ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তুরস্কের জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৪ মে ২০১৬

তুরস্কের জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে

তৌহিদুর রহমান ॥ দেশের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- ঘিরে পাকিস্তানের অবস্থানকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে তুরস্ক। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যেন এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে দেশটি। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় কে বেশি ভূমিকা নিতে পারে তাই নিয়ে যেন শুরু হয়েছে এই প্রতিযোগিতা। তবে তুরস্ক সরকারের ভূমিকা নিয়ে এবার দেশটির ভিতর থেকেই কঠোর সমালোচনা শুরু হয়েছে। এদিকে তুরস্ক সরকার বাংলাদেশীদের ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে বলে অপপ্রচার শুরু করেছে যুদ্ধাপরাধ বিচার বিরোধী পক্ষ। তবে ঢাকার তুরস্ক দূতাবাস বলছে, বাংলাদেশীদের জন্য তুরস্কের ভিসা বন্ধ হয়নি। পাকিস্তানকে বারবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করলেও দেশটি সে কথা শুনেনি। বাংলাদেশের আহ্বানের প্রতি সাড়া না দিয়ে বারবার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলিয়ে আসছে পাকিস্তান। এর আগেও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে একাধিকবার নাক গলিয়েছে পাকিস্তান। নিজামীর ফাঁসির পর তারা বলেছে, এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে প্রস্তাব তুলবে। এছাড়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেয়ার জন্য ঐকমত্যে আনার চেষ্টা করছে দেশটি। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে পাকিস্তান বরাবরই তাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলেও তুরস্কের সুর ছিল নরম। তুরস্ক কখনোই শক্তভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে নিজামীর ফাঁসির পর তুরস্ক বেশ কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ঢাকা থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান স্বয়ং বিষয়টি দেখভাল করছেন। তিনি ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওসতুর্ককে ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে অবহিত হয়েছেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তুরস্ক ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেয়ার পরে তাকে আর এই দেশে ফিরিয়ে না আনার জন্য দাবি উঠেছে। অনেকেই বলছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুকে কেন্দ্র করে তুরস্ক সরকার তাকে ফেরত নিয়ে গেছে। তাকে এখানে আবার ফেরত আনা উচিত হবে না। এ বিষয়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, তুরস্কের যারা ক্ষমতায় আছে তারাও জামায়াতের ঘনিষ্ঠ লোক। সে কারণে ঢাকার তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তবে তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে ফেরত না আনার জন্য তিনি দাবি জানান। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির বিপক্ষে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা শুরু হয়েছে। সে দেশের দুটি পত্রিকা এখন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অনবরত সমালোচনা করছে। এছাড়া তুরস্কের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও তুরস্ক সরকারের সমালোচনায় এখন মুখর। তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ডেইলি সল এবং এবিসি গেজেটেসি যুদ্ধাপরাধের বিচারের ভূমিকায় তুরস্ক সরকারের অবস্থানকে সমালোচনা করে আসছে। এবিসি গেজেটেসি পত্রিকায় প্রকাশিত পত্রিকায় ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এরদোগান’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। এতে বলা হয় বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে গণহত্যায় সহায়তাকারীদের পক্ষ নিয়েছে তুরস্ক সরকার। এটা কখনই উচিত হয়নি। পাশাপাশি কঠোর সমালোচনা করা হয় প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও ক্ষমতাসীন একে পার্টির। যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির পর থেকে যুদ্ধাপরাধ বিচার বিরোধী পক্ষ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশীদের জন্য তুরস্ক সরকার ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম মিথ্যা খবর পরিবেশনও করেছে। তবে ঢাকার তুরস্ক দূতাবাস জানিয়েছে, ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত ফিরিয়ে নেয়া হলেও ভিসা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। তুরস্ক দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ঢাকায় তুরস্ক দূতাবাস ও ভিসা কার্যক্রম নিয়ে কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার বাস্তবসম্মত ভিত্তি নেই। ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাস খোলা এবং পুরোদমে কাজ চলছে। অনলাইন ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভিসা ইস্যু অব্যাহত রেখেছে তুরস্ক দূতাবাস। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে এখনও সাফাই গেয়ে চলেছে তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্টের পর দিল্লীতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ড. বুরাক আকচাপার বলেছেন, এই ফাঁসি কার্যকর করায় তারা যে ক্ষুব্ধ, সেটা প্রকাশ করাটা তুরস্কের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তুরস্ক নিজামীকে কোন যুদ্ধাপরাধী নয়, বরং একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দেখছে। এই ফাঁসি কার্যকর এটা বাংলাদেশের বিরাট এক ভুল বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এর আগে প্রেসিডেন্ট এরদোগান নিজামীর ফাঁসির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোন ভূমিকা না নেয়ায় সংস্থাটির সমালোচনা করেন। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ বিচারের শুরু থেকেই পাকিস্তান ও তুরস্ক এই বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস ও ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) গভীর সম্পর্কের কারণেই দেশটি এই অবস্থান নেয়। তবে তুরস্ক সরকারের এই অবস্থানের সঙ্গে দেশটির সাধারণ জনগণের কোন সম্পর্ক নেই। তুরস্কের সাধারণ জনগণ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষেই রয়েছেন। তুরস্কের সংবিধান ধর্মনিরেপক্ষ হলেও ক্ষমতাসীন একে পার্টি তা লঙ্ঘন করেছে। এই পার্টিকে নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতে ইতোমধ্যে মামলাও হয়েছে। একে পার্টি তুরস্কে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত। আর এই রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার শুরু হলে তুরস্ক থেকে একটি আইনজীবী প্রতিনিধি দলও ঢাকায় এসেছিল। তবে অন এ্যারাইভাল ভিসা নীতি লঙ্ঘন করায় তাদের ঢাকা থেকে তুরস্কে ফেরত পাঠানো হয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে এই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছিল। এছাড়া ২০১১ সালে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপুমনির সঙ্গে তুরস্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকেও যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল দেশটি। তবে বাংলাদেশ তার অবস্থান থেকে সরে আসবে না বলেও তুরস্ককে জানানো হয়েছিল।
×