ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীপুরের ঐতিহ্যবাহী মুড়িতেও বিষ!

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৪ জুন ২০১৬

শ্রীপুরের ঐতিহ্যবাহী মুড়িতেও বিষ!

শেখ আব্দুল আওয়াল, শ্রীপুর থেকে ফিরে ॥ গাজীপুরের শ্রীপুরে ‘মুড়ির গ্রাম’ খ্যাত বারোতোপায় মুড়ি ভাজার ধুম পড়েছে। রোজা এসেছে, তাই ঘরে ঘরে বউ-ঝিয়েদের এখন আর ঘুম নেই। রোজায় ইফতারে প্রধান অনুষঙ্গই হচ্ছে মুড়ি। আর বারোতোপা গ্রামের মুড়ি দেশ ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও সমাদৃত। ফলে ব্যাপক চাহিদার কারণে দম নেয়ার ফুরসত নেই বারোতোপার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার। দশ বছরের শিশু থেকে সত্তরোর্ধ নারী-পুরুষ সকলে যে যেভাবে পারছে নিজের ঘরে এখন মুড়ি ভাজার কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ লাকড়ি কুড়াচ্ছে কেউ ধান শুকাচ্ছে কেউ বা ধান ভানছে এ চিত্রই এখন বারোতোপার গ্রাম জুড়ে। বারোতোপার লবণ-পানির সুস্বাদু মুড়ির খ্যাতি কয়েক শ’ বছরের পুরনো। দু’চার বছর আগেও লবণ-পানির এই মুড়ি ছিল খাঁটি-নির্ভেজাল। কিন্তু এখন বারোতোপায় ট্রাকে ট্রাকে আসছে ইউরিয়া। লবণের বদলে পানিতে ইউরিয়া মেশানো হচ্ছে। কারখানায় ভাজা মুড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আড়তদারদের প্ররোচণায় গ্রামের সহজ-সরল বউ-ঝিয়েরাও মুড়িতে মেশাচ্ছেন বিষ। বারোতোপা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, একজন মাটির হাঁড়িতে বালু ও অপরজন খোলায় ইউরিয়া মেশানো পানির সঙ্গে চাল মাখিয়ে গরম করছেন। প্রায় ১৫ মিনিট পর বালু আর চালের সংমিশ্রণে মুড়ি ফুটছে। এভাবেই প্রতিদিন বারোতোপার ঘরে ঘরে মণের পর মণ উৎপাদন হচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি। বারোতোপা গ্রামের মুড়ি সারাদেশেই ব্যাপক সমাদৃত। বিশ্বের অন্তত কুড়িটি দেশে এই হাতে ভাজা মুড়ি রফতানী হয়ে আসছে। স্রেফ হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করে গ্রামের এখনও প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। ৫০ বছরেরও অধিককাল ধরে এ পেশায় জড়িয়ে থাকা ইয়াসীন আলী জানান, সারাবছরই এই গ্রামে মুড়ি উৎপাদন হয়। তবে রমজান এলে মুড়ির চাহিদা বাড়ে চারগুণ। ফলে চাপ বেড়ে যায় সবার। তাই রাত জেগে মুড়ি ভাজতে হচ্ছে। তিনি জানান, গ্রামে এখনও প্রায় ১শ পরিবার মুড়ি ভাজার এই পেশায় রয়েছে। একযুগ আগেও গ্রামের সবাই ছিলেন এই পেশায়। স্থানীয় লোকজন জানান, বারোতোপা ছাড়াও আশপাশের বহেরাতলি, বেরামতলি ও বদনিভাঙা গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার মুড়ি ভাজার এই পেশায় ছিলেন। এসব গ্রামের দরিদ্র মুড়ি শ্রমিকরা পুঁজি না থাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পড়ে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে একে একে প্রায় ৯০ ভাগই এ পেশা ছেড়েছেন। কিন্তু বারোতোপা গ্রামের দরিদ্র মুড়ি শ্রমিকরা বিভিন্ন এনজিও কিংবা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। দিনের পর দিন আগুনে পুড়ে লবণ-পানি দিয়ে কুশলী হাতে সুস্বাদু মুড়ি ভেজে দুঃখ ঘুচানোর চেষ্টা করেছেন। বাজারে এসব মুড়ি ব্যাপক সমাদৃত হলেও কখনও লাভ পায়নি শ্রমিকরা। মুড়ি শ্রমিকদের তপ্ত শরীরে ঘাম ঝরেছে কিন্তু মুনাফা লুটেছে আড়তদাররা। এখন প্রতিযোগিতার বাজারে মুড়িকে লম্বা সাদা ফাঁপানো করে আকর্ষণীয় করতে মুড়ি বেপারি ও আড়তদাররা শ্রমিকদের ইউরিয়া সরবরাহ করছে। বেপারি ও আড়তদারদের প্ররোচনায় না বুঝে ঘরে ঘরে মুড়ি শ্রমিকরা লবণের বদলে চালে ইউরিয়া সার মিশিয়ে মুড়ি তৈরি করছে। একই সঙ্গে বারোতোপার কয়েক শ’ বছরের মুড়ির ঐতিহ্যও এখন বিনষ্ট হতে চলেছে। বারোতোপার ঘরে ঘরে গিয়ে দেখা গেছে, মুড়ি ভাজার চালের সাথে বস্তায় বস্তায় ইউরিয়া। মুড়ি শ্রমিক নাজমা আক্তার জানান, ১ কেজি ইউরিয়ায় প্রায় ১৬০ কেজি মুড়ি ভাজা হয়। লবণের দাম বেশি হওয়ায় আর বেপারি-আড়তদাররা খুশি হওয়ায় ইউরিয়া মিশিয়েই এখন মুড়ি ভাজছে শ্রমিকরা। গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. আলী হায়দার খান বলেন, ‘ইউরিয়া মিশিয়ে তৈরি করা মুড়ি খেয়ে তাৎক্ষণিক বদহজম, বমি বমি ভাব ও মাথাধরা শারীরিক সমস্যা হতে পারে। তবে শরীরে বিষক্রিয়া থেকেই যাবে। এতে মানুষের শরীরে স্থায়ীভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। লিভারের কর্মক্ষমতা কমে ও কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। এছাড়া ক্যান্সারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হাতে ভাজা মুড়িতেও ইউরিয়া মেশানোর অভিযোগ প্রসঙ্গে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমি বিষয়টি জানতাম না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
×