ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকে জঙ্গী উস্কানি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৩ জুলাই ২০১৬

ফেসবুকে জঙ্গী উস্কানি

আরাফাত মুন্না ॥ ‘যারা পিস টিভি মিস করছেন, তারা ডিশ লাইন কেটে দিন এবং আল কায়েদার ভিডিওগুলো দেখা শুরু করুন’ আল কায়েদার কয়েকটি ভিডিওর লিংক দিয়ে এভাবেই পোস্ট দেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ‘মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া’ নামের একটি ফ্যান পেজে। পেজটিতে একটু ঘাটলেই দেখা যাচ্ছে দুটি শিশুর বীভৎস লাশের ছবি দিয়ে লেখা রয়েছে ধর্মীয় উগ্রধর্মী নানা বক্তব্য। ‘সালাউদ্দিনের ঘোড়া’ নামের আরেকটি পেজে গেলেও দেখা যাবে এ ধরনের অনেক পোস্ট। ‘তিতুমীর মিডিয়া’ নামের অন্য আরেকটি পেজে গেলে পাওয়া যাচ্ছে ধর্মীয় উস্কানিমূলক বিভিন্ন ভিডিও। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে রয়েছে জঙ্গী বানানোর এ ধরনের অসংখ্য ফাঁদ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই চলছে এসব পেজ বা গ্রুপ। এখানে জিহাদী পোস্ট থেকে শুরু করে ‘দ্বীনের দাওয়াত’ দেয়া চলছে নির্বিঘেœ। কখনও সরাসরি, কখনওবা জাকির নায়েকের নানান ভিডিও দিয়ে জিহাদের ডাক দেয়া হচ্ছে। ‘মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া’, ‘সেপারেটলি সেকিং ইসলাম’, ‘সালাউদ্দিনের ঘোড়া’, ‘তিতুমীর মিডিয়া’র মতো পেজ বন্ধ করা হলেও মুহূর্তের মধ্যে আরেকটি পেজ খুলে ফেলা হচ্ছে। ফেসবুকে ‘ডেসপারেটলি সেকিং ইসলাম’ নামেই পাঁচটির বেশি পেজ পাওয়া গেছে। ‘ডেসপারেটলি সেকিং ইসলাম’ পেজগুলোতে গিয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সেখানে জাকির নায়েকের নানা পোস্ট দেয়া আছে। একটি পোস্টে বলা হয়, ‘হিন্দু কোনও ধর্ম নয় বললেন ডাঃ জাকির নায়েক। হিন্দু-মুসলিম ভাইয়েরা সবাই দেখতে পারেন এই ভিডিওটি। দাওয়াতি কাজের উদ্দেশে ভিডিওটি শেয়ার করবেন।’ আরেকটি পোস্টে জিহাদ কেন দরকার বলতে গিয়ে কোরানের আয়াত তুলে ধরে বলা হয়, ‘বন্ধুরা আমার, আজ মুসলিম জাতির এ করুণ পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টিপাতকারী যে কোন মানুষ অতিসহজেই অনুধাবন করতে সক্ষম হবে যে, মুসলমানদের এ দুরবস্থার মূল হচ্ছে, জিহাদ ছেড়ে দেয়া, যা হাদিসের ভাষায় দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। পথভ্রষ্ট জালিম শাসকরা আজ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানদের ঘাড়ের ওপর সওয়ার হয়ে বসে আছে।’ বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব পেজ বন্ধ করাই সমাধান নয়। এদের ধরে বিচারের মুখোমুখি করলে প্রচারের হার কমে যেত এবং কম মানুষের দৃষ্টিসীমায় আসত। ফাঁদে ফেলার পদ্ধতি জানতে চাইলে বিশ্লেষকরা বলেন, কে কী ধরনের মন্তব্য করছে তা দেখে তার প্রোফাইল যাচাইবাছাই করে তারপর শুরু হয় ব্যক্তিগত আলাপ। আর এই ফাঁদে ফেলতে শুরুতে স্টাডি সার্কেল এবং তারপর রয়েছে দীনের দাওয়াত। একটা সমমনা গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার পর সেখান থেকে বেছে অল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে মূল গ্রুপ থেকে সরিয়ে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করানো হয়। একসঙ্গে উঠবস করলেও অপারেশনের জন্য যাদের বেছে নেয়া হলো তাদের কোন কর্মকা-ের বিষয়ে তখন আর ওই পুরো সার্কেলের কেউ কিছু জানতেও পারেন না। পুরো প্রক্রিয়াটার জন্য একজনের পেছনে সময় দিতে হয় কম করেও দেড়-দুই বছর। জঙ্গীবাদ বিষয়ে গবেষকরা বলছেন, যারা এসব করছে তারা অনেক বেশি টেকনোলজিক্যালি এগিয়ে আছে। এদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এই প্রক্রিয়াকে থামানো যাবে না। যারা এই ধরনের ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ানোর ফেসবুক পেজ চালায় তারা ‘সম্ভাব্য জঙ্গী ’। এদের ধরে ধরে বিচারের মুখোমুখি না নিতে পারলে এটা কমবে না এবং ওদের আদর্শ ইন্টারনেটের সহায়তায় সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকবে। কর্মী সংগ্রহ করার বিষয়ে সম্প্রতি এমন একটি ফেসবুক গ্রুপ থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসা এক প্রবাসী বাংলাদেশী বলেন, প্রথমে একটা গ্রুপে যোগ দেই আমি। একেবারেই সাদামাটা একটা ফেসবুক গ্রুপ যারা রক্তদান কর্মসূচীসহ সামাজিক নানা কর্মসূচী করত। এরপর হঠাৎ হঠাৎ অনেকটা ধর্মীয় সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে মতামত চেয়ে পোস্ট দেয়া হয়। পোস্টে তর্কবিতর্ক করার জন্যও নিজেদের মধ্যে এ্যাসাইন করা লোকজন থাকে। যিনি তর্কে নতুন লিপ্ত হচ্ছেন তাকে নানাভাবে কনভিন্স করার মতো একেকজন একেক জায়গা থেকে কমেন্ট করে একটা গ্রাউন্ড তৈরি করে। শুরুতে না বুঝলেও পরে বুঝতে পেরে তিনি তার সব যোগাযোগের রাস্তা পরিবর্তন করে ফেলেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশিদ বলেন, যারা ব্রেন ওয়াশ করতে চায় তারা কয়েকটি বিষয়ে নজর দিয়ে থাকে। যে কিশোর হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে আছে তার মগজ ধোলাই সহজ। কিংবা এই বয়সী যারা একেবারেই কখনও ধর্মচর্চার মধ্যে ছিল না তাদের মধ্যে ভীতি ঢোকানো সহজ। তারা তাদেরই টার্গেট করছে। মাদ্রাসা ছেড়ে উচ্চবিত্তের দিকে মনোযোগ দিয়েছে এমনটা একেবারেই নয়। প্রত্যেকটা জায়গার জন্যই তাদের টার্গেট রয়েছে। আর অনলাইনের মাধ্যমে তারা এদের কাছে সহজে পৌঁছতে পারছে। কাজেই শক্ত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রচার থামানো যাচ্ছে না। কারণ, ইসলামভীতির কারণে শক্ত অবস্থান নিতে পারিনি। তারা সেই সুযোগ এখনও ব্যবহার করছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিপরীতে শক্ত অবস্থান না নেয়া যাবে ততক্ষণ কোন ইতিবাচক ফলও পাওয়া যাবে না। জঙ্গীবাদের গবেষক নির্ঝর মজুমদার বলেন, নিজেদের মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদানের জন্য আরও একটি কৌশল কাজে লাগায় আইসিসের মত আন্তর্জাতিক জঙ্গীরা। তা হলো টুইটারে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ, যেগুলো খুঁজে বের করা বেশ পরিশ্রমসাপেক্ষ একটি কাজ। এতে যা হয় তা হলো, প্রকাশ্যে থাকলেও তাদের তথ্য বা কথাবার্তা সেই নির্দিষ্ট হ্যাশট্যাগটি না জানলে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না। এই হ্যাশট্যাগগুলো বিভিন্ন সংখ্যা এবং বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কারণে, অন্য কোন উৎস থেকে না জানলে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেসবুকে যখন কোন নির্দিষ্ট সেক্টরকে ধরে প্রচার চালাবেন সেটা আরও অন্য অনেকের কাছে যাচ্ছে। ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের সদস্যরা তেমন করেই আগ্রহী হচ্ছে। প্রথম করণীয়, ফেসবুকে কোন্ জিনিসটা আইনের বাইরে বা আওতায় তা ডিফাইন করা কঠিন। এটাকে আইন দিয়ে কিছু করতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, ওরা যা করে সেটা ধর্মীয় প্রচারের কথা বলে করে। প্রকাশ্যে তারা কখনই কিছু বলবে না। তবে মাঝে মাধেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে হেটস্পিচ ছড়ানোর চেষ্টা করে। সেটাকেই ধরে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সব পেজ বন্ধ করলেও সম্ভব নয়। বন্ধ করলে আরেকটা খুলে যাবে। এগুলো বাংলাদেশের ভেতরে বসে বসে কেউ না কেউ চালায়। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে।
×