ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে ৫ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত, ৫০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৪ মে ২০১৬

চট্টগ্রামে ৫ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত, ৫০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/ আহমেদ হুমায়ুন ॥ ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রামের ৫ উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষ। মৃতের সংখ্যা আর বাড়েনি। নারী-শিশু, পুরুষসহ ১২ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আহতের সংখ্যা শতাধিক। কাঁচা, আধা পাকাসহ বিভিন্ন ধরনের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে অর্ধ লক্ষাধিক। সব মিলিয়ে বেসরকারী তথ্য অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ৪শ’ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে প্রায় শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে একমাত্র খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই ও অন্যান্য বাণিজ্যপাড়ায়। এছাড়া অবশিষ্ট ৩শ’ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে পতেঙ্গা ও নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। তবে সরকারীভাবে চট্টগ্রাম জেলায় ক্ষতির পরিমাণ দেড়শ কোটি টাকারও বেশি বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। শনিবার ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত হানার পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া রবিবার চট্টগ্রামে আসেন। ঐদিন সন্ধ্যার পর তিনি জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার পর সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। ব্রিফিংকালে তিনি দাবি করেন ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে দেড়শ’ কোটি টাকা বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এ পরিমাণ আরও বাড়বে নিঃসন্দেহে। তিনি সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আনোয়ারা ও বাঁশখালীর উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করেন। উল্লেখ্য, বাঁশখালীর তিনটি ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ উপজেলায় মোট মৃতের সংখ্যা ৯ জন। এ উপজেলায় ১০ হাজারেরও বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ২২ সহস্রাধিক। এ উপজেলায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছনুয়া, খানখানাবাদ, গ-মারা ও বাহারছড়া ইউনিয়ন। অপরদিকে আনোয়ারা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ হাজার পরিবার। বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার। এ উপজেলার কোন প্রাণহানি ঘটেনি। তবে আহত হয়েছে অনেকে। এদিকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পতেঙ্গা এলাকা। এ এলাকার বিমান বন্দর পয়েন্ট থেকে নেভাল একাডেমি পর্যন্ত সমুদ্র সংলগ্ন মেরিন ড্রাইভ রোডটি ও এর সীমানা দেয়ালটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। পতেঙ্গায় সহস্রাধিক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া মহানগরীর অন্যান্য এলাকায় কাঁচা, আধা পাকা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে আরও ২ শতাধিক। অপরদিকে দেশে ভোগ্যপণ্যের একক বৃহত্তম পাইকারি বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা বলে দাবি করেছে খাতুনগঞ্জ ট্রেড এ্যান্ড কমার্স এ্যাসোসিয়েশন। এই দুই স্থান সংলগ্ন অন্যান্য বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতেও জোয়ারের পানি প্রবেশ করে পণ্য সামগ্রী ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ঘূর্ণিঝড় স্থল নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর শনিবার রাত থেকেই ভারি বর্ষণ ঘটিয়ে এটি খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এলাকা দিয়ে অতিক্রম করেছে। এর পরদিন সকাল থেকে কার্যত দৃশ্যমান হয় ক্ষয়ক্ষতির রূপ। পতেঙ্গা এলাকা পরিদর্শন করে দেখা গেছে মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ছোট ছোট দোকানপাটগুলো মুড়ির টিনের মতো চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। বড় বড় বিপুলসংখ্যক গাছপালা উপড়ে গেছে। মেরিন ড্রাইভের সীমানা দেয়ালটি খ--বিখ- হয়ে ভেঙে জোয়ারের পানিতে কূলে উঠে এসেছে। এছাড়া পতেঙ্গার ঘনবসতি এলাকা বাড়িঘর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে জাহাজ দুটি খেজুর গাছ তলায় উঠে এসেছে সেগুলো এখনও নামানো যায়নি। এ দুই জাহাজ বহির্নোঙর থেকে নোঙর ছিঁড়ে বাতাস ও স্রোতের টানে চড়ায় উঠে যায়। খাতুনগঞ্জে ব্যাপক ক্ষতি ॥ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে বাণিজ্যপাড়া খাতুনগঞ্জের সংলগ্ন বাণিজ্যিক এলাকাগুলো তথা চাক্তাই, আছাদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, মাঝিরঘাট, হালিশহর এবং বন্দর সন্নিহিত রিপাবলিক ক্লাব এলাকা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসকল এলাকায় রয়েছে অন্তত ৫শ’ গুদাম। এসব গুদামের অধিকাংশেই জোয়ারের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করেছে। গুদামে সংরক্ষিত বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রী নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীগণ। এসব স্থানে আমদানির ভোগ্যপণ্যের গুদামের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আসন্ন রমজানের পূর্বে আমদানির ভোগ্যপণ্যের চালান বিভিন্ন গুদামে সংরক্ষিত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি গুদামসমূহে ঢুকে যাওয়ায় পণ্য সামগ্রীর নিচের সারির অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। চট্টগ্রামে ত্রাণমন্ত্রী ॥ ঘূর্ণিঝড়ের পর রবিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। চট্টগ্রাম পৌঁছে তিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। এর আগে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন রোয়ানুর আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি তথ্য ত্রাণমন্ত্রীর নিকট তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে চট্টগ্রাম নগর ও উপকূলীয় এলাকার ১০৪টি ইউনিয়নের ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৮১ হাজার ৪১১ জন মানুষ। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪ লাখ ১ হাজার ৬৭৫ জন মানুষ। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, রোয়ানুর আঘাতে ২০ হাজার ৮৯২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ২৫ হাজার ৭৬৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া বাঁশখালী, আনোয়ার, সন্দ্বীপ, পটিয়া ও সীতাকু- উপজেলার ১৫৪ একর ফসলী জমি সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৪১ একর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবাদি পশুর মধ্যে ৮০টি গরু ও ৪০ হাজার ৫৫০টি হাঁস-মুরগি ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সৃষ্ট পানিতে ভেসে মারা গেছে। এছাড়া ৩৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১২টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৪৭ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ এবং ১৪৪ একর সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ে ২৭ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ও ৬৬ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত না থাকায় রোয়ানুর ফলে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোয়ানুর আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে অনেক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঁধগুলো ঠিক থাকলে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতো না। প্রাণহানির ঘটনাও অনেক কমে আসত। মন্ত্রী বলেন, বাঁধ যদি হয় ৬ ফুট আর পানি যদি আসে ৮ ফুট হয়ে সেই বাঁধ টিকবে কিভাবে? বাঁধগুলো সুরক্ষিত করতে না পারলে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। ‘বাঁধগুলো আরও সুরক্ষিত করতে হবে। এটা শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাজ না। তিনি স্ব স্ব মন্ত্রণালয়গুলোকে বাঁধগুলোর সুরক্ষাসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন যাতে কোন অবস্থাতে কোন মানুষ কষ্ট না পায় সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের তহবিলে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণ মজুদ আছে। ইতোমধ্যে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ৭টি উপজেলা ১৯৮ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনের সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন। সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক, জেলা পুলিশ সুপার, জেলা সিভিল সার্জন, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সরকারী কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, জলবায়ু সুরক্ষায় আমাদের আরও মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশে প্রতি যতœবান হতে হবে। না হলে প্রকৃতি তার বিরূপ আচরণ করবে। তিনি একটা মানুষও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেয়ার নির্দেশনা দেন। বাঁশখালী ও আনোয়ারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। চট্টগ্রামে মৃতের সংখ্যা ১২ ॥ ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামে প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন।
×