ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

সৌদি আরব ॥ ৪ দিনের সফর যুগান্তকারী অর্জন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১১ জুন ২০১৬

সৌদি আরব ॥ ৪ দিনের সফর যুগান্তকারী অর্জন

৩ থেকে ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফর। মাত্র ৪ দিনের এই সফর যুগান্তকারী এক অর্জন বয়ে আনার অভাবনীয় ইতিহাস রচনা করল। অনাগত ভবিষ্যত এর মূল্যায়ন করবে। এতদিন বাংলাদেশের মানুষ জানত সৌদি আরব আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না, তাদের সুহৃদ হলো পাকিস্তানপন্থী বিএনপি এবং রাজাকার-আলবদর জামায়াত। এই ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বে। বিরোধীদলীয় নেতা থাকার সময় থেকে তিনি সৌদি আরবকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, বাংলাদেশের জনগণ ধর্মভীরু, ধর্মান্ধ নয়। আর আওয়ামী লীগ সত্যিকার ধর্মচর্চা করে আল্লাহ ও রসুল (স)-এর নির্দেশিত পথে। কূপম-ূকতায় বিশ্বাস করে না। সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারও অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারই তাদের সত্যিকার সুহৃদ। শেখ হাসিনার আগে মিলিটারি জিয়া ও এরশাদ-খালেদার নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো ছিল পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের গতানুগতিক ধারাবাহিকতা। তাতে কোন কূটনৈতিক ক্যারিশমা ছিল না। পাকিস্তানের সঙ্গে ধারাবাহিকতার কারণেই সম্ভবত সৌদি আরব আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করেছে। এই বিলম্ব ছিল তাদের ধারণাগত ভ্রান্তি। এই ভ্রান্তি বাংলাদেশের নেত্রী শেখ হাসিনা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। গত ৩ থেকে ৭ জুন শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবে সৌদি আরব সফরকালে লক্ষ্য করেছি, বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ও তার সরকার বাংলাদেশের নেত্রীকে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের যে উচ্চতায় স্বাগত জানিয়েছেন, সম্মানিত করেছেন, তা ইতোপূর্বেকার তিন দশকে আর কোন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে দেননি। সফরসঙ্গী হিসেবে আমরাও নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করছি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং জনগণ তো বটেই। অবশ্যই এটি শেখ হাসিনার জন্য নতুন কিছু নয়। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৮ থেকে অদ্যাবধি জাতিসংঘের সেরেস পুরস্কার, সাউথ-সাউথ পুরস্কার, বিশ্বের স্বনামধন্য এক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রী এবং সম্প্রতি বুলগেরিয়া সফর ও বিশেষ করে জাপানে অনুষ্ঠিত গ্রুপ-৭ (উন্নত ৭ দেশের জোট) শীর্ষ বৈঠকে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, জাপান, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশকে আগ্রহী করে তুলেছে। সর্বশেষ সৌদি আরবকে। জাপানে শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী সাংবাদিক কলামিস্ট জাফর ওয়াজেদ লিখেছেন, যে গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে জি-৭ জি-৮-এ পরিণত হবে। জি-৭ সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে উন্নয়নের রোল মডেলের রূপকার হিসেবে। বিশ্বের ধনাঢ্য নেতৃবৃন্দ রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কি করে বাংলাদেশ এত দ্রুত উন্নতি সাধন করল এবং এত দ্রুত এগিয়ে চলেছে। জাফর ওয়াজেদের মন্তব্য শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের ইমেজ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশ সৌদি আরবের সম্পর্কের চলমান ইতিবাচক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটিও কাজ করেছে বলেই সৌদি আরবেও শেখ হাসিনা মর্যাদার সঙ্গে সমাদৃত হয়েছেন। সৌদিরা অনুধাবন করেছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশই তাদের সত্যিকার বন্ধুরাষ্ট্র। পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে মিলিটারি জিয়া, এরশাদ, খালেদার রাজনীতিও সৌদি আরবের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। কি করে শেখ হাসিনা এমন অসাধ্য সাধন করলেন? বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ভাষায় ‘What is the masic of your leadership on countrys over all development, especially achicring 7.05% GDP. শেখ হসিনার উত্তর It is the people of Bangladesh. I know them, their demands. They also know me and have trust on me. সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের তুলনা করাটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। যেমন দেশটির আয়তন ২ কোটি ৫৩ লাখ বর্গকিলোমিটার, জনসংখ্যা ২ কোটি ৫১ লাখ অর্থাৎ এক বর্গকিলোমিটারে একজনের বাস, মাথাপিছু আয় ১৫ হাজার ৭১১ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে তো কারও তুলনা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কেবল দুটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাশাপাশি চলছে। যেমন শিক্ষার হার ও গড় আয়ুর দিকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ ৭০-এর ওপর চলছে। তবে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ এগিয়ে। তাছাড়া সৌদি আরব ইচ্ছা করলে যে কোন অবকাঠামো উন্নয়ন যখন তখন করতে পারে। যেমন সীমানাহীন অঢেল পতিত জমি, অবকাঠামো বা প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য জমির অভাব নেই, মাটিও ফেলতে হয় না, অর্থায়নের ক্ষেত্রেও কোন চিন্তা নেই, ভূগর্ভে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এসবের তুলনায় বাংলাদেশ ধারে-কাছেও নেই। তবু সীমিত সম্পদের যথার্থ ব্যবহার বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানিবাধিকারের প্রতি সম্মান, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, পুষ্টির জন্য মাছ, মুরগি, ফল-ফলাদির ব্যাপক উৎপাদন এবং মাত্র ৭ বছরে জিডিপি ৫ থেকে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া, একই সময়ে বিদ্যুত উৎপাদন ৩২০০ মেগাওয়াট থেকে ১৪৪৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত করার ব্যাপারটি ম্যাজিকই বটে। এবার বাজেট দেয়া হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো অনেক মেগা প্রজেক্ট। এমনকি বিশ্বব্যাংকের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই। এসব প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবও অভিভূত। যে কারণে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে এবার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্সসহ দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি নারী শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের স্বামী-পিতা-মাতা যে কোন একজনকে সঙ্গে রাখার অনুমতি দেয়ার কথা বলেছে। খালেদা জিয়ার সময় ২০০৪ সালে যে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়েছিল তাও আবার খুলে দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা কেবল দেশের অভ্যন্তরের উন্নয়ন নয়, রাজধানী ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী নান্দনিক অবকাঠামো নির্মাণ করেই থেমে থাকেননি, বিদেশের মাটিতেও আমাদের নিজস্ব দূতাবাস এবং রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য নিজস্ব আবাস নির্মাণ করে চলেছেন। ২০১০ সালে টোকিওতে নিজস্ব জমির ওপর বাংলাদেশ দূতাবাসের নিজস্ব চ্যান্সারি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং গত ২৮ মে জাপান সফরকালে ভবনের উদ্বোধন করেন। একইভাবে গত ৪ জুন সৌদি আরব সফরকালে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের চ্যান্সারি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে অস্ট্রেলিয়ায় দূতাবাসের জন্য জমি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলে সে কাজ আর এগোয়নি। বর্তমান মেয়াদে ক্ষমতায় এসে পুনরায় সেখানে নির্মাণ কাজ শুরু করতে গেলে দেখা যায় অর্ধেক জমি বেহাত হয়ে গেছে। তারপরও ওই জমিতেই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এভাবে শেখ হাসিনা বহির্বিশ্বে একেকটি মিনি বাংলাদেশ গড়ে তুলে চলেছেন। শেখ হাসিনার এবারের সৌদি আরব সফর ছিল ফলপ্রসূ এবং যুগান্তকারী। এই সফরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং নিরাপত্তা বিষয়ে সম্পর্কোন্নয়নে এক নতুন ও পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি তৈরি হলো। সৌদি সরকার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এই প্রথমবার বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। Soudi public investment fund বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ ও বিদ্যুত খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সৌদি মহামান্য বাদশাহর সঙ্গে শেখ হাসিনা উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব করলে বাদশাহ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও বিভাগীয় প্রধানদের নির্দেশ দেন। সৌদি চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে বৈঠককালে একটি গঙট স্বাক্ষরিত হয়। চেম্বারের একটি প্রতিনিধি দল আগামী কোরবানির ঈদের পর বাংলাদেশ সফর করবে। শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং একটি উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল সৌদি আরব সফর করেন। শেখ হাসিনা প্রথমদিন ৩ জুন জেদ্দায় অবতরণ করে জেদ্দা কনফারেন্স প্যালেসে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ এবং এহরাম বেঁধে অন্য সফরসঙ্গীদের নিয়ে রাজকীয় মোটরকেডযোগে পবিত্র ভূমি মক্কা শরিফ গমন করেন এবং সরাসরি ক্বাবা শরিফ তওয়াফ ও সাফা মারওয়ায় সায়ী করেন। রাতভর ওমরাহ হজ পালন শেষে ফজরের নামাজ আদায় করে ভোরে মক্কা রাজপ্রাসাদে কিছু সময় কাটিয়ে জেদ্দায় ফিরে আসেন। পরদিন রাজধানী রিয়াদে বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং সেখানে কিছু সময় মতবিনিময় করেন। বৈঠকটি ছিল দুই দেশের সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ৫ জুন রমজানের চাঁদ দেখা যায় এবং ৬ জুন থেকে রোজা শুরু হয়। শেখ হাসিনা ও সফরসঙ্গীগণ ৫ জুন পবিত্র নগরী মদিনা শরিফে গমন এবং ওইদিন রাতে মদিনা মনোয়ারায় তারাবি নামাজ আদায় শেষে আখেরি নবী হযরত মুহম্মদ (স)-এর রওজা মুবারকে সালাম প্রদান এবং রওজার পাশে দুই রাকাত নাজাম আদায় ও মোনাজাত করেন। মোনাজাত পরিচালনা করেন মদিনা মনোয়ারার খতিব। তারপর সেহরি খেয়ে ৬ জুন থেকে রোজা রাখতে শুরু করেন। এক কথায় বলতে গেলে শেখ হাসিনার এবারের সৌদি আরব সফর পরিবর্তিত ও দ্রুত অগ্রসরমান দুই দেশের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ সাক্ষাতের সময় শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করেন গধফধস ঝযবরশয ঐধংরহধ, ঐড়হড়ঁৎধনষব চৎরসব গরহরংঃবৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয বলে। পরিবর্তন সৌদি আরবেও শুরু হয়েছে। সৌদি জনপ্রিয় দৈনিক ‘Salman, Hasina discuss bilateral ties.’ ejv nq- Ôcustadian of two holy mosques king salman welcomed Bangladesh Prime Minster Sheikh Hasina Wajed on Sunday at al-Salam palace. Sheikh Hasina expressed thanks and appriciation to the king for the hospitality and warm welcome she was accorded. Then they discuss bilateral relations and aspects of cooperation between the two countries in different fields. The recieption was attended by crown prince Muhammad Bin Naif, Ammir of Makka province & others. ঢাকা ॥ ৯ জুন ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×