অতিরিক্ত সচিব কর্নেল (অব) পিএন লুথরা (যিনি ত্রাণকার্যে পরিচালনার জন্য সেক্সপীয়ার সরণীতে দফতর খুলেছিলেন) সঙ্গে আলোচনা করতেন। ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ শনিবার ৩ বৈশাখ ১৩৭৮ : মুক্ত বাংলার কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলার (মুজিব নগর) আমবাগানে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি দ্বারা প্রণীত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ এবং মুজিব নগরকে অস্থায়ী রাজধানী করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই স্থানের নাম মুজিনগর নামকরণ করেন। আমবাগানের অনুষ্ঠানে ভর দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বীর বাঙালী অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি সেøাগান। এবার শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা। বাংলাদেশের জলে-স্থলে শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের মুক্তিযুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শপথ গ্রহণের পর ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে এক দীর্ঘ প্রেস বিবৃতি প্রদান করেন।Bangladesh is at war. It has been given no choice but to secure it right of self-determination through a national liberation struggle against the colonial oppression of West Pakistan…Pakistan is now dead and buried under a mountain of corpses... (excerpt) একাত্তরের ২৭ ও ৩১ মার্চ ভারতের লোকসভায় সরকারী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা থেকে বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা, শরণার্থীদের আশ্রয়দান, যুবশিবির স্থাপনে সাহায্য ও মুজিব বাহিনীকে প্রশিক্ষণ, নিয়মিত বাহিনী তথা সেক্টর কমান্ডার সেনাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, রসদ ও সর্বপ্রকার সাহায্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন, বিশ্বব্যাপী গণসংযোগ ও প্রচার, প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের অর্থাৎ মুজিবনগর সরকারকে সব রকম সহযোগিতা প্রদান করে ভারত সরকার। ভারত শুরু থেকেই ১ কোটি শরণার্থীদের বোঝা বেশিদিন সামলানো সম্ভব হবে না এ পটভূমিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের নীতি পরিবর্তন হতে থাকে। এই নীতির প্রথম পরিবর্তন প্রকাশ পায় ৯ আগস্ট ’৭১ স্বাক্ষরিত ২০ বছরের ভারত-সোভিয়েত শান্তি মৈত্রী, ও সহযোগিতার চুক্তি। চুক্তিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য বিশেষ বার্তাবহ ছিল। আগস্ট মাসে পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা চালু হলো। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার্থে এগিয়ে এলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তৎকালীন চৈনিক নেতৃত্বের নীতি একাধারে বৈরী ও বিতর্কিত ছিল। একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের আহ্বানে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে পাঁচটি সংগ্রামী দলের প্রতিনিধিদের সমবায়ে মন্ত্রিসভার পরামর্শদাতা কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিং, জাতীয় কংগ্রেসের শ্রীমনরঞ্জন ধর ও ভাসানী ন্যাপের মওলানা ভাসানী ছিলেন। এই সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন মতবাদীদের মধ্যে সমালোচনা স্তিমিত হতে থাকে। ডিসেম্বর ৩, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে চীন প্রকাশ্যে জাতিসংঘে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করে এবং সোভিয়েতের যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশ সরকারকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়। ভারত সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রূপ দেয়- সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘে তিনবার ভেটো প্রয়োগ করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিশ্চিত করে তোলে। ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আজ বিনাশর্তে মুক্তিবাহিনীর সহযোগী ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পূর্ণমুক্তি লাভ করল। আত্মসমর্পণের নথিপত্র স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ পাকবাহিনী প্রধান লে. জে. নিয়াজী এবং ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জি ও সি ইন সি লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা। রমনা রেসকোর্স ময়দানে বিকাল ৪ টা ৩১ মিনিটে এই নথি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুত্থান ঘটে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিবনগর সরকারের সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করতেন এবং সিদ্ধান্ত দিতেন। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা, সরকারের দৈনন্দিন কার্যাবলী পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, শরণার্থী সমস্যা ও তাদের নিরাপদে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন, দেশের বাইরে জনমত সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলাবেতার কেন্দ্র পরিচালনাসহ কূটনৈতিক কর্মকা-ের মতো বিশাল দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারে ভারতের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর অত্যাচার, নির্বিচার গণহত্যা, এক কোটি বাঙালীকে ভারতে আশ্রয় প্রদান, প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের পাক-অত্যাচার ও গণহত্যাকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের অজুহাত প্রতিহত করে বাইরের পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই নিরুদ্দিষ্ট দিনে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কিভাবে তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা তাঁর উক্তিতে জানা যাক। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দৈনিক পূর্বদেশের সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন : সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনায় যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা বাংলাদেশ এবং এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থেই নিয়েছিলাম। বাঙালীর আশা-আকাক্সক্ষা আর বাঁচা-মরার প্রশ্নকে সেদিন সবচেয়ে উঁচুতে স্থান দিয়েই আমি কাজ করে গিয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এবং একজন খাঁটি বাঙালী হিসেবে আমার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারায় আমি খুশি। তবে সামগ্রিক সাফল্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই। আমরা যা করেছি তা তাঁরই নির্দেশিত পথে। বাংলাদেশের এই বিপ্লব কোন একদিনের ঘটনা নয়। এর জন্য আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বাঙালী জাতিকে ধীরে ধীরে বিপ্লবের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে এবং এভাবেই তাদের মানসিক প্রস্তুতি ঘটিয়েছে। এরপর ২৫ মার্চ রাতে জেনারেল ইয়াহিয়ার বর্বরবাহিনী নিরীহ বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সমগ্র বাঙালী জাতি তার প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ শপথ নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামলা শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে পালিয়ে আমি জীবননগরে পৌঁছাই। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। পালিয়ে যাওয়ার পথে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা লাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। ১০ এপ্রিল আমি স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করি এবং এদিনই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ১১ এপ্রিল মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য আমি বিভিন্ন সেক্টরের নাম ঘোষণা করে সেক্টর কমান্ডারও নিয়োগ করি। আমরা মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা নামক স্থানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মনোনীত করে এর নাম দিই ‘মুজিবনগর’। ১৮ এপ্রিল কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করি। সেই সঙ্গে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীতে লোক নিয়োগ। নিয়মিত, অনিয়মিত, আনসার, পুলিশ, যুবক, তরুণ মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার। আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তেমনি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শেষ করার লক্ষ্য ছিল নবেম্বর মাস। কেননা, আমি জানতাম বাংলাদেশে বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরাস্ত করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ সফলকাম হবে না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাও আসবে না।” সূত্র: দৈনিক পূর্বদেশ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২।) ঢাকা ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ : বঙ্গভবনে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ আহূত সংবাদ সম্মেলন (বাঁ থেকে) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। ফটো : আফতাব আহমেদ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ঢাকাস্থ কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে ৬ পৌষ ১৩৭৮, বুধবার, ২২ ডিসেম্বর ’৭১ বিকাল ২.৩৮ মি: অবতরণ করেন। মুজিব নগর থেকে মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও সচিবালয় স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় ২২ ডিসেম্বর ’৭১ তারিখে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর বিশ্বস্ত সহচর জাতীয় নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান ও এম মনসুর আলী প্রমুখের যৌথ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষতায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতিকে সার্বিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে লেখা হলো মুক্ত বাংলার স্বাধীনতার রক্তাক্ত ইতিহাস। স্বাধীনতার নায়ক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্যমতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিয়ে পূর্ণ হলো বাঙালী জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, মুজিবনগর সরকারের সংগঠক সাবেক অতিরিক্ত সচিব
×