ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আমাদের উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণেরাও সন্ত্রাসী হচ্ছে কেন?

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৩ জুলাই ২০১৬

আমাদের উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত তরুণেরাও সন্ত্রাসী হচ্ছে কেন?

বাংলাদেশের সন্ত্রাস একটা নতুন চেহারা ধারণ করেছে বলে অনেকে মনে করছেন। আগে টুপি ও লম্বা কুর্তা পরিহিত গরিব মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্য থেকেই জামায়াত বা হিযবুত ও জেএমবি তাদের ক্যাডার সংগ্রহ করে সন্ত্রাসের ট্রেনিং দেয় মনে করা হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, এই ক্যাডার সংগ্রহ চলছে উচ্চবিত্ত ও সচ্ছল পরিবারের তরুণদের মধ্য থেকেও। তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে আধুনিক উচ্চশিক্ষা পাওয়া যুবক। তাদের পোশাক জিনসের প্যান্ট, প্রিন্টেড শার্ট। মাথায় কালো রুমাল বাঁধা না থাকলে তাদের জিহাদিস্ট ভাবার কোন কারণ নেই। এই রূপান্তরের কারণটা কি? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন আরও উন্নত। বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। তারপরও এক বিরাটসংখ্যক তরুণের মন ও মানসে এই মধ্যযুগীয় পশ্চাদগামিতা কেন? আগে যেখানে রাজনৈতিক সন্ত্রাসী বলতেই উগ্র বামপন্থীদের বোঝাত, সে জায়গা কেমন করে উগ্র ডানপন্থা দখল করল? বিপ্লবী কম্যুনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি ইত্যাদির স্থান কেমন করে দখল করেছে জামায়াত, জেএমবি বা হিযবুত? সিরাজ শিকদারদের স্থানে কেমন করে মাথাচাড়া দেয় বাংলা ভাইয়েরা? আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নাগরিক সংস্কৃতির বিস্তারের অন্তরালে এই বিধ্বংসী সন্ত্রাসের ধারা দিন দিন বেগবতী ও শক্তিশালী হয়েছে, সেদিকে আমাদের সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদেরা কখনও দৃষ্টি ফেরাননি। তারা নাগরিক জীবনের নিরাপত্তার বলয়ে আশ্রয় নিয়ে নগর সংস্কৃতির বাইরে সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে তাকাননি। কেবল দেশের রাজনীতির ওপর সব দোষ চাপিয়ে তারা আরও সুযোগ সুবিধা লাভের প্রতিযোগিতায় মত্ত রয়েছেন। আজ যখন সেই অবক্ষয় রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে, আমাদের নাগরিক নিরাপত্তাকে আঘাত করেছে, তখন চারদিকে আর্তরব উঠেছে, হায় হায় একি হলো? অভিজাত ঘরের সন্তান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, স্কলস্টিকার ছাত্র কিভাবে জিহাদিস্ট হয়? মাওবাদের বদলে মওদুদীবাদ কেমন করে শহুরে শিক্ষিত তরুণদের আকর্ষণ করতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর কোন জবাব না খুঁজে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এবং তথাকথিত সুশীল সমাজ এখনও পারস্পরিক দোষারোপে ব্যস্ত। এই দোষারোপ এবং টিভি টকশো বা মিডিয়ার পাতায় তত্ত্বকথার তর্ক দ্বারা যে এই সমস্যার সমাধান হবে না এই সত্যটা বুঝেও হয়ত তারা না বোঝার ভান করছেন। আগে (স্বাধীনতার কিছু পরেও) সন্ত্রাস ছিল গ্রামভিত্তিক। দলছুট মাওবাদী, নকশালী বা সর্বহারা প্রমুখ বিভ্রান্ত বামপন্থী সন্ত্রাসীরা শ্রেণী সংগ্রাম এবং শ্রেণীশত্রু নিপাতের নামে সন্ত্রাস চালাত উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে। তারা থানা লুট করত, কনস্টেবলকে মারত, জোতদার নাম দিয়ে সচ্ছল কৃষক ও ছোট ব্যবসায়ী হত্যা করত। বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের নিরাপত্তাকে তারা তেমন আঘাত করতে পারেনি। আমাদের নগরজীবনের নিরাপত্তাকে ব্যাপকভাবে আঘাত করেছে বর্তমানের সন্ত্রাসীরা বা জিহাদিস্টরা, দেশের বিভিন্ন স্থানে (ঢাকাসহ) ইতোপূর্বে তারা চালিয়েছে টার্গেট কিলিং। এখন দেশের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে তারা হেনেছে মরণ আঘাত। আমাদের নাগরিক সমাজ, এলিট ক্লাস, মিডিয়া, শাসকশ্রেণী এখন তাই বিচলিত। বামপন্থী সন্ত্রাসে আগেও গ্রামাঞ্চলে বহু নির্দোষ মানুষ খুন হয়েছে, তাতে আমাদের যতটা টনক নড়েনি, এখন তার চাইতে বহুগুণ বেশি টনক টড়েছে নগরকেন্দ্রিক সন্ত্রাসে, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় হামলায় এবং নির্বিচার হত্যাকা-ে। আর এই হত্যাকা-ে অতীতের মাওবাদী বা নকশালীরা জড়িত নয়। জড়িত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অভিজাত ঘরের ধনীর দুলালেরা। এবং সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের সন্ত্রাস বর্তমান আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত। অতীতে উগ্র ও বিভ্রান্ত বাম সন্ত্রাসে বহু নির্দোষ ও নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের উগ্র ডান সন্ত্রাসীদের বর্বরতার কোন তুলনা নেই। আগের মাওবাদী, নকশাল বা সর্বহারা দলের সন্ত্রাসীরাও ছিল শিক্ষিত তরুণ; কিন্তু বেশিরভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের। স্কুল কলেজে লেখাপড়া শেষ করার মাঝপথেই বিপ্লবী রাজনীতির এডভেনচারিজম তাদের পেয়ে বসেছিল। তাদের মধ্যে ছিল এক বিরাটসংখ্যক বেকার তরুণও। বর্তমানের ডানপন্থী সন্ত্রাসী বা জিহাদিস্টরা এদের সম্পূর্ণ বিপরীত। এরা উচ্চশিক্ষিত, অভিজাত ঘরের সন্তান। পিতা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক বা ব্যবসায়ী অথবা উচ্চ সরকারী কর্মকর্তা। এদের কেউ কেউ ইউরোপ-আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। এখন প্রশ্ন, এই একুশ শতকে এরা মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা দ্বারা এতটা প্রভাবিত হয় কি করে? আমাদের তরুণ প্রজন্মের এই রূপান্তর রাতারাতি ঘটেনি, এর শুরু বহু আগে। আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির নেতারা এটা বুঝে উঠতে পারেননি। যারা বুঝতে পেরেছিলেন তারা তাকে গুরুত্ব দেননি। এখানে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আজ থেকে দশ বারো বছর আগে আমি ঢাকায় গেছি। উঠেছি উত্তরায় আমার এক আত্মীয়ের বাসায়। তিনি শিক্ষিত মডার্ন ব্যবসায়ী। তার ছেলে মেয়েরা প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে। সেই টিউটরকে একদিন দেখে বিস্মিত হলাম। পরনে প্যান্ট-শার্ট, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি এবং মাথায় একটি গোলটুপি। তিনি আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে ডক্টরেট করেছেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে। তাই চাকরি বাকরি না করে ইসলাম প্রচার করছেন। একদিন শুনলাম, তিনি আমার আত্মীয়ের সাত বছর বয়সের মেয়েটিকে (তার ছাত্রী) ওড়না পরার নির্দেশ দিয়েছেন। একটু বিস্মিত হলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি ফিজিক্সে ডক্টরেট। কিন্তু অধ্যাপনা বা চাকরি বাকরি না করে নাকি ধর্মপ্রচারে ব্যস্ত একথা কি সত্য? তিনি বললেন, সত্য। বললাম, আপনি সাত বছরের মেয়েকে ওড়না পরতে বলেছেন? বললেন, বলেছি। এটা ইসলামের নির্দেশ। আমার একটু রাগ হয়েছিল। বলেছি, আপনি ইসলাম সম্পর্কে কতটুকু জানেন? তিনি বললেন, আমি আমেরিকায় গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা করেছি। মাওলানা মওদুদীর ইসলাম সম্পর্কিত বইগুলোর ইংরেজী তরজমা আমেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলোতে যথেষ্ট পাওয়া যায়। আমাদের পড়তে উৎসাহ দেয়া হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলাম সম্পর্কে স্টাডি সার্কেল, সেমিনারও হয়। তাই নিজের ধর্মকে জানতে ও বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। সেদিন এই যুবকের কথাকে কোন গুরুত্ব দেইনি। অনেক পরে আফগান যুদ্ধ সম্পর্কে ‘সানডে টাইমসের’ একটি প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি, মধ্যপ্রাচ্যে সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদ ও কম্যুনিজমের প্রসার হঠানোর জন্য সিআইএ’র গবেষণাগারে পলিটিক্যাল ইসলামের জন্ম এবং আমেরিকার বিশেষ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই পরিকল্পিতভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা বিদেশী মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কাজটি শুরু করা হয়। এই ব্যাপারে জামায়াতের বই পুস্তিকা সিআইএকে যথেষ্ট সাহায্য জুগিয়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লব ঠেকানোর জন্যও আমেরিকার দরকার ছিল শিয়া-সুন্নি মুসলমানদের বিরোধ বাধানো এবং সউদি আরবের সহায়তায় সুন্নি ওয়াহাবিবাদকে তোল্লা দিয়ে পলিটিক্যাল ইসলাম খাড়া করা এবং ধর্মের এই বিকৃত আদর্শের দিকে শিক্ষিত মুসলমান তরুণদের আকৃষ্ট করা। জামায়াতে ইসলামিকে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতাদানের পেছনেও রয়েছে এই উদ্দেশ্য। জামায়াতের কোন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা নেই। তাদের শত্রুতা সেক্যুলারিজমের সঙ্গে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু জায়োনিজমের বিরুদ্ধেও তারা নেই। বাংলাদেশে জামায়াতীদের ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধও আমেরিকার চোখে বড় কিছু নয়। জামায়াতকে তারা মডারেট ইসলামী দল আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছিল। আমার ধারণা, আমেরিকার উপদেশ ও সাহায্যেই জামায়াত বাংলাদেশে ভোল পাল্টায় এবং কেবল মসজিদ মাদ্রাসায় তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাডার সংগ্রহের অভিযান চালায়। এ জন্যে প্রায় এক দশক আগেই দেখা গেছে, জামায়াত ও শিবির ক্যাডারদের পোশাক বদলে গেছে। এখন টুপি ও লম্বা কুর্তা আর নেই। তারা জিনসের শার্ট-প্যান্ট পরা আধুনিক যুবক। কারও কারও হাতে হকিস্টিক। উচ্চশিক্ষিত বিধায় তারা অনর্গল ইংরেজী বলতে পারে। তাদের টাকা পয়সার অভাব নেই। জামায়াত বাংলাদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। দু’হাতে তারা টাকা বিলায়। জামায়াতের এই কৌশল পরিবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজে রিক্রুট সংগ্রহ করার কাজটি শুরু হয়েছে বহু আগে। ধীরে এবং সংগোপনে তারা এগিয়েছে। গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার শিবির তার কিছুই টের পায়নি। দীর্ঘকাল পর যখন তাদের কুমিরের নিদ্রা ভেঙেছে তখন তারা দেখছে চারদিকে ধর্মান্ধতা, হিংস্র মৌলবাদের উত্থান। আমাদের শিক্ষিত তরুণ সমাজের একাংশের হাতে রক্তাক্ত চাপাতি। পবিত্র ইসলাম নয়, পলিটিক্যাল ইসলামÑ যার ভিত্তি ওয়াহাবিজম ও মওদুদীবাদ এখন এই তরুণদের আদর্শ। এই ধর্মান্ধতার সর্বনাশা মাদকতা থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কিভাবে রক্ষা করা যায় সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। একটি বিকৃত আদর্শ ও মতবাদকে প্রকৃত আদর্শ ও মতবাদ দ্বারা প্রতিহত করা না গেলে কেবল পুলিশ, র‌্যাব ও সৈন্যবাহিনী দ্বারাও এই সন্ত্রাস উচ্ছেদ করা যাবে না। জামায়াত এখন একটি মাত্র দল নয়। ভারতের বজরং পরিবারের মতো একটি পরিবার। ভারতের শিবসেনা, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু সভার মতো বাংলাদেশের জামায়াত পরিবারে আছে আনসারুল্লাহ, জেএমবি, হিযবুত ইত্যাদি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবতাবাদে বিশ্বাসীদের এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। মতবাদ হিসেবে সেক্যুলারিজমকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাকে তুলে ধরতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তার প্রতিফলন চাই, এমনকি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। পঞ্চাশের দশকের মতো একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলন চাই, ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক আন্দোলন চাই, যা আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেও পথনির্দেশ করবে। আমাদের রাজনীতিকেরা এ পথে না এগিয়ে যদি ক্ষমতার লোভে কেবল আপোসের চর্চা করতে থাকেন, তাহলে দেশ সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। [লন্ডন, ১২ জুলাই মঙ্গলবার, ২০১৬]
×