ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুত, জ্বালানি ও অবকাঠামোতে বাড়ছে উদ্যোগ

খরা কেটে গেছে, বিদেশী বিনিয়োগের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২১ জুন ২০১৬

খরা কেটে গেছে, বিদেশী বিনিয়োগের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে

এম শাহজাহান ॥ খরা কেটে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। বিদ্যুত-জ্বালানি-পরিবহনসহ ভৌত অবকাঠামো খাত উন্নয়নে চলমান উদ্যোগে বাড়ছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ক্রমশ ত্বরান্বিত হচ্ছে। এছাড়া রাজনৈতিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকায় দেশে পুরোপুরি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছে সরকার। স্থবিরতা দূর হয়ে এখন বিনিয়োগে সুবাতাস বইছে। আর এ কারণে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হচ্ছেন দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা। বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ১৮২ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। বিভিন্ন দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের হালনাগাদ তথ্য নিয়ে আগামীকাল বুধবার ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৬’ প্রকাশ করবে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা আঙ্কটাড। সংস্থাটির বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে করা বাংলাদেশের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবে বিনিয়োগ বোর্ড। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, বাংলাদেশের অনুকূল বিনিয়োগ পরিবেশ কাজে লাগাতে বিদেশী উদ্যোক্তারা ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্রমপুঞ্জীভূত মূলধন বাড়ানো। গত দশ বছরে মোট বিনিয়োগ বেড়ে জিডিপির ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে সরকারী বিনিয়োগ জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হলেও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২১ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে সীমিত রয়েছে। এ বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা দূর করে মধ্যমেয়াদে (২০১৬-১৮) তা জিডিপির ২৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে। একই সময়ে সরকারী বিনিয়োগও জিডিপির ৭ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেন ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট-বিওপি) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ১৮২ কোটি ডলার নিট বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বাংলাদেশে এসেছে, যা ২০১৪-১৫ অর্থবছরের একই সময়ের পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি ৫ লাখ ডলার। গত বছর সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, জাপান ও ভারত থেকে। এসব দেশ থেকে আবার সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, টেক্সটাইল এ্যান্ড ওয়্যারিং, ব্যাংকিং, টেলিকমিউনিকেশন, বিদ্যুত, খাদ্য, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছেÑ রূপকল্পের স্বপ্ন হচ্ছে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে মোটা দাগে সরকারের কৌশল হচ্ছে উপযুক্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়ন, গণদ্রব্য ও সেবার যোগান বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে একীভূত হওয়া, উৎপাদন বিশেষায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা। আর এগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করা। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, দেশে বিনিয়োগে একটা ধাক্কা এসেছে। এটা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে যেমন এসেছে, তেমনি বিদেশী বিনিয়োগেও এসেছে। তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ, আমদানি-রফতানি, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি, ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি এবং সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ অনেকখানি বেড়েছে। এটি ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও ইঙ্গিত বহন করে। আশার বিষয় হচ্ছেÑ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কতিপয় সূচকে ইতিবাচক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা কেটে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। জানা গেছে, জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড) প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সারাবিশ্বে একযোগে ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আগামীকাল বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ জীবন বীমা টাওয়ারের নিজ কার্যালয়ে এ তথ্য প্রকাশ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহীর ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। বিনিয়োগ সংক্রান্ত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে একটি অংশ থাকে। বিনিয়োগ বোর্ড ওই অংশসহ পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের তথ্যানুযায়ী সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ দেশে বেড়েছে। আশা করছি, আঙ্কটাডের রিপোর্টেও ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে। জানা গেছে, দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আসে তিন ভাগে। এগুলো হলোÑ ইক্যুইটি ক্যাপিটাল, রিইনভেস্টেড আর্নিং এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন। এ তিন ভাগে আসা মোট অর্থপ্রবাহকে গ্রস ফ্লো হিসেবে ধরা হয়। আর বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে অর্থ বাংলাদেশে নিয়ে আসছে, তা থেকে খরচ পুনরুদ্ধার (কস্ট রিকভারি) ও মুনাফা ভাগের (প্রফিট শেয়ার) অংশ হিসেবে দেশের বাইরে নিয়ে যায়, যাকে বলা হয় ডিজইনভেস্টমেন্ট। গ্রস ফ্লো থেকে ডিজইনভেস্টমেন্ট প্রবাহ বাদ দিয়ে নিট প্রবাহ হিসাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০১৪ সালে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের গ্রস ফ্লো ছিল ২০৫ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আর ডিজইনভেস্টমেন্ট বাদ দিয়ে নিট প্রবাহের পরিমাণ ছিল ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। ২০১৫ সালে নিট প্রবাহের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২০ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের নিট প্রবাহ বেড়েছে ৪৪ শতাংশের বেশি। আঙ্কটাডের সহায়তা চায় বাংলাদেশ ॥ দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (এলডিসি) টেকসই বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে সহায়তা বাড়াতে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু জেনেভা সফর করে আঙ্কটাডের মহাসচিব মুখিসা কিটুইয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এ সহায়তা চান। ওই সময় শিল্পমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও রফতানি বৈচিত্র্যকরণে আঙ্কটাড কারিগরি ও গবেষণা সহায়তা বাড়াতে পারে। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার প্রায় ১৮টি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। আঙ্কটাডের মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগ নীতি প্রণয়নে আঙ্কটাড সহায়তা করে আসছে। এ নীতি বাস্তবায়িত হলে বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে।
×