ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২১ জুন ২০১৬

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ বিশেষ করে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের, তাহলো ভারতকে হিন্দুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় মনে করা। বিয়ে সম্পত্তি সব কিছুর জন্য তারা ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকে এখানে থাকেন, ছেলেমেয়ে বহুদিন থেকে ভারতে থাকে, সহায় সম্পত্তিও করেছেন। যদি নাম বলতে বলেন, সেগুলো বলা যেতে পারে। দু’নৌকাই পা রাখেন। এ কথাগুলো এতদিন ওঠেনি, এখন উঠবে যেটি আমরা চাইনি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অন্যদেশে সহায় সম্পত্তি করা কি অন্যায়? চলে যাওয়া? না এখন সবাই বিশ্ব নাগরিক। মুসলমানরা কি দেশত্যাগ করছেন না? অবশ্যই করছেন, সহায় সম্পত্তিও করছেন। গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের একটি বিরাট অংশের স্ত্রী পুত্র কানাডায় থাকে, নিজে এখানে শোষণ চুরি-চামারি, সরকারী আনুকূল্যে যা পান ভোগ করে বাকীটা বাইরে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু, পার্থক্যটা হলো, ধর্ম নিয়ে এসব সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিচলিত নন। তারা সৌদি আরব, ইয়েমেন, পাকিস্তান যান না। তারা যান ইউরোপ আমেরিকা। আমাদের দেশের হিন্দুরা ১৯৪৭ সালের পর থেকে ভারতমুখী হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন এবং শুধু ধর্মীয় কারণে। সংখ্যা গরিষ্ঠের যারা যান, তারা ফিরে আসেন। মাঝে মাঝে আসেন এবং এ নিয়ে লুকোচুরি নেই। এখানকার হিন্দুরা গেলে আর আসেন না। ধর্মটাই বেশি প্রাধান্য পায়। অন্যদিকে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে [পাঞ্জাবের কথা বাদ দিলে] ভারত থেকে মুসলমান খুব একটা আসেনি। এখন তো আসেনই না। তারা কি বাংলাদেশের হিন্দুদের থেকে সেখানে ভাল আছেন? মোটেই না। অনেক ক্ষেত্রে খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। তবুও ‘মুসলমানদের দেশ’ বাংলাদেশে আসেন না কেননা, তারা ভারতকেই দেশ মনে করেন। তারা বাংলাদেশে সহায় সম্পত্তিও করেন না, ছেলেমেয়েও পাঠিয়ে দেন না। পার্থক্যটা কেন হচ্ছে, সেটি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের বুঝতে হবে। আমার এ বক্তব্যে তারা অসন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু, এটি যে বড় সত্য সেটি অস্বীকার করতে পারবেন না। তাদের মানস জগতে এটি প্রভাব বিস্তার করে আছে যে, ভারত হিন্দু রাষ্ট্র, ভারতই হিন্দুদের সহায়তা করবে। করবে কি? করেছে কি আগে? বিজেপির প্রথম আমলে এখানকার ভারতীয় দূতাবাসের রিপোর্টগুলো দেখুন। এখন দেখা যাবে না। ৫০ বছর পর দেখা যাবে। খালেদা-নিজামী বিএনপি-জামায়াত আমল। বিজেপির সঙ্গে তাদের বেশ দোস্তি। হিন্দুদের অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। শাহরিয়ার অত্যন্ত আবেগের বশবর্তী হয়ে তখন পশ্চিমবঙ্গ গিয়েছিলেন সেগুলো রেকর্ড করতে। তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন ভারত সরকারের পক্ষ থেকেই এখানকার সরকারকে জানানো হয় শাহরিয়ার ‘দেশবিরোধী’ কাজ করছেন। ঢাকায় ফেরত এলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন দূতাবাস থেকে জানানো হয়, এখানে হিন্দুদের অবস্থা ভাল। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই এ তথ্য পাওয়া। শুধু তাই নয়, পিনাক চক্রবর্তী তখন শাহরিয়ারকে বলেছিলেন, তিনি ভিসার শর্ত ভেঙ্গেছেন। তাকে ভিসা দেয়া হবে না। শাহরিয়ার তারপর থেকে আর ভারতীয় ভিসা নেননি। এ ঘটনার বর্ণনা করছি এ কারণে যে, ভারত নিজ স্বার্থে চলবে। হিন্দু কার্ড খেলা যদি তার কাছে স্বার্থোদ্ধারে উত্তম মনে হয় তাহলে সেটি খেলবে। যদি উত্তম মনে না হয় খেলবে না। ইসরাইল যেমনটি করে। সুতরাং ‘হিন্দু’ হলেই ‘হিন্দু ভারত’ এগিয়ে আসবে তা নয়। এ থিসিস সত্য হলে, পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হতো। সেটি তো হয়নি। কেন হয়নি, এ রাজনীতি যদি আমরা না বুঝি তাহলে আর তা বোঝানো যাবে না। যারা দেশত্যাগ করছেন তারা শুধু নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন দেখে যাচ্ছেন না, আত্মীয়তা থেকে শুরু করে নানা কারণে যাচ্ছেন। যাদের আত্মীয়দের বড় অংশ ভারতে তারা একসময় তো দেশত্যাগ করবেনই। স্বদেশ লিখেছেন, যেটি বাস্তব সত্য কিন্তু যা আমরা বলি না চক্ষুলজ্জায় তাহলোÑ “তাছাড়া একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, নেতৃত্বে যারা আছেন এরা হয়ত কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনতে পারবেন কিন্তু দেশের দেড় কোটি হিন্দুর এক কোটি ২৫ লাখের সে সমর্থ নেই। তাদের ভারতে গেলে থাকতে হবে রেল লাইনের ধারের বস্তিতে না হয় পাড়ি দিতে হবে আন্দামানে। এই ভুল আর নয়। ৪৭ থেকে নেতাদের এই পলাতক মনোভাবের কারণে অনেক ভুল হয়ে গেছে। এখন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। বিশ্ব একক হতে চলেছে। এ সময়ে বিশ্ব নাগরিক হোন কিন্তু রিফিউজি হওয়ার জন্য কোন রাজনীতি করা ঠিক নয়। তাছাড়া এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে শেষ অবধি অনেক ক্ষতি হয় কমিউনিটির।” [ঐ] কারা বাংলাদেশ ত্যাগ করছেন? হিন্দু সম্প্রদায়ের, সব পর্যায় থেকেই। আমাদের চোখে নিম্নবর্গের সংখ্যাটি বেশি চোখে পড়ে। তবে, সব ক্ষেত্রে সেটি আবার সত্য নয়। আমাদের নির্বাচনী এলাকা কচুয়ায় ২০০১ সালে নির্বাচনের সময়, আওয়ামী লীগারদের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি ও সেনাগ্রুপ [যারা ঐ এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল] হিন্দুদেরও টার্গেট করে। হিন্দুদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে তবে তেমনভাবে হেনস্থা করা হয়নি। যেটি হয়েছিল আওয়ামী লীগারদের ওপর। কিন্তু কোন হিন্দু দেশ ছেড়ে যাননি। অপেক্ষা করেছেন কবে মিলন রাজত্ব শেষ হবে তার আশায়। এখন তারা দিব্যি আছেন। কারণ, তারা বলছেন, এটি তাদের দেশ তারা যাবেন কেন? আসলে স্পিরিটটা তেমন হওয়া উচিত। এটি না হলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। হিন্দু নেতৃবর্গ যে চিত্রটি তুলে ধরতে চেয়েছেন তা সমগ্র হিন্দু সমাজের চিত্র নয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় মধ্যবিত্ত হিন্দুরা প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের হিন্দু মসুলমান বঙ্গভঙ্গ চেয়েছেন। তারা পূর্ববঙ্গের উন্নতি চেয়েছেন। এ সূত্রটিই ছিল আমাদের জীবনচর্যার প্রধান সূত্র। উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় দেখি, সবসময় হিন্দু-মসুলমান এ ভূখ-টির ওপরই জোর দিয়েছেন। এ মনোভাব নানা টানাপোড়েনেও ছিন্ন হয়নি। এখানে একটি উদাহরণ দিতে পারি। একবার বিশ্বকাপ খেলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মুখোমুখি ভারত। সাধারণ একটি ধারণা, কলকাতায় ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে মসুলমানদের একটি অংশ পাকিস্তানের জয় কামনা করে। সেই সূত্রে অনেকের ধারণা, বাংলাদেশে-ভারত খেলা হলে হিন্দুরা ভারতকে সমর্থন করবে। ঐদিন এক ভারতীয় ক্রীড়া গবেষক ছিলেন ঢাকায়। আমি তাকে বললাম, এই যে হাইপোথেসিস এটি এখানে টিকবে না, আপনি যান শাঁখারি বাজার। ফিরে এসে বলুন কী দেখলেন। সেদিন বাংলাদেশ জিতে গিয়েছিল। সেই গবেষক ফিরে এসে জানালেন, শুরু থেকে শাঁখারি বাজারের প্রতিটি মানুষ বাংলাদেশকে সমর্থন করেছেন। এবং বাংলাদেশ জেতার পর ঢাক ঢোল বাজিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। সুতরাং এক রৈখিক কোন চিন্তাই সঠিক নয়। হিন্দু নেতারা এখন যা বলছেন, বা সংখ্যাগরিষ্ঠের অনেকে হিন্দু সম্প্রদায় সম্পর্কে যে ধারণা সেটিও সম্পূর্ণ ঠিক নয়। তবে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, যা আগে উল্লেখ করেছি। সব দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘুকে যেমন হুমকিতে রাখে তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠের অনেকে সেই হুমকি প্রতিরোধে এগিয়েও আসে। সেটি ভুলে গেলে অন্যায় হবে। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকদিন আগে এক আফগানের গুলিতে ৪৯ জন নিহত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্প মসুলমানদের হুমকি দিয়েছেন। পরক্ষণেই, প্রেসিডেন্ট ওবামা বক্তৃতায় ট্রাম্পের সেই হুমকিকে নস্যাত করেছেন। সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন। ॥ চার ॥ এবার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটটি খানিকটা উল্লেখ করি। অনেকের তা ভাল লাগবে না জানি, কিন্তু এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মানসিক সমস্যা জানতে হলে ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হবে। বঙ্গভঙ্গে উল্লেখ করেছিলাম এ অঞ্চলের বাঙালী বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা জোরালোভাবে করেনি। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মসুলমান ছিলেন চাষী আর হিন্দু চাষীদের ৯০% ছিলেন নিম্নবর্গের। এরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতা কেন করবেন? বরং এরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে কাজ করেছেন। বাখরগঞ্জে নমঃশূদ্রদের এক সভায় ঘোষণা করা হয়েছিল, ব্রাহ্মণদের ঘৃণা ও অপছন্দ এবং কায়স্থ ও বৈদ্যদের কারণে বিরাট এই নমঃশূদ্র সম্প্রদায় পশ্চাৎপদ। অথচ মুসলমান ও তাঁরাই পূর্ববঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং এই সম্প্রদায়ের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাদের সঙ্গে কাজ করার বরং তাঁরা হাত মিলিয়ে কাজ করবেন তাঁদের মসুলমান ভাইদের সঙ্গে। ব্রাহ্ম গিরিশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, বঙ্গভঙ্গ তিনি সমর্থন করেন। কারণ এর ফলে পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের উন্নতি হবে এবং এ কথা ভেবে তার ‘আহ্লাদ হইয়াছে।’ ১৯০৮ সালে মাদ্রাজ কংগ্রেসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস হলে নওয়াব আলী চৌধুরী এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “পুরনো প্রশাসনে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা অববাহিকা ছিল অবহেলিত। বর্তমানে নতুন প্রশাসন চালু হওয়ার পূর্ববঙ্গ ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। কলকাতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ায় যেন সুন্দর জীবন ফিরে এসেছে।... যদি পূর্ববঙ্গে ১০০ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সমসংখ্যক সাব-ডেপুটি মুনসেফ এবং সাবরেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন, তাহলে তাঁরা হবেন এ দেশের মাটির হিন্দু-মসুলমান ছেলেয়েমেরা।” তিনি এক্ষেত্রে ইংল্যান্ড আয়ারল্যান্ড যে সমস্যা, পূর্ববঙ্গ কলকাতার সমস্যাটিকেও সেভাবে দেখেছেন। ১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত মুসলিম লীগের উত্থান ও বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুসলিম লীগের উদ্ভব ঢাকায় কিন্তু অচিরেই এর কর্তৃত্ব চলে যায় উত্তর ভারতে। ভারতীয় এলিটরা এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং ১৯৪৭-এর আগে ভারতের মুসলমান নেতৃবৃন্দ সামাজিক সংগঠিত সমাবেশ ঘটানোর জন্য ইতিহাসের সূত্রগুলো তুলে ধরতে চেয়েছেন। তারা জোর দিয়েছেন মুসলমান নৃপতিদের ওপর যারা ছিলেন শৌর্যেবীর্যে তাদের ভাষায় অতুলনীয় এবং মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন ভারতীয় মুসলমানরা তাদের বংশধর। ইসলামী শাসনের যুগ স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ ও হিন্দুদের (কংগ্রেস) চক্রান্তে আজ তারা হীনাবস্থায়। এই হীনাবস্থা থাকবে না যদি মসুলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়। ইতিহাসের এই ব্যবস্থা মুসলমান তরুণদের সংগঠনে ভূমিকা রেখেছে এবং ‘পাকিস্তান মানসিকতা’ তৈরি করেছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, পাকিস্তান : মুসলমান+ইসলাম। ভারত : হিন্দু। এই মানসিকতা গঠন খুবই তীব্র এবং শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা দুরূহ। এটা ঠিক পূর্বাঞ্চলের মানুষদের বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এই প্রচার কিছুটা আচ্ছন্ন করেছিল এবং এটি মুসলমান মানস বা মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতার উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়। তবে ১৯৭১-এর পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা কৃষিজীবী তাদের এই মিথ প্রভাবিত করেনি। যতটা করেছে অর্থনৈতিক বঞ্চনা। পাকিস্তান তাদের মনে হয়েছিল বঞ্চনা থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু ভারত বিভাগের দায় বর্তেছে মুসলিম লীগ ও পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের ওপর। ভারত ভাগের পর ঐতিহাসিকরা এই তত্ত্বই প্রচার করেছিলেন বা যে তত্ত্ব প্রাধান্য বিস্তার করেছিল বা আছে তা হলো ভারত বিভাজনের জন্য মুসলমান বা মুসলিম লীগই দায়ী। এর সমালোচনা যে খানিকটা হয়নি। তা নয়। তবে দল হিসেবে কংগ্রেস ও কংগ্রেসের আদর্শে বিশ্বাসীরা এই তত্ত্ব বেশি প্রচার করেছেন। যাতে ভারত বিভাগের দায়িত্ব তাদের ওপর না পড়ে। বাংলা বিভাগের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে জয়া চ্যাটার্জী দেখিয়েছিলেন যে, এর সবটাই সত্য নয়। তিনি লিখেছেন, ১৯৮০ সালে যখন তিনি গবেষণা শুরু করেন, “তখন একটা সাধারণ ও অনুকূল ধারণা প্রচলিত ছিল যে, ভারত বাংলার বিভক্তি মুসলমানদের কাজ। হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অখ-তাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কোন কিছুই করেনি। ওই সময়ে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণায় প্রকাশ পায় যে, স্বাভাবিক ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য হলো সহনশীল এবং বহুত্ববাদী, তাই হিন্দুত্বে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ নেই।... ওই গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকদের (বষরঃবং) ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তারা সামাজিক অবস্থান অক্ষুণœ রাখার লক্ষ্যে কূটকৌশল অবলম্বন করে নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসেবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে ব্যবহার করে। সত্যিকার অর্থে ওই কূটকৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িক হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।” গত শতকের শেষ দশক থেকে ভারতে আবার হিন্দুত্ববাদের বা রাজনীতির প্রবল প্রতাপ, তাতে জয়া জানাচ্ছেন, তাঁর যুক্তিগুলোই ‘কত বিতর্কিত ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।’ পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে যারা উদ্বাস্তু হয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ ছিলেন মধ্য বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। কিন্তু কৃষক বা নমঃশূদ্ররা সেভাবে দেশত্যাগ করেছেন কিনা সন্দেহ। অর্থনৈতিক বঞ্চনাই ছিল প্রধান। তাই ১৯৪৭-এর পর দেখি, মুসলিম তরুণরা মুসলিম লীগ আরোপিত ইতিহাস ঝেড়ে ফেলছে এবং সেই অর্থনৈতিক বঞ্চনাই মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বিভক্তির সেটিই মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরাজিত হয় দ্বিজাতিতত্ত্ব এই পূর্ববঙ্গেই, অতীতের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। যারা বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা ছিলেন মুসলিম লীগের তরুণ তুর্কি। তা হলে এটি সম্ভব হলো কীভাবে? এ বিষয়ে হারুন-অর-রশিদ তাঁর বাংলা বিভাগ ও অভিন্ন বাংলা প্রস্তাব সম্পর্কে বিস্তৃত গবেষণার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, বাঙালী মুসলিম লীগের কাছে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ, কৃষ্টি, ঐতিহ্যে বিভক্ত মসুলমানদের তাদের সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস বা হিন্দুদেও বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার এশটি ‘স্ট্র্যাটেজি’ মাত্র। তারা বিশ্বাস করতেন, ভারতে দ্বিজাতি নয়, বহুজাতি সত্তা রয়েছে।... বাংলার এই নেতৃত্বের নিকট ‘পাকিস্তান’ ছিল লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত একটি আন্দোলনের নাম, একটি একক রাষ্ট্রের রূপরেখা নয়।’ প্রাক ১৯৪৭ সালে এ ভূখ-ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠা তার কাছে মনে হয়েছে দুরূহ ছিল এবং ‘বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র গঠনের এ পর্বে এটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু-আধিপত্যের ভীতি বাঙালী মসুলমানের মন থেকে কেটে গেলে বাঙালী-অবাঙালী দ্বন্দ্বটি প্রাধ্যন্য লাভ করতে থাকে। পূর্ববাংলার হিন্দুরা এবার পূর্ববাংলার মুসলমানদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয় তাদের সাধারণ রাজনৈতিক শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন, শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে।’ উপযুক্ত বিবরণের উদ্দেশ্য একটি। তা হলো প্রথাসিদ্ধভাবে আমরা এ ভূখ-ের জনসমষ্টিকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করে (হিন্দু ও মসুলমান) দেখবার চেষ্টা করি যে, দুই সম্প্রদায়ের মানসভুবন আলাদা এবং ধর্ম সেখানে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে সম্প্রদায়গত বিভাজনে ও এই মানস গঠন সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এর চেয়ে সমন্বয়ধর্মীর যে ব্যাপারটি ছিল অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সেটিই ছিল ভাল। আসলে চিন্তাটা করা হয়েছে এই বোধ থেকে যে, প্যাগানিজমই উত্তম। তা লৌকিক পরিবর্তিত হয়েছে এবং এতে ধর্মবোধের সমস্যা কম এবং হিন্দুধর্মকে তার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে তার পারিপ্রেক্ষিতেই বিচার করা হয়েছে যা ফ্যালাসি মাত্র। কিন্তু আলোচনায় দেখা যায় দুটি ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় হলেও এরা প্রাক ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে পাশাপাশিই অবস্থান করেছে। ধর্মবোধ তাদের দুটি বিপরীতমুখী অবস্থান সৃষ্টি করেনি অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে। বহিরাগত সংস্কারকরা, বিশেষ করে মুসলমান ওয়াহাবি সংস্কারকরা ওপর থেকে ইসলামের তত্ত্ব চাপিয়ে দিয়ে সাময়িক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করলে অন্তিমে তা প্রভাব ফেলতে পারেনি। হিন্দু সংস্কারকরা মূলত নিজেদের সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধেই আন্দোলন করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রে বাঙালী পরিচয়টাই প্রাধ্যন্য পেয়েছে বা এই পরিচয়ের ধারাবাহিকতা বিভিন্ন সময় এলিট বা রাষ্ট্র নষ্ট করতে চাইলেও পারেনি। এই বোধের কারণেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বদলে বাঙালীত্বের বিভিন্ন উপাদান রক্ষার ব্যাপারে যৌথ লড়াই হয়েছে। এই উপাদানগুলোকে বরং সমন্বয়ধর্মীয় উপাদান বলা যেতে পারে। আবার এই বোধকে অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পারেন। তবে ধর্মসহিষ্ণুতা বলাই বোধহয় শ্রেয়। বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র গঠনে তা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। (চলবে)
×