ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২১ জুন ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

নগরীর উত্তর প্রান্ত থেকে ঢাকা ত্যাগের সময় মডেল টাউন খ্যাত উত্তরার শেষ পয়েন্ট হলো হাউস বিল্ডিং বাস স্টপেজ। তার বামের সড়ক দিয়ে গেলে মেলে মূলত বেজোড় সংখ্যক সেক্টরগুলো। বহুতল দুটি শপিংমলÑ ম্যাসকাট প্লাজা ও নর্থ টাওয়ার সবসময় জমজমাট। ফিবছর ঈদের বাজার শুরু হলে এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অস্থায়ী টহল ঘর বানায়। তাতে বাজারের নিরাপত্তা বাড়ে। এখানেই লেগুনার হাঁকডাক শোনা যায়Ñ ‘খাল পাড় খাল পাড়’। এক যুগ আগে উত্তরায় বসতি গড়ার সময় ওই খাল থেকে তুলে আনা জ্যান্ত মাছ নিয়ে প্রধান সড়কে বসতেন কয়েকজন। সেসব দিনের সঙ্গে সেসব ছোট মাছ প্রাপ্তির সুযোগটাও হারিয়ে গেছে। কালে কালে খালপাড়ের ভেতরের জায়গাটি দিয়াবাড়ি নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। বেশ প্রশস্ত এলাকা, অনেকটা জনবিরল। শরৎকালে কিলোমিটারজুড়ে বিছিয়ে থাকা কাশফুল সৌন্দর্যের আকর্ষণ হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ সেখানে অবকাশ যাপনের জন্য যান। এখানেই একটি খাল থেকে শনি ও রবিবার উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত (সম্পূর্ণ নতুন) অস্ত্র। শনিবারে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রশস্ত্রের ভেতর রয়েছে ৯৫টি ৭.৬২ বোরের পিস্তল, দুটি নাইন এমএম পিস্তল, ১০ হাজার ৬০টি গুলি (এর মধ্যে ৭.৬২ বোরের গুলি ২২০টি ও নাইন এমএম পিস্তলের গুলি ৮৪০টি), ৪৬২টি ম্যাগাজিন (৭.৬২ বোরের ১৮৯টি, এসএমজির ২৬৩টি ও গ্লোক পিস্তলের ১০টি), ১০টি বেয়নেট ও গুলি বানানোর ছাঁচ ১০৪টি। সাতটি ট্রাভেল ব্যাগের মধ্যে এগুলো ছিল। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এ রাজধানী! রাজশাহীকে ঈর্ষা করছে রাজধানী! কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে লিখেছি এ কলামে। ধুলোর দৌরাত্ম্যও লিখতে বাধ্য করে। এ সপ্তাহে লিখতে গিয়ে কাগজে বায়ু দূষণ কমানোর খবরটিতে চোখ পড়ল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে দেখা যাচ্ছে বায়ুদূষণ কমানোতে বিশ্বসেরা এখন রাজশাহী! রাজশাহী সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের ‘জিরো সয়েল প্রকল্পই’ রাজশাহী শহরকে দূষণমুক্ত করতে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। ইটভাটার চিমনির উচ্চতা বাড়িয়ে দেয়া, বনায়ন, রাস্তার পাশের ফুটপাথ কংক্রিট দিয়ে ঘিরে দেওয়া, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বহুল ব্যবহার, ডিজেলচালিত যানবাহন চলাচলে কড়াকড়ি- এসবই রাজশাহীর বায়ুদূষণ কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে নগর বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভাবছিলাম রাজধানীতে কতই না নগর বিশেষজ্ঞের বাস, আছেন জোড়া মেয়র। অথচ রাজশাহীর তুলনায় সে বায়ুদূষণ রোধে পিছিয়ে কেন? রমজানে শপিংমল ঈদ মৌসুমে রাজধানীর শপিংমলগুলো রীতিমতো মৌচাক হয়ে ওঠে। মৌচাক ঘিরে যেমন থাকে মধুসন্ধানী ও মধুসঞ্চয়ী মৌমাছি, তেমনি শপিংমল ও শপিং সেন্টারগুলো ঘিরে থাকে ঈদের পোশাক সন্ধানী ও সংগ্রহকারীদের ভিড়। যদি বলি ঈদ মৌসুমে গোটা রাজধানীই হয়ে ওঠে এক জাতীয় মৌচাকÑ তাতে ভিড় করে আসে মধুসন্ধানী মানুষ, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে না। ঈদ যত কাছে চলে আসে ততই ভিড় বাড়তে থাকে ঢাকায়। এমনিতেই ঢাকা হলো লোকে ঠাসা, রাস্তাগুলো অতিরিক্ত গাড়িতে ঠাসা। তার ওপর বিশেষ কোন উপলক্ষে ঢাকায় নতুন আগমনকারী মানুষের ভিড়ে ঢাকা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। নিউমার্কেটের মতো ঈদ-শপিংয়ের জমজমাট এলাকায় রাস্তার ওপর কখনো কখনো মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। রমজান মাসের প্রথমার্ধ শেষ হওয়া মানেই রাজধানীতে ঈদ উদযাপনের জন্য আগাম আয়োজনের নানা তোড়জোড় শুরু হয়ে যাওয়া। আয়োজন কি আর একটা? পয়লা নম্বরেই আছে নতুন জামাকাপড় আর জুতো কেনা। শুধু জামা-জুতোই কি? গহনা-অলংকারও এর ভেতর পড়ে। অনেকে বলতে পারেন প্রথম রোজা থেকেই ঢাকায় বসে যায় ঈদের বাজার। নামী-দামী শপিং মলগুলো আরও ঝলমলে হয়ে ওঠে। সাজ সাজ রব পড়ে যায়। এক মার্কেটের সঙ্গে অন্য মার্কেটের একটা অলিখিত প্রতিযোগিতাও চলে। কোন মার্কেট কত বেশি পরিমাণে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা। ব্যবসায়ীরা ভালো করেই বেচাবিক্রির হিসাব জানেন বছরের এগারো মাস এক দিকে আর এই একটি মাস আরেক দিকে। রমজান তাদের জন্য বাড়তি রহমতের মাস। তাই এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা আর উত্তেজনা থাকে অনেক। তবে এটাও সত্যি যে এখন এক এলাকার মানুষ আরেক এলাকার মার্কেটে গিয়ে সাধারণত ঈদের শপিং করেন না। নিজেদের এলাকার মধ্যেই কেনাকাটার কাজটা সারেন। রমজানে ঢাকার যানজট পরিস্থিতি সহনশীলতার সকল সীমা ছাড়িয়ে যায় বলেই বাধ্য হয়ে নিজের এলাকা কিংবা নিকট দূরত্বের ঈদ মার্কেটের বিষয়টি তারা বিবেচনায় রাখেন। এটা অবশ্য সাধারণ হিসাব। ব্যতিক্রম তো আছেই। ধরা যাক উত্তরায় একাধিক বিশাল শপিং কমপ্লেক্স থাকতেও যারা যাতায়াতের হিসাবে দু-তিন ঘণ্টা দূরত্বের নিউমার্কেট কিংবা পান্থপথের সুবিখ্যাত বিপণি কেন্দ্র বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে আসেন, তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। আস্তে আস্তে নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক মার্কেটে আসতে শুরু করে। ক্রেতারাও দেখে শুনে কিনতে শুরু করতে রমজানের প্রথম কি দ্বিতীয় সপ্তাহ গড়িয়ে যায়। সে বিবেচনায় এখন রাজধানীর ঈদের বাজারের চূড়ান্ত ও মোক্ষম সময় যাচ্ছে। বড় বড় প্রতিটি মার্কেটেই ভিড় হচ্ছে প্রতিদিনই। বিশেষ করে ইফতারির পর মধ্যরাত পর্যন্ত এসব মার্কেটে ভিড় যেন উপচে পড়ে। ঈদে দেশী পোশাকের কদর ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দী সিরিয়ালের নায়িকাদের পরিহিত পোশাক থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে ঈদের পোশাক বানিয়ে বাজার মাত করতে দেখছি আমরা অধুনা কয় বছর। এটা অস্বীকার করব না, সমাজবাস্তবতাই এমন যে, কী গ্রাম কী শহরÑ সর্বত্র গৃহিণী দর্শকদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী সিরিয়াল। এসব সিরিয়ালে পারিবারিক জটিলতা, অন্ধ ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মীয় কুসংস্কার এবং পরকীয়াই প্রধান উপজীব্য। গৃহিণীরা এসব গোগ্রাসে গেলেন। ব্যবসায়ীরা বোঝেন এই মনঃস্তত্ত্ব। তাই সেভাবেই পোশাকের বাজার তৈরি করেন, বাজারে সাপ্লাই দেন। নায়িকার পোশাকের অনুকরণে তৈরি এমন দু’তিনটে থ্রিপিস অতীতে হিট হয়েছে ঈদের বাজারে। (এবার সারারা নামের পোশাকটি আবার বাজারে কিছুটা চাহিদা তৈরি করেছে। সারারা পরিহিতা সুপারস্টার শিল্পা শেঠির ক্যাটালগ প্রদর্শন করা হচ্ছে ক্রেতাদের।) তাই বলে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির নক্সাসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গে তৈরি পোশাকের চাহিদা মুখ থুবড়ে পড়েনি। শিক্ষিত রুচিবান সংস্কৃতিবান ক্রেতারা দেশীয় পোশাক নির্মাতাদের পোশাক ঠিকই বেছে নিচ্ছেন ঈদের পোশাক হিসেবে। দেখতে দেখতে বর্তমানে শতাধিক দেশীয় পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাজারে ঈদের পোশাকের যোগান দিতে হিমশিম খান। অন্তত এক কুড়ি প্রতিষ্ঠান রীতিমতো ব্র্যান্ড হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এরা নিজেদের শিল্পী তথা নক্সাকার এবং কারিগরদের মাধ্যমে পোশাক তৈরি ও যোগান দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। তাই ভরসা করেন ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিপর্যায়ের শিল্পী ও কারিগরদের ওপর। ফলে ঈদ পোশাক শিল্পে নিয়োজিত হন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডিজাইনার-দর্জি-কর্মীবৃন্দ। এরা তো আছেনই। কিন্তু দোকান নেই, নামধামের প্রতিযোগিতায় যাননি এমন বহু নারী ও পুরুষ আছেন যারা তাদের অন্তর্গত শিল্পীসত্তার প্রেরণা ও তাগিদ থেকে ঈদ মৌসুমে পোশাক ডিজাইন করে থাকেন। নামমাত্র মুনাফায় এসব তারা বন্ধুমহলে বিক্রি করেন। কেউ যেচে তাদের তৈরি পোশাক শোরুমে রাখতে চাইলে সম্মত হন বটে। যদিও এরা শাড়ি বা থ্রিপিস তৈরি করেন যেমন মনের মাধুরি মিশিয়ে একেবারে নিজস্ব ঢঙে দেশীয় সংস্কৃতির ছোঁয়ায়Ñ তেমনি এরা চান ক্রেতারা মুগ্ধ হয়ে মন থেকেই এসব পোশাক কিনুক। এ রকম একাধিক ডিজাইনারের কাজ দেখে মনে হয়েছে আমাদের আশপাশেই কতই না এমন সৃজনশীল মানুষ রয়েছেন যারা একটি প্রধান উৎসবকে রাঙিয়ে তুলতে এবং দেশের ঐতিহ্যের পতাকা উর্ধে তুলে ধরতে নিভৃত চর্চা করে চলেছেন। এমন নিভৃতচারী ডিজাইনারের পোশাক প্রদর্শনীর জন্য যদি কোন সংস্থা এগিয়ে আসত তবে অতিবিজ্ঞাপিত এবং প্রতিযোগিতায় বিজয়ী অভিনব পোশাকের ধারার সমান্তরালে বাঙালীর সৃষ্টিশীলতার আরও নমুনাও আমাদের চোখের সামনে প্রতিভাত হতে পারত। সেসব পোশাকও স্বতন্ত্র ঔজ্জ্বল্যে বিকশিত হওয়ার পথ পেত। বিরল ঢাকাবাসী! বিরল রক্তের গ্রুপের কল্যাণে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত কামরুজ্জামানকে বিরল ঢাকাবাসী বলা যেতেই পারে। তার জন্য বিরল গ্রুপের রক্ত এলো গত সপ্তাহে মুম্বাই থেকে। সম্ভবত এই প্রথম দেশে ‘ওএইচ পজিটিভ’ বা বোম্বে গ্রুপের রক্ত বহন করেন এমন ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গেল। বিরল এই রক্তের গ্রুপ প্রথম ধরা পড়ে ভারতের মুম্বাইতে, ১৯৫২ সালে। তখন থেকেই এই নামকরণ। এই ঘটনা থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ বোধ করবেন বহুজন। নিজের ব্লাড গ্রুপ এখনও পরীক্ষা করাননি এমন ব্যক্তিদের অনেকেই রক্ত পরীক্ষায় উদ্বুদ্ধ হবেন। আশা করছি অচিরেই বাংলাদেশে আরও ওই বিরল গ্রুপের রক্তধারী ব্যক্তির সন্ধান মিলবে এবং তাদের নাম-ঠিকানা সংরক্ষণ করা হবে। সন্তানময় বাবা দিবস রবিবার ছিল বাবা দিবস। মা দিবসের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হয় আমাদের দেশে আবেগে-আড়ম্বরের আতিশয্যে ভ্যালেন্টাইন্স দিবসের পরেই মা দিবসের অবস্থান। বাবা দিবস পিছনে পড়ে আছে। সামাজিক মানুষের মনোজগতের হদিস পাওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এখন বেশ উপযোগী। বাবা দিবসে লোকে বাবার ছবিসহ স্মৃতিকথা লিখেছে যতটা, তার চেয়ে কোনো অংশেই কম আবেগ প্রকাশ করেনি নিজেরই ছেলে-সন্তানের ব্যাপারে। নাগরিক বহুজনের কাছেই ছেলে হয়ে উঠেছে ‘আব্বা’। পিতৃহীন ব্যক্তির পুত্রসন্তান অন্তত সম্বোধনের দিক থেকে প্রয়াত পিতার স্থানে অভিষিক্ত হচ্ছে। আবার অনেক নারী তার ছেলের বাবাকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাবা দিবসে। বাবা দিবসে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার গদ্য-পদ্য তুলে দেয়া হলো পাঠকদের উদ্দেশে। বাবা যেদিক যাবা, যাবা মনে রাখবা বাবা আমার বাবা আসল বাবা মুখজোড়া যার কাবা। কাবার দিকে মুখ ফেরালে বাবা পাওয়া যায়, বাবার দিকে মুখ ফেরালে কাবা পাওয়া যায়। যেদিক যাবা, যাবা মনে রাখবা বাবা দিনদুনিয়ায় আল্লাহ্-রসুল তারপরেই বাবা। [২০০৮ সালে বাবাকে নিয়ে লিখেছিলাম ছোট্ট ছড়াটি। তখনো বাবা বেঁচে আছেন। এখন তিনি শুয়ে আছেন অনন্ত অম্বরে; আর বেঁচে আছেন সন্তানের অনঙ্গ অন্তরে। আজো আমি সশরীরে পথ চলি, চলতে চলতে বলি : বাবাই শুরু, বাবাই গুরু, বাবাই সর্ব-শুচি; বাবা, তোমাকে আমার সশ্রদ্ধ কদমবুচি।] ১৯ জুন ২০১৬ [email protected]
×