ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

জয় বাংলা যেভাবে ছিনতাই হয়ে যায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৪ জুন ২০১৬

জয় বাংলা যেভাবে  ছিনতাই হয়ে যায়

(গতকালের পর) শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে ম্যানেজিং কমিটি বাতিল করে দেয়। সেলিমের পক্ষে হেফাজতকে নামানো হয়। সারা শহরে ধর্মীয় উত্তেজনা ও উন্মাদনার সৃষ্টি হয়। হেফাজতীরা কী বলেছেন ধর্মীয় উন্মাদনা ও দাঙ্গা ছড়াতে তা ইউটিউবেই আছে। সেই বিখ্যাত বাবুনগরী যিনি শেখ হাসিনাকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি নাকি বলেছেন, মালাউনকে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে। যথার্থ হয়েছে। (অবিকল উদ্ধৃতি নয়। যা বলেছেন তার সারমর্ম)। না এখানেই শেষ নয়। এখন ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করা হচ্ছে প্রবলভাবে। ছাত্র রিফাত অন্য বক্তব্য দিচ্ছে। সেলিম বলেছেন, শ্যামল এক কোটি টাকা চেয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বলছে, শ্যামল কান্তি ধর্মের অবমাননা করেননি। সেলিমপক্ষ বলছে, এ তদন্ত যথার্থ নয়। ॥ তিন ॥ ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করা হচ্ছে। শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটূক্তিই বড় অভিযোগ। কিন্তু কেন যেন মনে হয় এর পেছনে টাকাপয়সা বা শ্যামলকে সরিয়ে কাউকে বসানোর ব্যাপার নয় তো! তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। স্কুলের তহবিলে কত টাকা আছে, কী খাতে খরচের পরিকল্পনা ছিল, শ্যামলের ভূমিকা কী ছিল তা জানা গেলে বিষয়টি স্পষ্ট হতো। এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলছেন না। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিগুলোর কী অবস্থা তা আপনারা জানেন না, আমি জানি। সংসদ সদস্যের হুকুম ছাড়া কোন ম্যানেজিং কমিটি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের ইচ্ছাই শেষ ইচ্ছা। এর জন্য কিছু লেনদেনের ব্যবস্থা আছে। আমি আমার উপজেলা কচুয়ার যে কলেজের সঙ্গে যুক্ত সে কলেজের সভাপতি ছিলেন এর আগে বিএনপির সংসদ সদস্য মিলনের স্ত্রী। শিক্ষকদের চাঁদা দিয়ে তার সন্তানের জন্মদিনের সোনার হার উপহার দিতে হয়েছে। এই যখন শিক্ষকদের অবস্থা তখন ঘটনার পর শ্যামল যা বলছেন তা একান্তই তার ভাষ্য এ বিষয়ে সন্দিহান হওয়া যেতেই পারে। আমি এ দ্বন্দ্বে না-ই গেলাম। মূল কথা হলো সেলিম ওসমানের নির্দেশে শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করতে হয়েছে। এটি অপরাধ। একজন সংসদ সদস্য আইন ভঙ্গ করতে পারেন কিনা সেটি মূল প্রশ্ন। ভঙ্গ করলে তিনি সংসদ সদস্য থাকতে পারেন কিনা? বা সংসদের এ বিষয়ে কোন বক্তব্য আছে কিনা। বক্তব্য না থাকলে ধরে নিতে হবে, এ ধরনের প্রিভিলেজ এ্যাবিউজ করলে বা সদস্যরা আইন ভঙ্গ করলে সংসদের আপত্তি নেই। দ্বিতীয় বিষয়টি প্রথমটি থেকে গুরুতর। একজন নাগরিক নিজের পক্ষ ভারি করার জন্য ধর্মের অপব্যবহার করতে পারেন কিনা। প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত বার বার ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করা হচ্ছে। সেলিম প্রথমদিন বলেছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়? ‘আমরা কি ইবলিসের রাজত্বে বাস করছি?’ হেফাজত হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নামল কেন? টাকা ছাড়া হেফাজত কোন কাজ করে না। এর আগে জামায়াত-বিএনপির টাকা খেয়ে তারা ঢাকা অবরোধ করেছিল। ঢাকা ছেড়ে পালানোর পর চাটগাঁয়ের ধর্ম ব্যবহারকারী এমপিদের পরামর্শে নাকি বিমর্ষ হেফাজতীদের সান্ত¡না হিসেবে শেখ হাসিনা কিছু টাকাপয়সা দেন। সুতরাং, কার টাকা খেয়ে তারা এখন নামছে তা বোধগম্য। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য এখন মসজিদের মাইক ব্যবহার করা হয়। সেই বহু নারীগামী বিশ্ববেহায়া নামে পরিচিত লে. জে. হো. মো. এরশাদও বলেছেন সেলিমকে, সেলিমের ভাষ্য অনুযায়ী- “জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নির্দেশে আমি সংবাদ সম্মেলন বাতিল করেছি। এরশাদ বলেছেন, তোমার সঙ্গে আল্লাহ আছেন, আমরা আছি। সেলিম তুমি তো ওলি হয়ে গেছো। তোমার জন্য কয়েক কোটি মানুষ মসজিদে মসজিদে দোয়া করছে (ইনকিলাব, ২৭.৫.১৬)। এরশাদ কাউকে ওলি বললে তার সম্পর্কে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। সত্য অপলাপে যিনি ওস্তাদ তিনি যখন বলেন, সেলিমের জন্য কয়েক কোটি মানুষ দোয়া করছে তা সত্যের অবমাননা মাত্র। তবে সেটি আমার মূল বিষয় নয়। এরশাদ যেমন আগে ধর্ম নিয়ে খেলেছেন এখনও আবার ধর্ম নিয়ে মাঠে নামতে চাইছেন। এর আগেও তিনি ঢাকায় হেফাজতীদের পানি খাইয়েছিলেন। এই দুষ্ট প্রকৃতির লোকটিই যখন সেলিমকে ওলি বলছেন তখন সবারই সাবধান থাকা উচিত। কারণ, ধর্ম নিয়ে এরা যে কোন সময় দাঙ্গা লাগাবে এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইবে। এটি আরো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত পত্রিকাগুলোর বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশনে। উদাহরণস্বরূপ বিভিন্ন সময় মিথ্যা সংবাদ পরিবেশনের জন্য অভিযুক্ত আলবদরীয় পত্রিকা ইনকিলাবের স্পেশাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রিফাত বলেছে, সে বার বার বলেছে ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে। কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। রিফাত প্রথম দিন পরিষ্কার ভাষায় বলে, শ্যামল কান্তি ধর্মের অবমাননা করেননি। কয়েকদিন পর হেফাজতীদের সমাবেশে সে টুপি পরে গিয়ে বলে, শ্যামল কান্তি ধর্মের অবমাননা করেছেন। ইনকিলাব রিফাতও আমাদের উদ্দেশ করে বলেছে, সেলিম যদি শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস না করিয়ে “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর নাজেহালের মতো জামা কাপড় ছিঁড়ে রক্তাক্ত করতেন, যদি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শঙ্কর চন্দ্র দত্তের মতো জামা কাপড় খুলে জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দিতেন; তাহলে এই ছাত্রছাত্রীরা প্রতীকী প্রতিবাদে নিজেদের জামা-কাপড় নিজেরাই ছিঁড়ে রক্তাক্ত করে প্রতিবাদ করতেন? নাকি প্রতীকী প্রতিবাদে কাপড়চোপড় খুলে পানিতে ঝাঁপ দিতেন? প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনমত গঠনে গণমাধ্যম যা পারে পৃথিবীর আর কোন শক্তি ও ক্ষমতাধরদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তুমি অভিযোগ করেছ শ্যামল ভক্তের ইসলাম ধর্ম কটূক্তির ঘটনায়। মিডিয়া সত্য প্রকাশ করছে না। তোমার বক্তব্য সরাসরি প্রচার না করে নিজেরাই কথা জুড়ে দিচ্ছে। আবার কোন কোন মিডিয়া খ-িতভাবে বক্তব্য প্রচার করছে। ঘটনা ৮ মে’র। অথচ তিন-চারদিন মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। তোমার অভিযোগ, তোমার বক্তব্যই শুধু নয়, ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা ইংরেজী শিক্ষক উত্তম কুমার গুহ, তোমার সহপাঠী রূপন্তি, মাকসুদ, আসিফ, রাহিম, রমজান কারো বক্তব্য মিডিয়া সঠিকভাবে তুলে ধরেনি। এমনকি ঘটনা যারা দেখেছেন তাদের একজন আবদুল হাই। এমনকি তোমার মায়ের বক্তব্যও সঠিকভাবে তুলে ধরেনি মিডিয়া। তোমাকে চাপ দিয়ে অন্য ধরনের কথা বলানোর চেষ্টা করেছে। এমন দুটি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নামও প্রকাশ করেছ। তোমার কাছে প্রথমেই ক্ষমা চেয়েছি, যারা তোমার বক্তব্য সঠিকভাবে তুলে ধরেনি এবং তোমাকে অন্য ধরনের বক্তব্য দেয়ার জন্য প্রভাবিত করেছে তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দশম শ্রেণীতে পড়, অথচ ‘বাঁদর নাচে খুঁটির জোরে’ প্রবাদ পড়নি? ঘটনার পর কয়েকদিন ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিদের ‘বিবেক’ হঠাৎ জেগে উঠল কেন? ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তুমি বলেছো, ৮ মে দশম শ্রেণীর চতুর্থ পিরিয়ডে (ইংরেজী) উত্তম স্যার পড়াচ্ছিলেন। ক্লাসে হৈ চৈ। এ সময় হেড স্যার (শ্যামল কান্তি ভক্ত) উত্তেজিত হয়ে রুমে ঢুকলেন। প্রথমে মেয়েদের বলেন, ‘তোরা অমানুষ, শিক্ষার যোগ্যতা অর্জন করবি কিভাবে? তোরা নাপাক, তোদের আল্লাহও নাপাক।’ এ সময় উত্তম স্যার ছিল। ছাত্ররা বলেন, ‘হেড স্যার আমাদের ধর্মের বিষয়ে এভাবে কথা বলেন কেন।’ জবাবে উত্তম স্যার (হেড স্যারকে) বলেছেন, ‘স্যার, ওদের ধর্ম ওরা পালন করবে, আমাদের ধর্ম আমরা পালন করব।’ এ সময় সামনের বেঞ্চে বসা রূপন্তি উত্তম স্যারকে প্রশ্ন করে বলে, ‘স্যার, আমাদের ধর্মের বিষয়ে (হেড স্যার) এ রকম কথা কিভাবে বললেন?’ তখন উত্তম স্যার বললেন, ‘উনি হেড স্যার (শ্যামল কান্তি ভক্ত) যা ভাল মনে করেছেন, বলছেন’। পঞ্চম পিরিয়ডে আবার হেড স্যার আমাদের রুমে আসেন। শিক্ষক ছিলেন মোশাররফ স্যার। তাকে বিদায় দিয়ে হেড স্যার নিজেই ক্লাস নেন। তখন আমার পেছনে একজন শব্দ করে হাসে। আমি লিখছিলাম। স্যার ডাক দিয়েছেন বুঝতে পারিনি। আমার কাছে এসে শার্টের কলার ধরে বললেন, ‘তোমাকে ডাকছি শুনছো না? আমাকে কি হেড মাস্টার মনে হয় না? এরপর এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি শুরু করেন। তলপেটে ঘুষি লাগায় আমি বসে পড়ি। ‘ওরে বাবা, ওরে মা, আল্লারে বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। তখন স্যার বলেন, ‘কিসের আল্লাহ, আল্লাহ বলতে কিছু নেই। তোরা নাপাক, তোদের আল্লাহও নাপাক। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ক্লাসের ক্যাপ্টেন রাহিম রহমানকে দিয়ে হেড স্যার আমার জন্য ট্যাবলেট নিয়ে আসেন। বিকেলে স্কুল ছুটির পর ইসলাম ধর্ম অবমাননার খবর প্রচার হলে সবাই বিক্ষুব্ধ হন। মা কমিটিকে বিচার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরের দিন ৯ মে স্যার আমাদের বাড়িতে আসেন। আম্মাকে বলেন, ‘ধর্মের বিষয়টা, যেটা রিফাতকে ক্লাসে বলেছি, দয়া করে কমিটির লোকদের বলবেন না’; স্যার আম্মার কাছে মাফ চাওয়ায় দরখাস্তে ধর্ম অবমাননার কথা লিখিনি। আমার সামনে এসএসসি পরীক্ষা। স্যারের হাতে অনেক ক্ষমতা, এটা ভেবে আমার দুলাভাই (সাদেক) ধর্মের বিষয়টা উল্লেখ করতে নিষেধ করেন। অবশ্য সহপাঠীরা বলছিল তুমি মারের বিচার চাও, আমরা ধর্মের বিষয়ে একসাথে বলব। স্কুলে হেড স্যারকে ঘেরাও করলে এমপিই হেড স্যারের কান ধরে উঠবস করায়। এ ঘটনার তিন-চারদিন পর প্রথমদিকে মিডিয়ার বিভিন্ন লোকজন দশ-বিশবার আমাদের বাড়িতে আসত ঘটনা জানতে। ধর্ম নিয়ে কটূক্তির কথা আমি তাদের বলি। কিন্তু তারা (মিডিয়া) তুলে ধরে না। একাত্তর টিভি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল তুমি কি মাইকিং করছিলা? আমি বলি, না। তুমি কি লোকজন নিয়ে গিয়েছিলা, বললাম, না। এ কথাটাই ওই কথাটার (ধর্মের অবমাননা) সঙ্গে ভাঁজ খাইয়ে ওই ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। আমার কথা প্রচার না করে হেড স্যারের পক্ষে নিজেরাই বক্তব্য প্রচার করে। আমি যখন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন এলাকার অনেক লোক উপস্থিত ছিল। তারা শুনছে। আর যত মিডিয়া আসছে তাদের কেউ সত্যটা প্রকাশ করছে না। সরকারী লোকজনও এসেছে। তাদের কাছে রূপন্তি, মাকসুদ, আসিফ, রাহিম, রমজান এবং আমি ধর্ম অবমাননাসহ সব বলেছি। এটা পরে কি হলো বুঝতে পারলাম না” (ইনকিলাব, ২৭.৫.১৬)। ঘটনার প্রায় দশ দিন পর এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করার উদ্দেশ্যÑ বিষয়টি যেন চাঙ্গা থাকে, ঝিমিয়ে না পড়ে। যেন দাঙ্গাটা বাধেই। (চলবে)
×