ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য!

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৩০ জুন ২০১৬

হা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য!

একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হতো না। পৃথিবীর উভয় প্রান্তেই ছিল তার সাম্রাজ্য। কী যে ছিল তার দোর্দ- প্রতাপ আর প্রতিপত্তি। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যৎসামান্য হলেও তার নজির মেলে। উপনিবেশের ডানার নিচে কত দেশ যে ছিল তার করায়ত্তে একালে আর গোনা হয় না। তবে তার শাসিত দেশগুলো নিয়ে রয়েছে কমনওয়েলথ ইউনিয়ন। এখনও বেশ কটি স্বাধীন দেশের রানীও ব্রিটেনের রানী। ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বাঙালীসহ ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় ২শ’ বছর ধরে। এদেশের ধনসম্পদে তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। ‘সোনার বাংলা হলো ছারখার’ বলে গানও গাইত বাঙালী স্বদেশী যুগে। তেমনি তাদের খেদাতে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য ক্রমে অস্তমিত হতে থাকে। হতে হতে মাত্র চারটি রাজ্য নিয়ে গ্রেট ব্রিটেনে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অভিলাসী ‘ক্ষুদ্র’ ব্রিটেন ‘ক্ষুদ্রতর’ ইংল্যান্ডে পর্যবসিত হবে এমন আশঙ্কা অলীক নয় এখন আর। ব্রিটিশরা যেন অবসাদগ্রস্ত হয়ে সব ডানা গুটিয়ে এখন ক্রমেই ভেতরের দিকে মুখ ফিরিয়ে গুটিয়ে বসার উপক্রম করছে। ব্রিটেন আজ গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন। ক্ষতবিক্ষত আর তছনছ হতে চলেছে তার দেশ ও মানুষ। একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রও আক্রান্ত হচ্ছে। ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় অংশ হয়ে আর না থাকার, তাতে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা ক্ষীণ প্রায়। স্কটল্যান্ড তো আলাদা হতেই চাচ্ছে। সেই সঙ্গে ওয়েলসও। বিচ্ছিন্ন জাতি রাষ্ট্র থেকে সম্মিলিত রাষ্ট্রগোষ্ঠী হয়ে ওঠার যে উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে, তার সামনে এই এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন রাখছে। ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম সম্ভবত। ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী দলগুলো উৎফুল্ল। তারা একলা চলাতেই উৎসুক। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে পৃথক হওয়ার মতোই যেন। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবর্তে বিচ্ছিন্ন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পথ চলাই তাদের করছে শ্রেয়। মুক্ত বাণিজ্য তাদের কাছে সন্দেহের বস্তু। অভিবাসন আপত্তিকর। শুল্ক এবং নানাবিধ বিধি-নিষেধের বেড়া তুলে পণ্য, পুঁজি এবং শ্রমের অবাধ গতি নিয়ন্ত্রণই তাদের লক্ষ্য। বিশ্বায়নের রথ চক্রটি বুঝি অবশেষে স্তব্ধ হওয়ার মুখে এবং তার সম্ভাব্য পরিণতিটাই বা কি, সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ব্রিটেন ছিল ইউরোপের প্রবেশদ্বার। সেই দ্বারপ্রান্তে এসে এখন ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ জনগণের জন্য ঘোর অমানিশার সময় সামনে আসছে বলে অনেকের ধারণা। ব্রেক্সিট শিবিরের জয় এসেছে মূলত অভিবাসন বিরোধিতার ওপর ভর করে। আর্থিক মন্দা, সামাজিক সুরক্ষা বাবদ বরাদ্দে কাটছাঁট থেকে চাকরির অভাব, সবকিছুতেই দায় চাপানো হয়েছে অভিবাসীদের ওপর, যদিও ইতিহাস বলে অন্য কথা। দক্ষ অভিবাসীদের সামর্থ্য শুধু ব্রিটেনই নয়, বিশ্ব অর্থনীতির পালেও হাওয়া যুগিয়েছে। ব্রিটেন উন্নত হয়েছে এদের শ্রমের ওপরই। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সমস্যা আছে, তদুপরি স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর অংশ হতে আগ্রহী। কাজেই ব্রিটেন ভাগ হতে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র হয়ে আসছে ব্রিটিশ রাজ। এমন অবস্থায় অভিভাসন বিরোধিতার জিগিরের ফলে সামাজিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হবে। জনজীবনে দেখা দেবে অস্থিরতা ও বিপর্যয়। ইইউবিরোধী ব্রিটিশ রাজনীতিকরা ঘনীভূত সঙ্কটের ভেতরের সত্যটি যদি আড়াল করতে চান, তবে বিপর্যয় অত্যাসন্ন। ব্রিটেনসহ ইউরোপের অধিবাসীরাও উদ্বিগ্ন আগামী দিনে কী আছে তাদের ললাটে, জানে না তারা। ব্রিটিশরা ভুলে যাচ্ছে অসংস্রব নয়, সহায়তাই সভ্যতার ভিত্তি। উপনিবেশ যুগকে স্বপ্নে ফিরিয়ে এনে বাস্তবে মেলানো আর সম্ভব না হলেও ব্রিটিশদের একটা বড় অংশ সেই ঘোরে আটকে আছে। সমন্বয়ের চেয়ে বিচ্ছিন্নতা ভাল নীতি নিয়ে ব্রিটিশরা যেদিকে যাচ্ছে, তাতে একদিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়বে। কাজের সন্ধানে হয়ত আবার ভারতীয় উপমহাদেশে আসবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হবে না, তবে বিশ্ববাসীর অনুকম্পা পাবেই পাবে।
×