ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাঙ্গনে খুন হলে বিচার হয় না কেন?

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৪ জুন ২০১৬

শিক্ষাঙ্গনে খুন হলে বিচার হয় না কেন?

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩৭টি পাবলিক ও ৯২টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিকসহ নানা কারণে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) বহু সংখ্যক শিক্ষার্থী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ হত্যাকা-েরই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত হল দখল, পদ দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাসহ নানা কারণে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সৃষ্ট সংঘর্ষে মোট ৩২ শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এবং এদের মধ্যে অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট এসব সংঘর্ষের কারণে প্রায় ৬০০ দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ থেকেছে। এসব ঘটনার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমূল্য সম্পদ বিনষ্ট হওয়াসহ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকার। নব্বই পরবর্তী সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ১৫টি হত্যাকা- সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ৯টি হত্যাকা-ই ঘটিয়েছে ছাত্রশিবির। বাকি ৬টি সংঘটিত হয় ছাত্রলীগ, ছাত্রদলসহ অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী দ্বারা। ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলা বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারে আমলে বিচার ছাড়াই নিষ্পত্তি হয়েছে। অনেক মামলা এখনও ঝুলে রয়েছে। এ ধরনের চিত্র কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, এমন চিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও কম নয়। সম্প্রতি চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী খুন হওয়ার ঘটনা হয়ত অনেকেই ভুলে যাননি। রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে অনেক সংগঠনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থী খুন হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ডামাডোলে এসব মামলা হারিয়ে যাওয়া তথা বিচার না হওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বিচার না হওয়ার পেছনে যে বিষয়গুলো মূলত কাজ করে তা হচ্ছে; রাজনৈতিক ছত্রছায়া, হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে বিবেচনা করা, আদালতের ওপর রাজনৈতিক বা ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তার, মামলা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আদালতে নিয়মিত হাজিরা না দেয়া, দীর্ঘদিনেও আদালতে প্রতিবেদন জমা না দেয়া, দীর্ঘসূত্রতায় বিচার না হওয়ায় বাদী হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা পরিচালনা না করার মনোভাব সৃষ্টি হাল ছেড়ে দেয়া ইত্যাদি। ছাত্রহত্যার শেষ পর্যন্ত বিচার না হওয়ার কারণে পরবর্তীকালে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কর্মকা- ঘটাতে উৎসাহী হয়ে ওঠেÑ যা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রীতিমতো এক অশনি সঙ্কেতই বটে! এসব ঘটনার নেতিবাচক ফলাফল গিয়ে বর্তায় দেশ ও জাতির ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভিন্ন সময়ে হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলতে শোনা যায়, তদন্তপূর্বক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের থেকে প্রায় একই কথা বলা হয়Ñ এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খেঁাঁজ নিলে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যাকা- ও সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত অনেক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু কয়টি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেছে? এ কথা সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানের আধার আর মুক্তবুদ্ধিচর্চার পাদপীঠ। একাডেমিক উচ্চশিক্ষার শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চশিক্ষার এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-গবেষণা চর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। পাশাপাশি মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে তাঁদের দেশ গঠন, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা। অতীতের ছাত্র রাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে ঠিক এমন সব ইতিবাচক কর্মকা-ের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বার বার হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ায় ক্যাম্পাসে লেখাপড়া ও গবেষণার সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিবেশ বার বার ব্যাহত হয়। এই বাস্তবতায় সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পাঠিয়ে অভিভাবকদের রীতিমতো উদ্বিগ্নও থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সন্তানকে নিয়ে যেতে প্রত্যেক বাবা-মাকে অনেক কষ্ট করতে হয়। অনেক শ্রম, সময়, অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু যখন সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে ফিরে আসে, তখন এর চেয়ে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক বিষয় আর কিছুই হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ লাশ হয়ে ফিরুকÑ এমনটা কেউ-ই কখনও চান না। কিন্তু এদেশে অনেক বাবা-মাকেই এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা শূন্যের কোটায় বিরাজ করে। স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবই যে এসব অস্থিতরতার পেছনের মূল কারণ তা সহজেই অনুমেয়। দেশের জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও ব্যক্তি স্বার্থের কর্মকা- দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই পরিহার করা উচিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন যদি করতেই হয়, তবে তা একাডেমিক স্বার্থে করা উচিত। মেধাভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে যে শিক্ষার্থীর দেশ, জাতি ও সমাজ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করার কথা; আজ তারাই টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, হানাহানি, খুনোখুনিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১১ এই ৩ বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ ছাত্র। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৪৫ বছরে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩২ শিক্ষার্থী হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রাজনৈতিক কারণে এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ হত্যাকা-ের বিচার হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে সন্ত্রাসী কর্মকা- করে ‘ছাত্র’ নামধারী সন্ত্রাসীরা বার বার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন মনে জাগে শিক্ষাঙ্গনের এমন বাস্তবতা কিসের আলামত বহন করে? এসব অস্থিরতার মাধ্যমে দেশ-জাতিকে মেধা ও নেতৃত্বশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশী-বিদেশী কোন অশুভ চক্র বা কোন অপশক্তির যোগসূত্র রয়েছে কিনা- তা সংশ্লিষ্ট মহলসহ সরকারকে ভালভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা বন্ধ করেত তথা ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে তাদের স্বার্থেই সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে বা কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটালে সেই সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় এবং পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন বা নির্বাচনে এসব কর্মকা-ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী হত্যার সঙ্গে জড়িতদের যে কোন মূল্যে খুঁজে বের করে রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা জরুরী। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। [email protected]
×