ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতার পূর্বে দেখতে হয় শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু

নেত্রকোনার উদীচী ॥ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৪ জুন ২০১৬

নেত্রকোনার উদীচী ॥ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ

উদীচী অর্থ উত্তরদিক। বা ধ্রুবতারার দিক। সমুদ্রের দিকভ্রান্ত নাবিকরা উত্তরাকাশের ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে গন্তব্য স্থির করেন। ঠিক তেমনি ‘উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’ স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে অদ্যাবধি এ দেশের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ নির্দেশ করছে। তাই বলা চলেÑ উদীচী শুধু সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। উদীচী আান্দোলনেরও নাম। পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যখন ফুঁসে উঠছিল বাংলার মানুষ, উঁকি দিচ্ছিল কালজয়ী গণঅভ্যুত্থানÑ ঠিক সে সময় ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা অর্জন এবং শোষণ- বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিপ্লবী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’র জন্ম হয়। আর এর ঠিক এক বছর পর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বাইরে নেত্রকোনায় গড়ে ওঠে উদীচীর প্রথম শাখা সংগঠন। সেই থেকে দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে নেত্রকোনার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে উদীচী। নেত্রকোনায় উদীচীর শাখা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী (পরবর্তীতে উদীচীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক) সেন্টু রায়। ’৬৯-এ ১১ দফা আন্দোলন চলাকালে তিনি নেত্রকোনার ছাত্র ইউনিয়ন ও খেলাঘরের কিছু সংস্কৃতিকর্মী এবং সমমনা শিল্পী সংগঠকদের নিয়ে উদীচীর কার্যক্রম শুরু করেন। ওই সময় তার সঙ্গে আরও ছিলেন দিলীপ দত্ত, কাঞ্চন বিশ্বাস, অচিন্ত্য মজুমদার টটু, জেসমিন আহম্মেদ, পার্বতী রায়, দীপ্তি রায়, অলকা চৌধুরী, সিদ্ধার্থ সেন ও মুকুল কর। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতারাও এদের সহায়তা করেন। সংগঠনের নিজস্ব অফিস না থাকায় তারা উকিলপাড়ায় সাহাবুদ্দিন আহমেদের বাসায়, কখনও পাবলিক হলে, আবার কখনও নিউটাউন এলাকার হরেন্দ্র সরকার এবং বড়বাজারের সেন্টু রায়ের বাসায় রিহার্সাল করতেন। ওই সময় বিভিন্ন স্থানে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ প্রভৃতি গণসঙ্গীত গেয়ে তারা ১১ দফার আন্দোলনকে গতিশীল করে। ’৭০-এ উপকূলের জলোচ্ছ্বাসের পর ‘ভিক্ষা দাওগো পুরবাসী’ গান গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায় নেত্রকোনার উদীচী কর্মীরা। ’৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর নেত্রকোনায় উদীচী কর্মীরা গেয়ে বেড়ায় ‘মাগো বাংলায় আর কতদিন/নিজভূমে পরবাসী প্রতিদিন’, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’, ‘বিদ্রোহ আজ চারিদিকে’Ñ এ রকম অসংখ্য কালজয়ী গান। ওই বছর অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে দিলীপ দত্তের রচনা ও নির্দেশনায় উদীচীর ‘ফুটন্ত সকাল’ নাটকটিও ব্যাপক সাড়া জাগায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে নেত্রকোনা উদীচীর বেশকিছু সদস্য। ’৭৪-এ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তারে উদীচীর উদ্যোগে পরিবেশিত হয় ‘রক্ত, রাইফেল, স্বাধীনতা’ শীর্ষক গীতি আলেখ্য এবং দিলীপ দত্তের লেখা নাটক ‘গোলাপে গুলির গন্ধ’। ’৭৪ এর খাদ্যাভাবের সময় নেত্রকোনার উদীচী কর্মীরা রুটি, খিচুরি নিয়ে নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নেত্রকোনার উদীচী কর্মীরা ‘ইতিহাস কথা কও’ গীতিনাট্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রতিবাদ জানায় তেমনি ‘গলায় গলায় ভাব আছিল হিন্দু মুসলমান’ গান গেয়ে স্মরণ করিয়ে দেয় অসাম্প্রদায়িক বাংলার অতীতকে। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও সোচ্চার ছিল এখানকার উদীচী। ওই সময় উদীচী কর্মীরা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘পেন্সিল সাহেবের পাঁচালী’ নাটকের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনকে বেগবান করে। জোট শাসনামলে জেএমবি নামধারী জঙ্গীগোষ্ঠীর উত্থানের বিরুদ্ধে রাজপথে টানা কয়েকমাস ‘পতাকা মিছিল’ করে দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুন্ন রাখার আহ্বান জানায় উদীচী। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও নাটক, গান, আবৃত্তির পাশাপাশি সমমনাদের সংগঠিত করে রাজপথে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন করে। এছাড়াও সব ধরনের প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেখা মেলে এখানকার উদীচী কর্মীদের। আর এসব কারণে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে নেত্রকোনা উদীচীর। বিভিন্ন সময়ে শাসক ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর শিকার হতে হয়েছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের। ’৭১-এ রাজাকার গোষ্ঠীর সহায়তায় পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন উদীচীর প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী সিদ্ধার্থ সেন। তাকে দিয়েই নেত্রকোনায় পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সূচনা। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর জেএমবি নামধারী জঙ্গীগোষ্ঠীর নারকীয় বোমা হামলায় রক্তাক্ত হয় উদীচীর নেত্রকোনা জেলা সংসদ। নিহত হন গণসঙ্গীত শিল্পী খাজা হায়দার হোসেন, নাট্যকর্মী সুদীপ্তা পাল শেলীসহ আটজন। আহত হয় অন্তত ৫০ জন। এরপরও থেমে যায়নি সংগঠনটি। উপরন্তু নিহতদের ‘ভাস্কর্য’কে দ্রোহের প্রতীক করে এগিয়ে যাচ্ছে উদীচী কর্মীরা। আশির দশকে নেত্রকোনা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মতিয়র রহমানের সহায়তায় শহরের অজহর রোডে উদীচীর জেলা সংসদের নিজস্ব কার্যালয় স্থাপিত হয়। এর কিছুদিন পর প্রতিষ্ঠা হয় উদীচীর সঙ্গীত বিদ্যালয়। ‘হায়দার-শেলী স্মৃতি সঙ্গীত বিদ্যালয়’ নামে উদীচী পরিচালিত ওই প্রতিষ্ঠানটিতে সাধারণ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, তবলা, নৃত্য, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন প্রভৃতি শেখানো হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা একশ’ ৬০। ওই সাংস্কৃতিক নিকেতনের অনেক শিক্ষার্থীই এখন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও সপ্তাহান্তে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় উদীচীতে বসে সঙ্গীতের আসর। বিভিন্ন উপলক্ষ সামনে রেখে উদীচীর ব্যানারে বছর ধরে চলে সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠান, নাটক, গীতিনাট্য, গীতি আলেখ্য, আবৃত্তি সন্ধ্যা, বিষয়ভিত্তিক সেমিনার, আলোচনা সভা, গুণীজন সম্মাননা ছাড়াও বিভিন্ন দিবসভিত্তিক অনুষ্ঠান। পূর্বোল্লিখিত নাটক ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ‘দেবতার ভয়’, ‘ডাকঘর’, ‘শাস্তি’, ‘হইতে সাবধান’, ‘গৈ গেরামের পালা’, ‘কৈবর্ত্য’, ‘বোগাসবো’ ‘চোর’, ‘বাসফোর’, ‘সোনাইমাধব’ ‘গুনাইবিবি’ ‘মহুয়া’, ‘মলুয়া’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘খ্যাপা পাগলের প্যাচাল’, ‘চোরাকাহিনী’ প্রভৃতি নাটক দর্শকমনকে আন্দোলিত করেছে। এর মধ্যে কিছু নাটক ঢাকায় এবং ভারতেও মঞ্চস্থ হয়েছে। এ বছর উদীচীর নেত্রকোনা জেলা সংসদের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়েছে তিন দিনব্যাপী ‘ঢাকা বিভাগীয় নাট্যোৎসব’। ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার অংশগ্রহণে উৎসবটি নাট্যামোদী দর্শকদের বিপুল সাড়া জাগায়। মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বাচ্চু সভাপতি এবং সংস্কৃতিকর্মী নীলম বিশ্বাস রাতুল সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বর্তমানে উদীচীর নেত্রকোনা জেলা সংসদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এছাড়াও স্বাধীনতাপূর্ব ও পরবর্তী বিভিন্ন সময় নেত্রকোনায় উদীচীর কার্যক্রমকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যেÑ কেএম ফজলুল কাদের, মনিরউদ্দিন ফকির, অধ্যাপক ছহুল ওসমান, কাঞ্চন বিশ্বাস, হাবিবুর রহমান খসরু, গোলাম রব্বানী, পরিমল রায়, অঞ্জন ভদ্র, মোজাম্মেল হক বাচ্চু, প্রয়াত সুব্রত সরকার, সানাওয়ার হোসেন ভূঁইয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রয়াত উৎপল দত্ত, ওস্তাদ গোপাল দত্ত, বিপুল চৌধুরী পলু, প্রবাসিন্দু সাহা, সমীর সরকার রনু, দুলাল পত্রনবীশ, তুলিকা বিশ্বাস, দুলিকা বিশ্বাস প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×