ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৮ হাজারের মধ্যে সাড়ে এগারো হাজার পরীক্ষা দিয়েছে ॥ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন ষড়যন্ত্র সফল হয়নি

একাংশের আন্দোলনের মধ্যে নার্স নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৪ জুন ২০১৬

একাংশের আন্দোলনের মধ্যে নার্স নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত

নিখিল মানখিন ॥ নার্সদের একাংশের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই শুক্রবার শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হলো নার্স নিয়োগ পরীক্ষা। মোট ১৮ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার নার্স। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার ৬৩.২৫ শতাংশ। সাড়ে ছয় হাজার নার্স নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এদিকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ব্যাচভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার দাবি জানিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা বর্জন করে সকাল থেকেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও নার্সিং কলেজের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে কয়েকশ’ নার্স। নার্স নিয়োগ পরীক্ষা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের অভিনন্দন জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে আন্দোলনরত নার্সরা। আন্দোলনকারীর অনেকেই নিয়োগ পরীক্ষার ফর্ম জমা দিয়েছেন এবং পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। পরীক্ষা বর্জনকারীর তুলনায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল দ্বিগুণ। নার্সদের এমন আন্দোলনের মধ্যেই শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নার্স নিয়োগ পরীক্ষা। আন্দোলনকারী নার্সের দাবির প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারী চাকরিবিধি অনুযায়ী পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ায় নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রেও কোনভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই। অন্য কোনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তাদের চাকরিতে স্থায়ীকরণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নার্স প্রতিনিধিদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনার পর হঠাৎ নার্সদের আন্দোলন ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচী এবং পরীক্ষা বর্র্জনের ঘটনা একটি মহলের ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ। পুলিশ সদস্যদের হাতে কয়েক নার্সের মৃত্যুর বিষয়টি কেবলই গুজব, সত্য নয় বলে খোদ আন্দোলনকারী নার্সদের অনেকেই স্বীকার করেছেন। তবে সাস্থ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বুধবার রাতে আন্দোলনরত বেকার নার্সদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর ধানম-ি থানায় মামলা হয়েছে। ৪ থেকে ৫শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পর বুধবার রাতে পুলিশ বাদী হয়ে মামলাটি করে। আন্দোলনরত বেকার নার্সদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ৫০ নার্স ও পুলিশ আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ২৮ মার্চ সরকারের কর্মকমিশন সচিবালয় ৩ হাজার ৬১৬ সিনিয়র স্টাফ নার্সের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তাতে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে নার্সরা। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদে নিয়োগ দেয়ার জন্য দাবিতে নার্সরা এ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারী নার্সরা অভিযোগ করেন, ২০১১ সালে নার্সদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার পর ২০১৩ সালে ৪ হাজার ১০০ নার্সকে ব্যাচভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। কিন্তু এখন সরকার সরকারী কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে এই নিয়োগ দিতে চাচ্ছে। এতে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষমাণ জ্যেষ্ঠ নার্সরা বঞ্চিত হবেন। বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটির (বিজিএনএস) সাধারণ সম্পাদক নাহিদা আক্তার বলেন, ২০০৬ থেকে ২০১৩ সালে সর্বশেষ নিয়োগ পর্যন্ত ব্যাচভিত্তিক নিয়োগ হয়ে আসছে। এজন্য ব্যাচভিত্তিক নিয়োগের ফলে সিনিয়ররা পদোন্নতি পেতেন, জুনিয়ররা আবেদনও করতেন না। আমি ২০০৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত আবেদন না করে অপেক্ষা করলাম। এখন বলা হচ্ছে, আমার পরীক্ষা নেয়া হবে। পিএসসির নতুন পদ্ধতিতে আমি বয়সের কারণে শুধু একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারব। তাহলে আমি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এতদিন অপেক্ষা করলাম কেন? নতুন পদ সৃষ্টি করে এবং শূন্য পদ মিলিয়ে মোট ১৩ হাজার ৭২৮ পদে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। বুধবার বিনা উস্কানিতে পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনরত নার্সদের ওপর অমানবিক হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন নাহিদা আক্তার। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারুক হোসেইন জানান, তারা কখনই এ প্রহসনের পরীক্ষা মেনে নেবে না। কঠোর থেকে কঠোরতম কর্মসূচীর মাধ্যমে ব্যাচ, মেধা ও সিনিয়রটি ভিত্তিতে তাদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়ন করবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন ॥ নার্স নিয়োগের পরীক্ষা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। পরীক্ষা শেষে শুক্রবার দুপুরে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারী চাকরির নিয়ম মেনে নার্সদের নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বেশিরভাগ প্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। কুচক্রী মহল অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করে নিয়োগ পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত করার চক্রান্ত করেছিল। তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। নার্সদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহানুভূতিশীলতার কথা পুনর্ব্যক্ত করে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, প্রধানমন্ত্রী নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী ১০ হাজার নার্স নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ নিয়োগ সম্পন্ন করতে পিএসসির কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। আন্দোলনে থাকা নার্সদের উদ্দেশ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, নার্সদের চাকরি দ্বিতীয় শ্রেণীর হওয়ায় পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নেই। আগে যাদের এ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের চাকরি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। তাদের চাকরি এখনও স্থায়ী ও নিয়মিতকরণ হয়নি। পদোন্নতিও পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় আবারও এ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হলে নার্সরা চাকরিজীবনে সঙ্কটে পড়বে। কিন্তু যারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি তারা নিজের জীবনকে সঙ্কটাপন্ন করেছে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্সদের নিয়োগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্সদের নিয়োগের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে। একইসঙ্গে আগামী ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নার্সদের চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা ৩৬ প্রমার্জনা করা আছে বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী। নার্সদের নিয়োগ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইলসাম আলমগীরের বিবৃতির সমালোচনা করে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সরকারী চাকরির আইন ও বিধিমালা নিয়ে তারা রাজনীতি করছেন। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি কত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দিয়েছে? স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও মর্যাদা প্রদান বর্তমান সরকারের চেয়ে কেউ বেশি করেনি। এখনও আন্দোলনে থাকা নার্সদের কোন উস্কানিতে কান না দিয়ে পরবর্তী নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সূত্র জানায়, সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কোনভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই। অন্য কোনভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তাদের চাকরিতে স্থায়ীকরণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। দেশের নার্স সঙ্কট এবং বেকার নার্সদের অবস্থা বিবেচনা করে ৩ হাজার ৬০০ নার্স নিয়োগ ত্বরান্বিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশন ১০০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার শর্ত শিথিল করে শুধু বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সম্মতি প্রদান করেছে। এদিকে, আন্দোলন ত্যাগ করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য আন্দোলনরত নার্সদের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের(বিএমএ) যুগ্ম মহাসচিব ও স্বাচিপের মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নার্সদের প্রতি আন্তরিকভাবে সহানুভূতিশীল বলেই তাদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করেছেন। সরকারও বেকার নার্সদের প্রতি সংবেদনশীল। নার্সদের প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক ও সহানুভূতির কোন কমতি নেই। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে নার্সদের উন্নয়নের একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে। সচিবালয়ে আন্দোলনরত নার্সদের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। উভয়পক্ষের মধ্যে বেশ ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। তাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতেও কিছু শৈথিল্য আনা হয়। এত ফলপ্রসূ আলোচনার পর হঠাৎ নার্সদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবন ঘেরাও করার বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকারের ইমেজ নষ্ট করতে একটি মহল নার্সদের ভ্রান্তপথে পরিচালনা করছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডাঃ এম এ আজিজ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা পরীক্ষিত চৌধুরী জানান, পরীক্ষায় ১১হাজার ৪শ’ ২৬জন অংশগ্রহণ করে। অনুপস্থিত ছিল ৬ হাজার ৬শ’৩৬।
×